ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। দীর্ঘ এই জীবনে ভারতের পুরনো রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি।
ভারতের বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার হয়েছিল তার হাত ধরেই। দেশটিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বৃহস্পতিবার হঠাৎ করেই নিজ বাসায় অজ্ঞান হয়ে যান বর্ষীয়ান এই নেতা। পরে তাকে নয়া দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বার্ধক্যজনিত জটিলতায় চিকিৎসারত অবস্থাতেই ওই হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
তার মৃত্যুতে ভারতের দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন স্তরের মানুষ শোক প্রকাশ করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু ব্যক্তিত্বও এতে সামিল হন।
ভারতের হাতে গোনা কয়েকজন রাজনীতিকের মধ্যে তিনি একজন, যিনি কোনও প্রকার তর্ক-বিতর্ক ও কেলেঙ্কারির বাইরে সাদাসিদে জীবন যাপন করে গেছেন।
দরিদ্র পরিবারের জন্ম নেওয়া মনমোহন সিং সততা ও বিনয় দিয়ে অগুনতি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রিসভার কয়েকজনের দুর্নীতির কারণে তার ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তার বিরুদ্ধে কখনও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি।
নরম স্বভাব ও শান্ত মনের মনমোহন প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে আগ্রহী ছিলেন না। এজন্য অনেকেই তাকে ‘অনিচ্ছুক শাসক’ বলে অভিহিত করেন। ২০০৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস দলকে বিজয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার পর সোনিয়া গান্ধী নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদ না নিয়ে মনমোহন সিংকে বসান। সেই থেকে দুই মেয়াদে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ইতালিতে জন্ম নেওয়া সোনিয়া গান্ধী তার বিদেশি পরিচয়ের কারণে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিরোধিতার মুখে ভারতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর তিনি মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। সিং তখন ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন।
১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের একটি বিদ্যুৎবিহীন কৃষিপ্রধান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনমোহন সিং। বর্তমানে গ্রামটি পাকিস্তানে অবস্থিত। তিনি দরিদ্র পরিবারে নয় ভাইবোনের সঙ্গে বড় হন। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি চন্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেন। পরে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭০-এর দশকে মনমোহন সিং ভারত সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন এবং প্রধানমন্ত্রীর নিয়মিত পরামর্শক হয়ে ওঠেন।
মনমোহন সিং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতেও কাজ করেছেন। তিনি সেখানে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত পরিচালক এবং ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত গভর্নর ছিলেন।
১৯৭১ সালে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। এখান থেকেই সরকারের সঙ্গে তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার শুরু হয়।
দুই দশক পর ১৯৯১ সালে মনমোহন সিং দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন ভারত অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে ছিল। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই কম ছিল যে, তা দিয়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রয়োজনীয় আমদানির ব্যয় মেটানো সম্ভব হতো।
অর্থমন্ত্রী হয়ে তিনি রুপির অবমূল্যায়ন, কর কমানো, সরকারি খাতের শিল্প বেসরকারিকরণ এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা দেন। এসব সংস্কার দেশের অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুরু হয়। তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দেশের অন্তর্মুখী অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করার জন্য সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সরকারি মালিকানাধীন অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারিকরণ করেন এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উদ্যোগী হন। এসব সংস্কার ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এতে ভারতে আজ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে উন্নীত হয়েছে।
তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন এবং ১৯৯১ সালে রাজ্যসভায় যোগ দেন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভায় বিরোধদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০০৪ সালের নির্বাচনের বিজয়ী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (ইউপিএ) সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি।
এরপর তিনি রাজ্যসভায় পুনরায় যোগ দেন এবং ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। এ বছরের এপ্রিলে অবসর নেন মনমোহন সিং।
প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর থেকেই মনমোহন সিং প্রায় সাধারণ জীবন যাপন শুরু করেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মনমোহন সিং বলেছিলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছেন।
“আমি বিশ্বাস করি, বর্তমান মিডিয়া বা সংসদের বিরোধী দলগুলোর চেয়ে ইতিহাস আমার প্রতি অধিক সদয় হবে।”
মনমোহন সিং স্ত্রী এবং তিন মেয়ে রেখে গেছেন।
তথ্যসূত্র : সিএনএন, এনডিটিভি