Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫

গভীর ঘুম আর ভাঙেনি আয়ানের

আয়ান
শিশু আয়ান আহমেদ
[publishpress_authors_box]

পুরো এক সপ্তাহ কোমায় থাকার পর না ফেরার দেশে চলে গেছে পাঁচ বছরের শিশু আয়ান আহমেদ।

ঢাকার বাড্ডায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আয়ানকে ভর্তি করা হয়েছিল খৎনার জন্য। ৩১ ডিসেম্বর অস্ত্রোপচারের জন্য দেওয়া অ্যানেসথেশিয়ার পর আর চোখ খোলেনি সে।

গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ‘গভীর ঘুমে’র মধ্যেই আয়ান পাড়ি জমিয়েছে অন্য এক জগতে, যেখান থেকে আর ফেরে না কেউ।

ররিবার (৭ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালটির চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সোমবার কথা হয় তার বাবা শামীম আহমেদের সঙ্গে।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানান, গত বছরের শেষদিন ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খৎনার জন্য ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন। সেদিনই সকাল ৯টার দিকে তাকে অ্যানেসথেশিয়া দেওয়া হয়। অস্ত্রোপচারের পর বেলা ১১টায়ও যখন তার জ্ঞান ফেরেনি তখন আয়ানকে স্থানান্তর করা হয় গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে।

সেখানেই রবিবার রাত পর্যন্ত তাকে রাখা হয়েছিল লাইফ সাপোর্টে। রাত ১১টা ২০ মিনিটে খুলে নেওয়া হয় তাকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার সমস্ত আয়োজন। মাত্র ৫ বছর ৯ মাসেই শেষ হয়ে যায় আয়ানের জীবন।

ইউনাইটেড হাসপাতালের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছে, আয়ানের মৃত্যুর কারণ ‘কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেইলিওর, মাল্টিঅর্গান ফেইলিওর এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’।

সোমবার (৮ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়েছে আয়ানকে।

তার চাচা মো. হাবিবুর রহমান বললেন, “যে বাড়িতে এতগুলো বছর আয়ান হেসে-খেলে বড় হয়েছে, যে বাড়ির প্রতিটি স্থানে তার চিহ্ন রয়েছে, সেখানেই তাকে দাফন করা হয়েছে। ওর মাকে কোনোভাবে ঠিক রাখা যাচ্ছে না। তিনি বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। মাত্র ৯ মাস বয়সী মেয়ে সন্তানের দিকেও তার খেয়াল নেই।”

হাবিবুর রহমানের অভিযোগ, আংশিক অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে পুরোপুরি অজ্ঞান করেন। আয়ানকে ‘ভুল অ্যানেসথেশিয়া’ দেওয়া হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি।

এ ঘটনায় মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন আয়ানের চাচা। তিনি বলেন, “মামলা করব বলেই সব কষ্ট পাথরচাপা দিয়ে এতটুকু ছেলের পোস্টমর্টেম করেছি আমরা। এমনি এমনি ছেড়ে দেব না।”

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলেই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে বলেও মত দেন তিনি।

হাবিবুর রহমান বলেন, “সেদিন আয়ানকে অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার পর চিকিৎসকদের রোগীর প্রতি খেয়াল ছিল না। তারা ফোকাস করেছিল শিক্ষার্থীদের শেখানোর দিকে। আয়ানকে গিনিপিগ বানিয়ে সেখানকার চিকিৎসকরা শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে শেখাচ্ছিলেন। দেড় ঘণ্টা পরও যখন আয়ানের জ্ঞান ফিরছিল না, তখন তাদের টনক নড়ে।”

আয়ান
আয়ানের এই হাসিমুখ আর দেখবে না পরিবার।

দীর্ঘসময় জ্ঞান না ফেরায় আয়ানের বাবা সন্তানের কাছে গিয়ে দেখতে পান তাকে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন) দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে উপস্থিত চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের শারিরীক ভাষা ও কথাবার্তায় তিনি বুঝতে পারেন যে কোনও সমস্যা হয়েছে।

এরপরই সেখান থেকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয় আয়ানকে।

তার চাচার অভিযোগ, সেসময় আয়ানের কী হয়েছে, কেন স্থানান্তর করা হচ্ছে বা তাকে কী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিবারকে কিছুই জানায়নি।

পরিবারের পক্ষ থেকে আয়ানের ব্যবস্থাপত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চিকিৎসককে দেখানো হয়েছে জানিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, “উনি বলেছেন আয়ানকে ‘ভুল অ্যানেসথেশিয়া’ দেওয়া হয়েছে।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করেন নি তিনি। তবে ওই চিকিৎসক আয়ানকে অ্যানেসথেশিয়া দেওয়া চিকিৎসকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। তার কাছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক স্বীকার করেছেন যে, “অ্যানেসথেশিয়ার মাত্রা ভুল হয়ে গিয়েছিল, অনেক বেশি মাত্রায় পড়ে গিয়েছিল।”

“এই মাত্রাতিরিক্ত অ্যানেসথেশিয়া দিয়েও তারা আয়ানকে নিয়ে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টার মতো ক্লাস নিয়েছেন। চিকিৎসকাশিক্ষা কবে এমন অমানবিক হয়ে গেল?”-প্রশ্ন রাখেন হাবিবুর রহমান।

এই মৃত্যুর বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আয়ান এ হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। মঙ্গলবার তাদের মিটিং রয়েছে। তদন্তে কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে কর্তৃপক্ষ।”

শিশুদের অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যানেসথেশিওলজিস্ট ডা. দেওয়ান সাবরিনা মাসুকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “সবার জন্যই অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার পদ্ধতি আলাদা। তবে শিশুদের জন্য সেটা আরও বেশি প্রযোজ্য এবং সেটা কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত।”  

সব বয়সী মানুষকে অ্যানেসথেশিয়া দেওয়ার জন্য নির্ধারিত মাত্রা থাকে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। কোনও শিশুকে যদি কখনো অ্যানেসথেশিয়া দিতে হয় তাহলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়ে কাজে নামতে হবে।”

শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে আয়ানের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের সনদ বাতিল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম জনস্বার্থে এ রিট আবেদন করেন। এতে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।

এ ঘটনায় তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান জানান, কমিটির প্রধান করা হয়েছে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধানকে। তার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে রয়েছেন মুগদা হাসপাতালের অ্যানেসথেশিয়া বিভাগের একজন চিকিৎসক, হাসপাতালের একজন সহকারী পরিচালক এবং অধিদপ্তরের এক সহকারী পরিচালক।

কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত