দুর্ঘটনা বাড়ায় ঢাকায় ব্যাটারিচালিত তিন চাকার যান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও চালকদের বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।
নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ঢাকায় এই অটোরিকশা চালু রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যানসহ এই ধরনের থ্রি হুইলার চলাচল বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গত ১৮ মে (শনিবার) জারি করা বিজ্ঞপ্তির ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ঢাকার সড়কে রবিবার (১৯ মে) শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। প্রতিবাদ জানিয়ে কোথাও সড়ক অবরোধ করে এসব বাহনের চালকরা। কোথাও পুলিশ থ্রি হুইলার চলতে বাধা দেয়, আবার কোথাও নির্দ্বিধায় চলে অটোরিকশা।
বিজ্ঞপ্তিতে বিআরটিএ বলে, ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ব্যাটারি রিকশা বা ভ্যান বা এ ধরনের থ্রি-হুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অবস্থায় ঢাকা মহানগরীতে এসব মোটরযান চালানো বন্ধ করার অনুরোধ করা যাচ্ছে। নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।
গত ১৫ মে বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৭-এর অধীনে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ব্যাটারিচালিত কোনও গাড়ি ঢাকা সিটিতে আর চলবে না।
এরপরই ১৮ মে জারি করা হয় ওই বিজ্ঞপ্তি; ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে তৎপর হয়ে ওঠে পুলিশ।
প্রতিবাদে ১৯ মে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু করে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। সেদিন মিরপুরে দিনভর সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, বাস ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটে।
এসব ঘটনায় পল্লবী, কাফরুল ও মিরপুর মডেল থানায় চারটি মামলা হয়েছে। সেসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ৭০০ জনকে; গ্রেপ্তার হয়েছে ৪২ জন।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতিকরাও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের ওই সিদ্ধান্তের সামালোচনা করেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সোমবার এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের ওপর সরকার ‘স্টিম রোলার’ চালাচ্ছে।
তবে সোমবারই এক অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ঢাকা সিটিতে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়ি চলাচলের অনুমতি দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে, সড়কে তিন চাকার এ ধরনের যান দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও দেওয়া হচ্ছে এর পরিসংখ্যান।
কিন্তু এ খাতে যেহেতু সরকারের রাজস্ব আদায়ের সুযোগ আছে এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের যাতায়াতেও সুবিধা মেলে, তাই অনেকেই এ ধরনের যান বন্ধের বিরোধিতাও করে আসছেন।
এবার যখন এসব যান বন্ধের কথা উঠল, তখন সোশাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন পর্যায়ে এ সিদ্ধান্তের তুমুল সমালোচনা হয়।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে দেশজুড়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা চলছে, তখন সকাল সন্ধ্যা এ নিয়ে কথা বলেছে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে।
তাদের অভিমত, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর জন্য একটি নকশা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাড়াতে এর নকশার সংস্কার প্রয়োজন। নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সংশোধন করার পাশাপশি চলাচলেও শৃঙ্খলা আনতে হবে।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ও বিভাগীয় প্রধান (দ্বিতীয় শিফট) প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ব্যটারিচালিত অটোরিকশার ব্রেকিং সিস্টেমের দুর্বলতার সমাধানে বেশি জোর দিয়েছেন।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এসব অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো এর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এর গতির তুলনায় ব্রেকিং সিস্টেম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া এসব অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির জীবনকাল খুব বেশি নয়।
“অর্থাৎ ব্যাটারিগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া সেসব ব্যাটারি কীভাবে ধ্বংস করা হয়, কেউ জানি না। এসব ব্যাটারি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।”
এসব রিকশার গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রসঙ্গ টেনে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর বলেন, “আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যাটারিচালিত রিকশার নকশা অন্যান্য পায়ে টানা সাধারণ রিকশার মতোই। সমস্যা হচ্ছে সাধারণ রিকশার ডিজাইন দ্রুত গতিতে চলার উপযোগী নয়। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো হচ্ছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে অনেক সময়।
“এসব বাহন দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে যায় অনেক সময়; বেশি গতির কারণে বাঁক নেওয়ার সময়ও উল্টে যেতে পারে। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে ব্রেক কষে থামতে না পারার কারণে অন্য গাড়ি বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের দেশে প্রায় ৩০ ধরনের অটোরিকশা চলে। সেগুলোর কোনোটি ৩ জন যাত্রী পরিবহন করে, কোনোটিতে আবার ৮ জন যাত্রীও নেওয়া হয়।
“কিন্তু এসব অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।”
‘ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ব্রেকিং সিস্টেম’ এমন অভিমত হাদিউজ্জামানেরও।
বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, “সাইকেলে বা রিকশাতে আমরা যে ব্রেক দেখি তা হলো ‘ইউ’ ব্রেক। এই ব্রেকে চাকার দুই পাশে দুটি ব্রেক প্যাড থাকে, যা রিমকে চাপ দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম, ভেজা চাকায় এই ব্রেক খুবই কম কাজ করে।”
সাইকেল কিংবা পায়ে টানা রিকশার ইউ ব্রেক ঠিক আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশাতেও এই ব্রেকই ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এসব রিকশার কাঠামো ও চাকা অনেক দুর্বল, দ্রুত গতিতে চলাচলের উপযোগী নয়।”
তবে দুর্ঘটনার কারণ দেখিয়ে এসব রিকশা একেবারে বন্ধ করা আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন বুয়েটের এই শিক্ষক। এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, “২০০৯-২০১০ সাল থেকে এরা (ব্যাটারিচালিত রিকশা) নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সড়কে নেমেছে। বাড়তে বাড়তে এদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে সঠিক সংখ্যা কেউই বলতে পারে না। সারাদেশে ব্যটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কেউ বলেন ২০ লাখ, কেউবা দাবি করেন ৫০ লাখ। তাই এখন এর সঙ্গে বিশাল একটি জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার বিষয় জড়িয়ে গেছে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ করলে অনেকেই পথে বসে যেতে পারেন।
“এছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে দেখা দিয়েছে যাত্রীদের কাছে। হুট করে এসব বন্ধ করলে যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন যাত্রীরা। এসব রিকশা বন্ধের সুযোগ নিয়ে অন্য পরিবহনগুলো ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারে। তাতে মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়বে। সেজন্য আমি বলব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ নয়, নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি।”
হাদিউজ্জামান বলেন, “বর্তমানে একটি অটোরিকশা তৈরি করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর সঙ্গে আর ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ বাড়ালেই রিকশাগুলোকে নিরাপদ করা সম্ভব। এর ব্রেকিং সিস্টেম ও কাঠামোগত দুর্বলতার সমস্যার সমাধান করে সেগুলোকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া উচিত।
“তবে কোনোভাবেই এসব রিকশা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কে চলাচলের পক্ষে নই আমি। এসব রিকশা মহল্লার ভেতরের সড়কে, কিংবা পার্শ্ব সড়কে চলতেই পারে।”
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার অনুমোদন না থাকলেও সারাদেশেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনুমোদনহীন হওয়ায় এটিকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। যেহেতু বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না, সেহেতু এর দুর্বলতা দূর করে চলাচলের অনুমোদন দেওয়া উচিত। এতে চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে, সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।”