বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় তো নয়ই, এমনকি এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয়নি। উচ্চশিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের অনুমোদিত ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও স্থান পায়নি এই তালিকায়। সেরা ৩০০ তালিকায় ভারতের ৪০টি, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। এশিয়ার ৩১ দেশের মোট ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র্যাংকিং করা হয়েছে।
অবশ্য তালিকায় ৩০১-৩৫০ এর মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। গতবার তালিকায় ১৮৬তম স্থানে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২তম স্থান অর্জন করেছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এবার তাদের র্যাংকিয়ে পতন হয়েছে।
এছাড়া ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৪০১-৫০০’র মধ্যে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫০১-৬০০’র মধ্যে আছে।
এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকাটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার চরম দুর্দশারই প্রতিচ্ছবি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনোই বিশ্বর্যাংকিয়ে ভালো করতে পারে না। সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার এই দেশে ১৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও এর কোনোটিই এশিয়ার সেরা ৩০০-এর মধ্যে নেই। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে?
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন আছে— হতাশা আছে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবক্ষয়গ্রস্ত হয়েছে অতিরিক্ত দলীয় রাজনীতির চর্চা আর দেশের নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার কারণে।
কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও কাঙ্ক্ষিত মান অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা চর্চার চেয়ে অর্থনৈতিক লাভ বেশি গুরুত্ব পায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, শিক্ষা বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট কোনও লক্ষ্য নেই।
দেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এর মান বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতি বছর স্নাতক ডিগ্রি লাভকারীদের অন্তত ৭০ ভাগের মান সন্তোষজনক নয় বলে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মন্তব্য করেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, উচ্চশিক্ষায় গলদ থাকায় বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট জাতির বোঝা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
শিক্ষাগুরু সক্রেটিস থেকে শুরু করে নিকট-অতীতের টোল পণ্ডিতরা জ্ঞান বিতরণের কাজকে ঐশ্বরিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করতেন। কিন্তু যুগ-পরিবর্তনের হাওয়ায় দৃশ্যপট আমূল পাল্টে গেছে।
জ্ঞান বিতরণের কাজটি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং সেন্টার ইত্যাদির পর শিক্ষা-বাণিজ্যে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা এক-একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে প্যাকেজের আওতায় জাতিকে জ্ঞান বিতরণের মহৎ কাজটি করে চলেছেন।
জ্ঞানার্জনের উপায়, পদ্ধতি ও পরিবেশ যাই হোক না কেন, পকেটে যথেষ্ট অর্থকড়ি না থাকলে সেখানকার ছাত্রত্ব অর্জন করা যায় না।
দেশে পাসের হার বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। তবে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির অনুপাতে শিক্ষার মানের উন্নয়ন করা না গেলে এ থেকে কোনও সুফল পাবে না জাতি।
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে অনেকেই কোচিং সেন্টারের আদলে বহুতল ভবনের একটি বা দুটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বাণিজ্যের পসরা খুলে বসেছে। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭০-এরও বেশি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর বেশিরভাগেরই না আছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক, পাঠাগার ও গবেষণাগারসহ সমন্বিত পাঠদানের ব্যবস্থা, না আছে অবকাঠামোসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক এবং জ্ঞানচর্চার মুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক উত্তীর্ণদের জানার ভিত দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। বাস্তবে যে এটিই ঘটছে।
গণতন্ত্রকে সংখ্যার প্রাধান্য রূপে গণ্য করতে অভ্যস্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতারা পরিমাণ নিয়ে এতই ভাবিত যে, গুণগত উৎকর্ষকে সংখ্যার যূপকাষ্ঠে বলি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। তাইতো তারা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অকাতরে ছাড়পত্র দিয়েছেন।
তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আকাশে উঠেছে, শিক্ষার মান কোন অতলে নেমেছে, তা জানতে তদন্ত কমিটি করা যেতে পারে। লক্ষণীয়, সামগ্রিকভাবেই উচ্চশিক্ষার মানের সঙ্গে আমাদের দেশের সরকারগুলো গুরুতর আপস করে আসছে। এখানেই বঞ্চিত বাংলাদেশ— আজ বহুদিন ধরে।
ইউনেসকো শিক্ষাখাতে বাজেটের ২৫ শতাংশ এবং জিডিপির ছয় শতাংশে বরাদ্দের কথা বলে। কিন্তু আমরা সেসব পরামর্শকে পাত্তা দিই না। অনেক কম সামর্থ্যবান দেশেও কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণায় প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। কিউবা যদি তাদের মোট খরচের শতকরা ১২ শতাংশের বেশি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করে, বতসোয়ানা যদি সাত ভাগের বেশি করতে পারে, বুরুন্ডি যদি ছয় শতাংশ করতে পারে, তা হলে আমরা তিন শতাংশের বেশি বরাদ্দ করতে পারব না কেন?
গবেষণা ছাড়া শিক্ষাকে আর শিক্ষা ছাড়া দেশকে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব। বিশ্বের সব দেশেই গবেষণাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা সবচেয়ে কম মূল্য দিই গবেষণাকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণা প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় না।
উচ্চশিক্ষায় ইউজিসি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল বাজেটে ১৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের তুলনায় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ২৪ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে গবেষণা খাতে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল।
দেশের সবচেয়ে সেরা বিদ্যাপীঠের বাজেটের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৯১৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। বাজেটে গবেষণা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের এক দশমিক ৬৪ শতাংশ। বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর সিংহভাগ খরচ হবে (৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ) শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়।
এই হচ্ছে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষায় গবেষণাখাতে ব্যয় বরাদ্দের চিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো তবু কিছু টাকা ধরা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে গবেষণায় কোনও টাকাই বরাদ্দ থাকে না! উচ্চশিক্ষায় গবেষণা খাতে কোনও বরাদ্দ না রাখার ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রথম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে নতুন জ্ঞান ও তথ্যের অনুসন্ধান। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা খাতে কোনও বরাদ্দ না রাখায় নতুন জ্ঞান কীভাবে তৈরি করবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মৌলিক কাজই হচ্ছে গবেষণা করা। গবেষণাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (প্রাথমিক-মাধ্যমিক-কলেজ) পার্থক্য। অথচ বিশ্বের মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণাকে প্রাধান্য দিলেও আমাদের এখানে এ চিত্র উল্টো।
আমাদের মোট শিক্ষাখাতের ব্যয় এখনও জিডিপির ২.০৮ শতাংশ। দেশে গবেষণা ও উন্নয়ন নামে কোনও খাত নেই। এ খাতে তাই কোনও বরাদ্দ নেই। অথচ বিশ্বের প্রায় ১২৫টি দেশে ‘উন্নয়ন ও গবেষণা’ নামে একটা আলাদা খাত আছে। এই খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। এমনকি এই তালিকায় নেপালও আছে। কিন্তু বাংলাদেশ নাই। একদিকে মৌলিক গবেষণায় অর্থের অভাব অন্যদিকে চাকরির অনিশ্চয়তার ফলে তরুণ প্রজন্ম মৌলিক গবেষণায় ক্রমে আগ্রহ হারাচ্ছে।
অথচ যেখানে একটু সহায়তা, অনুদান, বরাদ্দ, পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে, সেখানে গবেষণায়ও সাফল্য লক্ষ করা গেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিং (জীবের দেহে থাকা জিনগত সংকেতগুলোকে একের পর এক বিন্যস্ত করা/অনুসন্ধান করা) গবেষণাতে বাংলাদেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশি পাট ও তোষা পাটসহ একটি ক্ষতিকারক ছত্রাকের জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ইলিশ মাছের জিন নকশা বের করেছেন।
দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন)। এরপর বাংলাদেশে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করে। এসবই আমাদের দেশে গবেষণায় সাফল্যের গল্প। এ ধরনের গল্প রচনায় দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ ও সংকল্পের অভাব দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে।
সরকারি নীতির কারণেই আমাদের সমাজে গবেষণা, বিজ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান চিন্তা ক্রমেই কমছে। ব্যক্তিপর্যায়ে, সামাজিকভাবে কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, কোনও জায়গাতেই গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চা যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশের অগ্রগতি কিংবা অবনতি, দুই–ই দেশের গবেষণার অভিমুখের ওপর নির্ভর করে।
দেশের গবেষণার অভিমুখ তৈরি করে সরকারি নীতি। যে দল সরকার চালায় তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্রই নির্ধারণ করে সরকারি নীতি। স্থির হয় আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ, বিভিন্ন মৌলিক গবেষণার অভিমুখ।
হ্যাঁ, দেশের ভালো চাইলে সরকারকে এ ব্যাপারে নীতি বদলাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নিজেদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় একটু আত্মপোলব্ধির জায়গায় পৌঁছতে হবে। শুধু গ্র্যাজুয়েট বা এমএ পাশের একটা সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেওয়াই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হয়, তাহলে গবেষণা কোনোকালে প্রাধান্য পাবে না। জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান চর্চাও এগোবে না।
প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিয়ে আন্তর্জাতিক র্যাংকিং হবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তালিকার পাঁচশ, এক হাজার, দুই হাজার, পাঁচ হাজারেও থাকবে না।
কেউ যদি গলা বাড়িয়ে বলেন, আমরা তো ‘এই বেশ ভালো আছি’, তোমার এত মায়াকান্না কেন? তাহলে অবশ্য বলার কিছু থাকে না!
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট। ইমেইল: [email protected]