চার দশক আগে এটিঅ্যান্ডটি-কে ভেঙে সাতটি কোম্পানিতে রূপান্তরের পর ফের আরেকটি কোম্পানিকে ভাঙার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এবারের কোম্পানিটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী কোম্পানি গুগল।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কিছু ব্যবসা থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার জন্য গুগলকে বাধ্য করতে তারা আদালতে আবেদনের পরিকল্পনা করছেন। এক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হবে গুগলের ক্রোম ব্রাউজার ও অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং ব্যবস্থায়।
কর্মকর্তারা বলেন, এসব ব্যবসা অনলাইনে সার্চ বা কোনও তথ্য খুঁজে পাওয়ার কার্যক্রমে গুগলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজার যত কার্যক্রম চলে, তার ৯০ শতাংশ হয় গুগল সার্চ ব্যবহার করে।
গত মঙ্গলবার আদালতে দায়ের করা নথিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বলেছে, গুগলের অনুসন্ধান ব্যবসাকে অ্যান্ড্রয়েড, ক্রোম ও গুগল প্লে অ্যাপ স্টোর থেকে আলাদা করার সুপারিশ করা হতে পারে।
বিচার বিভাগের নথিতে বলা হয়েছে, “গুগলকে-কে ক্রোম, প্লে ও অ্যান্ড্রয়েডের মতো পণ্যগুলোকে গুগল অনুসন্ধান এবং গুগল অনুসন্ধান-সম্পর্কিত পণ্য এবং ফিচার সুবিধা যেমন এআই এর মতো উদীয়মান অনুসন্ধান অ্যাক্সেস পয়েন্ট ও ফিচারগুলো ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। গুগলের প্রতিদ্বন্দ্বী বা নতুনদেরকেও ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই এটা করা হবে।”
এর ফলে তথ্য খোঁজার কার্যক্রমে বড় ধরনের পরিবর্তন হবে এবং একই সঙ্গে গুগলের আয় কমার পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীরা এবং নতুনরাও তাদের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ পাবে।
তবে গুগল সরকারের সম্ভাব্য এই পরিকল্পনাকে র্যাডিক্যাল বা অতিবিপ্লবী বলে আখ্যায়িত করে বলেছে, এতে গ্রাহকরা আরও খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারে।
গুগল বলেছে, এটি অ্যান্ড্রয়েড এবং ক্রোমকে এমনভাবে ভাঙতে পারে, যার ফলে এআই উদ্ভাবন বাধাগ্রস্ত হবে। আর গুগলকে তার প্রতিযোগীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করতে বাধ্য করতে পারে, যার ফলে মানুষের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হবে।
কোম্পানিটি ব্লগ পোস্টে বলেছে, “মামলাটি অনুসন্ধান বিতরণ চুক্তির একটি সেট সম্পর্কে। অথচ সেদিকে ফোকাস করার পরিবর্তে, সরকার একটি ঝাটানো এজেন্ডা অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে, যা ভোক্তা, ব্যবসা এবং আমেরিকান প্রতিযোগিতার জন্য উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক ফলাফলসহ অসংখ্য শিল্প এবং পণ্যকে প্রভাবিত করবে।”
লেনদেনের ক্ষেত্রে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন আগে থেকেই স্থাপন করে রাখা কিংবা নতুন ডিভাইসে এটিকে ডিফল্ট হিসেবে রাখার যে ব্যবস্থা গুগল করে রেখেছে, তারও অবসান ঘটানোর আদেশ আসতে পারে। অ্যাপল বা অন্য যেসব কোম্পানি বিভিন্ন ডিভাইস তৈরি করে, গুগল ২০২১ সালে তাদের ২ হাজার ৬৩০ কোটি ডলার দিয়েছিল, যাতে স্মার্টফোন ও ব্রাউজারে গুগল সার্চ ইঞ্জিন আগেই স্থাপন করে রাখা হয়।
এ বিষয়ে একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলার রায়ে গত আগস্টে ফেডারেল বিচারক অমিত মেহতা বলেন, গুগল তার অনুসন্ধান ব্যবসায় যুক্তরাষ্ট্রের অ্যান্টি ট্রাস্ট আইন লঙ্ঘন করেছে। এই চুক্তিগুলো প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ নষ্ট করছে।
তিনি গুগলকে ‘একচেটিয়াবাদী’ বলেও অভিহিত করেছেন। এমন রায় দেওয়ার পরই বিচার বিভাগের এই সুপারিশ আসে।
আগস্টে গুগল বলেছিল, ওই রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করার পরিকল্পনা করেছে। তারা আদালতে যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, তাদের সার্চ ইঞ্জিন গ্রাহকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, কারণ এটি সেরা।
গুগলের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট কেন্ট ওয়াকার সেই সময়ে এক্স-এ এক পোস্টে বলেছিলেন, “যেহেতু প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে, আমরা এমন পণ্য তৈরির দিকে মনোনিবেশ করব, যা লোকেরা সহায়ক এবং ব্যবহারে সহজ বলে মনে করে।”
গত সোমবার আরেকটি মামলায় এক বিচারক রায় দিয়েছেন, গুগলকে অবশ্যই তার অ্যাপস্টোর গুগল প্লে-কে প্রতিযোগিতার জন্য খুলে দিতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী উৎস থেকে আসা অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ যাতে প্লে স্টোরে পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়া ওয়েবভিত্তিক বিজ্ঞাপন ব্যবসা ভেঙে দেওয়ার জন্যও গুগলকে চাপ দিচ্ছে বিচার বিভাগ।
গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেট বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কোম্পানি, যাদের বাজার মূলধনের পরিমাণ ২ লাখ কোটি ডলারের বেশি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতে গুগল তার আধিপত্য আরও বাড়াতে চায়। তবে বিচার বিভাগ বলছে, গুগল তার সাধারণ সার্চ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চ ব্যবস্থায় যেসব ইনডেক্স, তথ্য ও মডেল ব্যবহার করছে, সেগুলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের ব্যবহার করতে দিতে গুগলকে বাধ্য করা হবে।
একচেটিয়াত্ব কায়েম হতে পারে, এমন কোনও চুক্তি যাতে গুগল না করতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করার কথা ভাবছে বিচার বিভাগ।
তবে গুগল বলেছে, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা নিয়ে যেসব প্রস্তাব করা হচ্ছে, তা এই খাতকে স্থবির করে দিতে পারে। বিনিয়োগ টানাহেঁচড়া করে, প্রণোদনার বিকৃতি ঘটিয়ে আর নতুন ধরনের ব্যবসার মডেলের পায়ে বেড়ি পরিয়ে সরকার যদি এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে বড় ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যেখানে এ খাতে এখন বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা দরকার।
গুগলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ একটি বিস্তারিত প্রস্তাব ২০ নভেম্বরের মধ্যে আদালতে দাখিল করার কথা রয়েছে।
বিপরীতে যেসব বিষয়ে বিচার বিভাগের উদ্বেগ রয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে নিজস্ব প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য গুগল ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় পাবে।
বিচার বিভাগের সুপারিশের পর গুগল কী শাস্তির সম্মুখীন হবে তা নির্ধারণ করতে একটি পৃথক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গুগলের আবেদনসহ পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে কয়েক মাস বা এমনকি বছরও লাগতে পারে।
গুগলে শেষ পর্যন্ত যাই ঘটুক না কেন তা অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টদের বিরুদ্ধে চলমান অবিশ্বাসের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রতিকারের মঞ্চ তৈরি করতে পারে।
বিচার বিভাগের অ্যাটর্নিরাসহ ১৭টি রাজ্যের আনা একটি পৃথক মামলার মুখোমুখিও হয়েছে গুগল, যারা অভিযোগ করেছে, এর বিজ্ঞাপন ব্যবসা প্রতিযোগিতামূলক নয়।
অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটা ও টিকেটমাস্টারের বিরুদ্ধেও একচেটিয়া ব্যবসার অভিযোগ এনে মামলা করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন, রয়টার্স