খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে কোনো নারী মূর্তির গায়ে জড়ানো সেলাই ছাড়া এক খণ্ড কাপড় কি আজকের শাড়ির ইতিহাস লেখা শুরু করেছিল?
উত্তর নিয়ে মতভেদ হতে পারে। যেমন বিতর্ক আছে ‘শাটী’ আদৌ শাড়ির উৎপত্তি-শব্দ কি না তা নিয়ে। তবে আর্য ভাষায় ‘সাটক’ আর ‘সাটিকা’ শাড়িরই প্রতিশব্দ ছিল।
ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যবেত্তা ড. নীহাররঞ্জন রায় রচিত ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব গ্রন্থের বরাতে বলা যায়, পুরুষের যা ধূতি ছিল নারীর তাই শাড়ি হয়ে ওঠে।
শাড়ির পরার ধরনে যুগে যুগে বদল ঘটেছে। তেমনি লেগেছে রঙের ছোঁয়া।
চৌদ্দ শতকে চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলিতে আছে স্নানরতা রাধাকে দেখে কৃষ্ণ বলছে, চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরাণ সহিত মোর।
শাড়ির ইতিহাসে রঙের সঙ্গে বয়নে কারুকাজেও এসেছে বিবর্তন। সুতি, জামদানি, রেশমী, কাতান, বালুচুরি, বেনারসি শাড়ির নানা রঙের কারুকাজে নারী সেজে উঠেছে নিত্য। এশীয় সমাজে বাঙালি থেকে অবাঙালি নারীও নানা ঢঙে নানা রঙের শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে।
অধুনা উৎসবের সাজে হরেক পোশাকের চল হলেও শাড়ি পরার রেওয়াজ তাই টিকে আছে সদর্পে। পশ্চিমের ছোঁয়া এশীয় সমাজে যতই লাগুক না কেন, লাল বেনারসিতে বউ সাজার আবেদনে ভাটা পড়েনি এক রত্তি।
বিয়েতে লাল শাড়িই কেন?
পশ্চিমে গির্জায় আয়োজিত বিয়েতে বরের কালো স্যুটের বিপরীতে কনে বেছে নেয় সাদা রঙের গাউন। এদিকে বাংলা ভূখণ্ডের অজপাড়া গাঁয়ের বিয়েতে কম দামি শাড়ি হলেও কনের গায়ে চাই টকটকে লাল শাড়ি।
কেন বিয়ের শাড়ির রঙ লাল তা হয়ত অনেক কনেই জানে না। যুগ যুগ ধরে এই প্রথা বিশেষ করে বাঙালিদের মাঝে এতটাই পোক্ত যে, কনের গায়ে লাল শাড়ি না হলে মুরুব্বীরা মনঃক্ষুণ্ণ হন; আর অভ্যাগতরা হতাশ হয়ে ভাবেন এ আবার কেমন বিয়ে?
লাল আসলে শুভ রঙ। লাল হলো শক্তি ও বিপ্লবের প্রতীক। আবার লাল রঙ হলো ভালোবাসা ও যৌবনের প্রতীক। বিয়ে বাড়িতে কনের উপরের সব আলো থাকে এবং সবার নজর থাকে। লাল রঙে কনেকে তাই সবার মাঝে উজ্জ্বল দেখায়।
বিয়েতে শাড়ির আরও যত রঙ
গায়ে হলুদ নামকরণের সঙ্গে মিল রেখে গ্রাম থেকে শহরে এই অনুষ্ঠানে হলুদ রঙের শাড়ি পরার চল দীর্ঘকালের। যদিও মাঝেমধ্যে এতেও রুচি বদলের ছোঁয়া লাগে। তাই কনের জন্য কেউ মেরুন রঙ বেছে নেয়, কেউ কচি ধানের মতো সবুজ; এমনকি গোলাপী শাড়িও।
বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে লাল শাড়ি পরা হবে বলে এর আগে বাগদানের অনুষ্ঠানে হালকা সাজের সঙ্গে যে কোনো কোমনীয় রঙ কিংবা সোনালী রঙের শাড়ি বেছে নেয়া হয়। আর বিয়ের পর বৌভাত অনুষ্ঠান ঝলমল হয়ে ওঠে সোনালী, আকাশী, রানি গোলাপী, অথবা কমলা রঙের শাড়িতে।
বলিউড সিনেমার প্রভাবে বাঙালি সমাজে বিয়েতে কনের শাড়ির রঙে লাল ছাড়াও ভিন্নতা চোখে পড়ছে অনেক দিন ধরেই। আবার বলিউড তারকাদের বিয়েতে লেগেছে পশ্চিমের রঙ।
এখন ‘জিরো-মেকআপ লুক’ বেশ মাতিয়ে রেখেছে সবাইকে। এমন হালকা সাজের সঙ্গে শাড়ির রঙও হালকা বেছে নিচ্ছে কনে।
আলিয়া ভাট এবং রণবীর কাপুরের বিয়ের পোশাকে লালের কোনো ছোঁয়াই ছিল না। ফ্যাশন জগতের সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় এই যুগলের জন্য অরগ্যাঞ্জা ফেব্রিকে আইভরি রঙের পোশাক বানিয়েছিলেন। সাত পাকে কনে পরেছিল আইভরি রঙের শাড়ি, ব্লাউজ, ওড়না এবং বরের গায়ে ছিল আইভরি রঙের শেরওয়ানি। লালহীন হলেও বি-টাউনের এই জনপ্রিয় তারকা বর-কনে সবার কাছে ‘রয়্যাল লুক’ হয়ে ধরা দেন।
বিয়েতে বলিউডের লেহেঙ্গা
বলিউডের অনেক সিনেমার পুরোটা জুড়ে থাকে বিয়েবাড়ি। নব্বই দশকে বলিউডের হিট সিনেমার হিট গানের তালে তালে লেহেঙ্গার দিকে নজর পড়ে সবার। আর তখন থেকে দেশীয় বিয়েতে শাড়ির বদলে কনের গায়ে ওঠে লেহেঙ্গা।
এখন মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে যে কোনো শাড়ির দোকানে কিংবা রাজধানীর অভিজাত পাড়ায় পোশাকের কোনো বড় ব্র্যান্ডের আউটলেটে গেলে রাজকীয় কারুকাজে ভারী লেহেঙ্গা মিলবেই।
তসর, মসলিন, নেট, জর্জেট, কাতান কাপড়ে পুঁতি, জরি, স্টোন, মিরর ওয়ার্ক, পার্ল, ক্রিস্টাল ওয়ার্ক, থ্রিডি মেটারিয়াল কারুকাজে লেহেঙ্গা চলছে সারা বছরই। সাধারণ লেহেঙ্গা পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। আবার বিয়ের জন্য ঘন কাজের ওজনদার লেহেঙ্গার দাম পড়বে ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা।
কোনো কোনো ব্র্যান্ড পাঁচ লাখ থেকে আট লাখ টাকা দামের লেহেঙ্গাও তুলছে আউটলেটে।
কনের গায়ে কাঞ্চিপুরম
খাঁটি তুঁত সিল্ক দিয়ে তামিলনাড়ুর কাঞ্চিপুরম অঞ্চলের তাঁতিরা বোনেন কাঞ্চিপুরম শাড়ি। অনেকে বলেন কাঞ্জিভরম শাড়ি।ভারতীয় এই শাড়ি গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনে উদ্যোক্তরা যেমন বিক্রি করছেন তেমনি নিউ মার্কেট, গাউছিয়া থেকে বেনারসি পল্লীতেও দেদারসে মিলছে এই শাড়ি।
ভারত থেকে দেশে আসা কাঞ্চিপুরম শাড়ির দামের সঙ্গে মানেও আছে ভিন্নতা। পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা মূল্যে কেনা যাবে এই শাড়ি। অনেকেই বলেন, মাখনের মতো মোলায়েম বলে এই শাড়ি পরে থাকা আরামদায়ক।
দক্ষিণ ভারতে বিয়ের কনে মানেই কাঞ্জিভরম শাড়ি। বর-কনের স্বজনরাও এই শাড়ি পরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই যেমন পুত্র অনন্ত আম্বানির প্রাক-বিবাহ অনুষ্ঠানের শেষ দিনে কাঞ্চিপুরম শাড়ি পরেছিলেন মা নীতা আম্বানি। দক্ষিণ ভারতের তাঁতিদের বোনা এই শাড়িতে জারদৌসি নকশা করেন ফ্যাশনিস্তা মানিশ মালহোত্রা।
বাংলাদেশে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে কনের গায়ে কাঞ্চিপুরম এখনও কম দেখা গেলেও নতুন কনের সংগ্রহে এখন এই শাড়ি থাকছেই। বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসা বন্ধু-স্বজনদেরও কাঞ্চিপুরম পরা চাই আজকাল।
গায়ে হলুদের শাড়ি
গায়ে হলুদে তাজা ফুল দিয়ে সাজার চল ছিল কয়েক বছর আগেও। এখন শুকনো ফুলের গহনা কিনতে পাওয়া যায়। আবার ইমিটেশনের গহনাও পরছেন অনেকে। গহনার সাজের সঙ্গে শাড়িতেও এসেছে ভিন্নতা। মুখে আর হাতে হলুদ লাগানো হবে বলে উজ্জ্বল হলদে টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি আগে পরা হলেও এখন হলুদে জামদানি, সিল্ক, বালুচুরি, হ্যান্ড পেইন্ট হাফ সিল্ক বেছে নিচ্ছেন অনেকে।
সামাজিক মাধ্যমে শর্টস-রিল জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন হলুদের শাড়িতে বাজেটও বেড়েছে।
তবে নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, হকার্স মার্কেটে শাড়ির দোকানে হ্যান্ড পেইন্ট করা শাড়ি কেনা যাবে পাঁচশ টাকার মধ্যেও। আজকাল হলুদে কনের বোন-বান্ধবীরা একই রকম শাড়িতে সাজেন; এর সঙ্গে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পরেন ছেলেরাও। একের বেশি নিলে সাতশ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যেই এমন ‘কাপল সেট’ কেনা যাবে।
জামদানির জৌলুস
পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আর অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা বিয়ে করেন ২০১০ সালে। তখনও দেশে অন্য যে কোনো রঙ হলেও সাদা শাড়িতে দেখা যেত না বিয়ের কনেকে।
তিশার শাড়িতে ছিল দুটো চমক। এক, অফ হোয়াইট জমিনের শাড়িতে ছিল সাদা ও গোলাপী কারুকাজ; শাড়ির পারে ছিল সোনালি জরির লেস। দুই, বিয়েতে পড়ার জন্য তিশা বেছে নিয়েছিলেন জামদানি শাড়ি।
এর ছয় বছরের মাথায় অর্থাৎ ২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। এরপর তারকা থেকে সাধারণ তরুণীদের মাঝে নিজেকে জামদানি শাড়িতে জড়ানোর আগ্রহ ক্রমশ বাড়তে থাকে।
২০২৩ সালে লাল জামদানি পরা বিয়ের ছবি ফেইসবুকে প্রকাশ করে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যান অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ। শাড়ির সঙ্গে ছিল জামদানির ওড়নাও। জানা যায়, তাসনিয়া ফারিণের ওই জামদানি শাড়ি বুননে সময় লেগেছিল প্রায় বছরখানেক।
এর আগের বছর বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম। গায়ে হলুদে খোলা চুল, সাদা গহনার সঙ্গে হলুদ জামদানি শাড়িতে আরও কমনীয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
মিহি কারুকাজের ছয় গজের জামদানি শাড়ি বুনতে তিন থেকে চার মাস লেগে যায়। তাঁতিকে প্রতিদিন প্রায় ১৪ ঘণ্টা সময় দিতে হয় শাড়ি বুননে। মেশিনে বোনা জামদানি খসখসে হয়ে থাকে; অন্যদিকে হাতে বোনা জামদানি শাড়ি হয় মোলায়েম ও মসৃণ।
মসলিনের উত্তরসূরী জামদানি শাড়ির দাম নির্ভর করছে সুতার কাউন্টের উপর। বেশি কাউন্টের সুতা হলে দামও বেশি হবে। সাধারণত ৩২ থেকে ২৫০ কাউন্টের সুতা দিয়ে জামদানি বোনা যায়। বেশি কাউন্ট বা চিকন সুতা দিয়ে বুনতে সময় বেশি লেগে যায়।
কোনো কোনো দেশীয় ফ্যাশন হাউজ এক লাখ থেকে চার লাখের জামদানিও করে থাকে। তবে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যেও জামদানি শাড়ি কেনা যায়। আবার বিয়ের কনের জন্য ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যেও কারুকাজ করা জামদানি শাড়ি মিলবে।
বিয়ে মানে বেনারসি
সাতকাহন উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার বলেছেন, “ভালবাসা হল বেনারসি শাড়ির মত, ন্যাপথালিন দিয়ে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতে হয়, তাকে আটপৌরে ব্যবহার করলেই সব শেষ।”
বেনারসি বুননের ইতিহাস মুঘল আমলের। আর শাড়ির নাম এসেছে ভারতের উত্তরপ্রদেশে বরুণা ও অসী নদীর মিলন শহর বারাণাসী বা বানারস থেকে।
এই শহরের মুসলমান তাঁতিরা আরব থেকে এসেছিলেন। আবার এমনও বলা হয়, চীনের তিন ভাই থেকে ‘তাঞ্চই’ বেনারসি শাড়ির বুনন পদ্ধতি এই শহরে পৌঁছে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় শতাধিক মুসলমান তাঁতি পুরান ঢাকা ও মিরপুরে চলে আসে। বেনারস শহর থেকে ঢাকা পর্যন্ত চলে আসা এই শাড়ি বিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যায় নিবিড় ভাবে; নারীর কাছে ভালোবাসার মধুর পরিণতি হয়ে ওঠে এই বেনারসি শাড়ি।
জারদোসি কাজে এমব্রয়ডারি করা কাতানের পাড় দেয়া সিঁদুর লাল রঙের বেনারসি খাদি শাড়িতে ২০২৪ সালের শুরুতে বিয়ের পর্ব সেরেছিলেন অভিনেত্রী মৌসুমী হামিদ।
এই বছরের মাঝামাঝিতে বিয়ে করেন ভারতীয় অভিনেত্রী সোনাক্ষী সিনহা। সকালে আইনি মতে বিয়েতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাদা রঙের শাড়ি, যা তার মা পুনম সিনহার। সন্ধ্যায় রিসেপশন আয়োজনে হাতে আলতা, কপালে লাল টিপের সঙ্গে পরেছিলেন চাঁদ বুটি কারুকাজে লাল বেনারসি। তারকা হওয়ার পরও শাড়ির জন্য লাখ লাখ টাকা খরচা করেননি সোনাক্ষী; ৮০ হাজার রুপির মধ্যেই বেছে নিয়েছিলেন নিজের বিয়ের বেনারসি শাড়ি।
বেনারসি পল্লীতে সকাল সন্ধ্যা
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরের বেনারসি পল্লী যাত্রা শুরু করে ১৯০৫ সালে। একশ বছরেরও বেশি পুরনো এই শাড়ির স্বর্গভূমিতে এখন ঝলমল করে একাধিক দোকান।
বেনারসি পল্লীর এক গলিতে শাড়ি সাগর পরিচালনা করেন সৈয়দ এরশাদ ইমাম।
তাদের ‘জন্মের আগে থেকে বাবা এই প্রতিষ্ঠান শুরু করেন’ বলে জানালেন তিনি সকাল সন্ধ্যাকে।
৪৫ বছরের এই ব্যবসা নিয়ে এরশাদ বলেন, “বাবা সৈয়দ খুরশিদ ইমাম তাঁতি ছিলেন। মিরপুর ১১ নম্বরে আমাদের নিজস্ব তাঁত ছিল।”
কিন্তু দিনে দিনে তাঁতিদের দশা পড়তির দিকে জানিয়ে ইমাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের দেশীয় তাঁতের উপরে কোনো গভর্নমেন্ট গুরুত্ব করেনি। যার কারণে আমাদের দেশীয় তাঁতগুলো ধ্বংস হয়েছে।
“যারা শ্রমিক-কারিগর ছিল সবাই এখন সবজি বেচে, রিকশা চালায়। কারণ তাদের শ্রম অনুযায়ী মজুরি পোষায় না।”
শাড়ির দামে কম-বেশি নিয়ে তিনি বলেন, “এখানে রেশম নেই, সুতা নেই, টানা নেই, বানা নেই। সব চায়না হয়ে, ইন্ডিয়া হয়ে বাংলাদেশে বিজনেস করে।
“কাতান তৈরি হয়, কিন্তু সেটার সুতাও তো বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসতেছে। দেশে তো সুঁই বানানোর মেশিনও নাই। যার কারণে পণ্যের মূল্য দাঁড়ায় বেশি, যেটা কাস্টমারের বাজেটের বাইরে।”
“হ্যান্ডলুমের মূল্য একটু বেশি হয়। মেশিনে যেগুলো তৈরি … পাওয়ারলুম… সেগুলোর প্রাইস কম হয়।”
“এখন বেনারসি পল্লীর ৮০-৯০% বিক্রি হয় ইন্ডিয়ান পণ্য। দেশীয় পণ্য খুব রেয়ার। যেমন ঢাকাই জামদানি। আস্তে আস্তে ঢাকাই জামদানিও শেষের পর্যায়ে। অলরেডি শেষ বলতে গেলে। ইন্ডিয়ান জামদানি ঢুকে গেছে। প্রাইস কম, সেটাকে ঢাকাই জামদানি বলে বেচে। দেখতে ঢাকাই জামদানির মতই লাগে। কাস্টমারের বাজেটের মধ্যে; তিন হাজার কি সাড়ে তিন হাজার বললে প্যাকেট করে।”
“অথচ একটা ঢাকাই জামদানি কিনতে গেলে মিনিমাম পাঁচ হাজার টাকার বেশি বাজেট করতে হবে; তাহলেই একটা রুচিসম্মত জামদানি নিতে পারবে কাস্টমার।”
বিয়ের কনের জন্য কেনাকাটায় শাড়ির দোকানে এসে কী খোঁজে সবাই?
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে এরশাদ ইমাম বলেন, “এখন আরও কিছু ব্রাইডাল আইটেম ঢুকে গেছে। সিল্ক, অরগাঞ্জা ফেব্রিক, জর্জেট ম্যাটেরিয়াল আসছে। এগুলো সব ইন্ডিয়ান পণ্য।
“১৫ বছর আগে যাদের বিয়ে হলো তারা জর্জেটের উপরে পুঁতি কাজ করা পরেছে। এখন জর্জেটের উপরে ক্রিস্টাল স্টোনের কাজ চলে এসেছে। রিসেপশনে বর স্যুট পরে, বউ লেহেঙ্গা।
“অনেকে আবার রিসেপশনের জন্য পার্টিওয়্যার শাড়ি নিতে চায়, যেগুলো একটু প্রিমিয়াম কোয়ালিটি, লাক্সারিয়াস কোয়ালিটির হয়। অনেকে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির গাদোয়াল কেনে, অনেকে কাঞ্চিপুরম কেনে। কাঞ্চিপুরম বলতে ১৫শ, দুই-তিন হাজার টাকা দামের না; একেকটা কাঞ্চিপুরম ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার।”
“অনেকে গাউন পরে রিসেপশনে। এগুলোও ইন্ডিয়ান পণ্য। গাউনের স্টার্টিং প্রাইস হয় ৪০ হাজারের বেশি।”
তবে চাহিদার তুলনায় দোকানে গাউন কম রাখা হয় বলেও জানা গেল শাড়ি সাগর থেকে।
“কারণ একটা গাউন দেখালেই তো ক্রেতা পছন্দ করবেন না। আমাকে মিনিমাম ৩০টা গাউন দেখাতে হবে। এখন যদি একটা গাউন ৩০ হাজার করে হয় তাহলে নয় লাখ টাকা ওখানেই ইনভেস্ট করতে হলো। দেখা গেলো দোকানে ১০০টা গাউন তুলতে হলো; এটা (দোকানি-ব্যবসায়ীদের জন্য) হিউজ ইনভেস্টমেন্ট।”
বিয়ের কনের জন্য লেহেঙ্গা কেমন চলছে?
“অনেকে লেহেঙ্গা নিতে চায় রিসেপশনের জন্য। দোপাট্টা-ওড়নাসহ লেহেঙ্গা আমাদের এখানে চার হাজার থেকে শুরু আছে। ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা দামেরও লেহেঙ্গা আছে। লেহেঙ্গা লাখ-দেড় লাখও হয়।”
তবে যত রকম শাড়ি ও লেহেঙ্গাই আসুক বেনারসি ফিরে ফিরে আসে।
বেনারসি শাড়ি মানে ’আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য’, বললেন এরশাদ ইমাম।
“বেনারসি ছিল, আছে এবং আজীবন থাকবে। ৮০% মানুষের বিয়ের প্রথম শাড়ি হিসাবে চয়েজ করে বেনারসি শাড়ি।”
“একটা বর যখন শেরওয়ানি পরে, তখন বউকে শাড়িতেই মানায়। আজ থেকে ২০-৫০ বছর আগে যাদের বিয়ে হলো তারা পাঁচ থেকে সাত কেজি ওজনের বেনারসি পরেছে। এখন বেনারসি হাফ কেজিও হবে না ওজনে; স্টোনের কাজ বাদে। আমাদের এখানে বেনারসি মিনিমাম তিন হাজার টাকা। পিওর কোয়ালিটি নিতে গেলে ২৫ হাজার টাকার বেশি বাজেটে যেতে হবে … প্রিমিয়াম কোয়ালিটি।”
এক লাখ টাকার বেনারসি কেমন হয়?
এই দামের বেনারসি নিয়ে সকাল সন্ধ্যার কথায় সায় জানাতে রাজি হলেন না এরশাদ ইমাম।
তিনি বলেন, “এক লাখ টাকার বেনারসি নাই। এটা শুধু ফাও কথা। এখন কিছু ব্র্যান্ড দোকানে যেমন নেয়, যেটা এখানে দুই হাজার পড়বে সেটা ওখানে ২০ হাজার টাকা নেবে। এক লাখ টাকার যে বেনারসি ওটার মধ্যে কি হীরা লাগায় দেবে?”
তারকাদের বিয়েতে জামদানি শাড়ি পরার চল কতটুকু প্রভাব ফেলছে কেনাবেচায়?
“আমি ডেমরা, রূপগঞ্জেও গিয়েছি। ওখানে আমি কথা বললাম তাঁতিদের সঙ্গে। ওরা বলল, একটা সময় ছিল ফ্যাক্টরির জন্য ৫০ লাখ অ্যাডভান্সও হয়েছে। আর এখন ওই কলকারখানা পরিত্যক্ত হয়ে আছে,” এরশাদ ইমাম বলেন।
“যারা সেলেব্রিটি, তাদের বেলায় পাঁচ হাজার টাকার শাড়িও ৫০ হাজার টাকা হয়ে যায়। কোনো নারী যখন জামদানি নিজের বিয়েতে পরতে চায় তা কিন্তু একটা সৌখিন ব্যাপার। তারমানে জামদানি ওরকম মনের মতো হতে হবে। অনেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়। অনেকে যারা শুধুমাত্র জামদানি শাড়িরই বিজনেস করে সেখান থেকে কেনে।
“একটা জামদানি ৩০ হাজার, ৩৫ হাজার, ৪০ হাজারও হয়। কেউ ৩০ হাজার টাকা ইনভেস্ট করলে তাতে মিনিমাম পাঁচ হাজার টাকা প্রফিট করবেই,” জানালেন শাড়ি সাগর এর কর্ণধার।
কাতান শাড়ি এখন কেমন চলে?
”কাতানে দোলা সিল্ক আছে, জর্জেট সিল্ক আছে, খাড্ডি সিল্ক আছে, মাইসুর আছে। তানা বানা মাঝখানে বার হয়েছিল। ম্যাক্সিমাম ইন্ডিয়ান। দেশীয় হিট কালেকশনের মধ্যে আছে টাঙ্গাইলের হাফ সিল্ক জামদানি ডিজাইনে। সেল ভালো চলছে।”
বিয়েতে সুতি শাড়ির কদর কম কেন?
“সুতি হয় পাকা রঙ। পাকা রঙ অলওয়েজ ম্যাট হয়। গ্লসি হয় না, চকচক করে না। যেটা সিল্ক হয়, সেটাই চকচক করে। সুতির সাথে যদি সিল্ক মিক্স হয় … হাফ সিল্ক … তখন ওটা গ্লেজি হয়। একটা বউকে তো ম্যাট শাড়ি দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে বউ হাফসিল্ক পরতে পারে।
“তবে মুরুব্বীরা তো সুতি ছাড়া পরে না। সেই সুতি শাড়ি হয়তো ১৫শ, দুই হাজার টাকা দাম; সাত হাজার টাকারও সুতি আছে। ”
কয়েক যুগের শাড়ির ব্যবসায় বিয়ের শাড়ির রঙে কেমন বৈচিত্র্য দেখা গেছে ক্রেতাদের চাহিদায়?
নিজের দোকানে সাজিয়ে রাখা হরেক রঙের শাড়ির বহর দেখিয়ে তিনি বলেন, “বিয়ের দিন মানে হলো ডার্ক কালার; যেমন মেরুন। রিসেপশন মিনস লাইট কালার। কে কোন রঙ কিনবে এটা যার যার রুচি কিংবা কনফিডেন্সের উপর।
“অনেকে বিয়ের প্রথম শাড়ি লাল নিলো। বউভাতের শাড়িও বেনারসি কিনছে; কেউ ওয়াইন কালার কিনছে, কেউ পারপল কিনছে। এখন একজন নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত তো ওই লেভেল পর্যন্ত যেতে পারবে না চিন্তায়; ওই বাজেট, ওই লাইফ লিড তো করে নাই। যার লাইফ লিড যেভাবে সে সেভাবেই পছন্দ করে।”
বাংলাদেশে শীতের মৌসুমে বিয়ের ধুম পড়ে যায়। যে কারণে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের আগে সবার কেনাকাটার ব্যস্ততা থাকে।
এখন বিয়ের মৌসুমে শাড়ি কেনাবেচা কেমন চলে?
সকাল সন্ধ্যার কাছে বিয়ের বাজারের ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে সৈয়দ এরশাদ ইমাম বললেন, “করোনার পর থেকে আমাদের এখন সিজনাল যে বিজনেস ছিল ওটা নেই। এখন আমাদের বারো মাসই ব্যবসা।
“কারণ করোনার পর থেকে বিয়ের সিসটেমটাও চেঞ্জ হয়ে গেছে। আগে ডিসেম্বরেই হতো ধুমায়া ধুমায়া। এখন শর্টকাটেই অনেকে কাজ সেরে ফেলছে।”
“সর্বপ্রথম হলো বাজেটে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিয়ের কেনাকাটা মানে হলো আপাদমস্তক … নানি, দাদি, চাচির জন্য গিফট-এটা সেটা। আগে তো বিয়ের কেনাকাটা বলতে গেলে মিনিমাম এক লাখ টাকা বিল।”
“আর এখন বিয়ের কেনাকাটা মানে বউয়ের একটা শাড়ি হলেই হলো। বাজেটটা কোথায় নেমে এসেছে। মধ্যবিত্তের কাছে তো টাকা নেই। যখন সবার কাছে ছিটানো টাকা থাকবে তখনই তো ব্যবসা হবে।”