সদ্যপ্রয়াত শিল্পী মনি কিশোরের মরদেহ এখনো হিমঘরে। হিমঘরের শুনসান নির্জনতার মতোই জীবনের শেষদিকে প্রচণ্ড একাকিত্বে ভুগছিলেন। বিয়ের সময় মনি কিশোর সনাতন থেকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। একমাত্র কন্যা নিন্তি বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি থেকে গিয়েছিলেন দেশেই। গান থেকেও দূরে ছিলেন তিনি। সঙ্গীতের সহকর্মীদের সঙ্গেও বাড়ছিল দূরত্ব।
রাজধানীর রামপুরায় বিটিভি ভবনের পাশেই একটি বাড়িতে একাকী জীবনযাপন ছিল তার। জীবন সায়াহ্নে কাজ হারিয়ে একাকিত্বে ভুগে অনেক শিল্পীকেই বিষণ্ণতায় ভুগতে হয়। সম্প্রতি কবি ও নির্মাতা তারেক মাহমুদের মৃত্যুতে শিল্পীদের একাকিত্ব ও পেশাগত জীবনের অসহায়ত্ব ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি সকলকেই নাড়া দিয়েছিল।
মনি কিশোরের মৃত্যুতে বিষয়টি আবার সকলের মনে নাড়া দিয়েছে। সঙ্গীতাঙ্গনের অনেকেই শোক জানিয়েছেন এ শিল্পীর মৃত্যুতে। তার জনপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ ফের বাজছে শোকাতুর শ্রোতাদের মনে। সিনেমার পর্দায় যার অভিনয়ে গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায় তিনি চিত্রনায়ক ওমর সানি।
উত্তম আকাশ পরিচালিত ‘কে অপরাধী’ সিনেমাতে গানটি ব্যবহৃত হয়। সালমান শাহ-শাবনূর জুটির চলচ্চিত্র হলেও ১৯৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটিতে নায়কের পরিবর্তন ঘটেছিল। সালমান শাহ’র অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ছবিটিতে যুক্ত হন ওমর সানি। তাতেও ছবিটি দারুণ সফল হয়। চলচ্চিত্রটি সফল হওয়ার পেছনে মনি কিশোরের গানটিরও ভূমিকা ছিল। গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন ওমর সানি।
গানটির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়েও গড়িয়েছিল ওমর সানির সঙ্গে মনি কিশোরের সম্পর্ক। শিল্পীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে তিনি ফেইসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, “মনি কিশোর আমার বন্ধু ছিল। তার কয়েকটা গান আমার সাথে মিশে একাকার হয়েছিল। সব সময় ফোন দিত, সব সময় রাগ করে বলতাম- এত রাগ অভিমান ভালো না, গান কর। ও আমাকে বলতো শুধুই তোমার জন্য গান করব। বন্ধু চলে গেলা ফাঁকি দিয়ে। কী ছিলে আমার বলো না তুমি, আছি তো আগেরই মতো এখনো আমি।”
মনি কিশোরের একাকী নির্জন মৃত্যু তাই নাড়া দিয়েছে প্লে ব্যাকের আরেক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী কনক চাঁপাকেও। রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে দীর্ঘদিন গানে না থাকা এই শিল্পী মন দিয়েছিলেন রান্নার একটি চ্যানেলে।
সোমবার এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, “ইদানিং বেশিরভাগ শ্রোতাই বলেন আমার রান্নার চ্যানেল তারা অনেক পছন্দ করেন। আমার ভয়ের জায়গা তারা না শেষে আবার আমার কণ্ঠশ্রমিক পরিচয় ভুলে যায়! গান ছাপিয়ে রাঁধুনি পরিচয় আপাতত মানা মনের গহীন কোণে একটা ধাক্কা যেন।”
মনি কিশোরের প্রসঙ্গ টেনে কনক চাঁপা লিখেছেন, “আজ আমার মনের ভেতরের মন পুরোটা সময় কাঁদছিল সদ্যপ্রয়াত মনি কিশোর ভাইয়ের জন্য। কতটা একাকী হয়ে পড়েছিলেন জানাই হয়নি! আমরা আসলে নিজেদের নিয়ে খুবই বিজি!”
শিল্পীদের পারষ্পরিক যোগাযোগ ও আড্ডার জন্য কনক চাঁপা প্রয়োজন অনুভব করেছেন শিল্পীদের একটি ক্লাব গঠনের।
“আমাদের একটা ক্লাব দরকার যা এ যাবৎ কালের জোরালো দাবি, কিন্তু কখনো গড়া হয়নি। কেউ দায়িত্ব নেয়নি, কেউ না! একটা বসার জায়গা থাকলে আমাদের এভাবে একলা হতে হয়? বলেন? আমাদের মূল্যায়ন কবে হবে! আমি জানিনা।”
রাজধানীর প্রেসক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানেও মনি কিশোরের কথাই মনে বেজেছে এ শিল্পীর।
“আজ আমি হাসিমুখে গাচ্ছিলাম ঠিকই কিন্তু এই কথাগুলোর সাথে যন্ত্রণা দিচ্ছিল- ‘কী ছিলে আমার বলোনা তুমি’ গানটি। উপর উপর এইসব রঙ্গমঞ্চের হাসিমুখের অন্তরালে দইয়ের সরের ভেতরের মতো জমাট কান্নার খবর রাখে কজন!”
শনিবার রাত ১০টার দিকে নিজ বাসায় মৃত পাওয়া যায় মনি কিশোরকে। প্রাথমিক ময়নাতদন্তে অস্বাভাবিক কিছু পায়নি পুলিশ। তবে, শিল্পীর মরদেহ সৎকার হবে নাকি দাফন, তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্ত আসেনি।
তবে, মৃত্যুর আগে তার কন্যা নিন্তিকে বলে গিয়েছিলেন মৃত্যু পরবর্তী করণীয় কী হবে। কন্যা নিন্তি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত থাকায় উপস্থিত থাকতে পারছেন না এ কাজে। তবে, পরিবারের অন্যরা বিষয়টি তদারকি করছেন বলে জানা গেছে।
জীবদ্দশায় প্রায় পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মনি কিশোর। বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। তার জনপ্রিয় অন্যান্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’।