আওয়ামী লীগের শাসনকালে যেভাবে বিরোধী দলের কোনও বৈঠকে হানা দিয়ে ‘গোপন সভা করে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র’র অভিযোগ গ্রেপ্তার করত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; অনেকটা সেভাবেই কক্সবাজারে একটি হোটেলে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের এক সভায় হানা দিয়ে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ।
শুক্রবার মধ্যরাতে শহরের কলাতলী সড়কের হোটেল মোটেল জোনের ইউনি রিসোর্টের পঞ্চম তলার বলরুমে বৈঠকরত অবস্থায় তাদের আটকের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরাও ছিলেন।
পুলিশ ইউপি সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনে সেখানে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। সেখানে কয়েকজন সাংবাদিককে মারধর এবং ক্যামেরা ভাংচুরও করা হয়।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের সব চেয়ারম্যান এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার সব মেয়রদের বরখাস্ত করে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বরখাস্ত করা না হলেও অনুপস্থিত চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে কাজ চালিয়ে যেতেও প্যানেল চেয়ারম্যান কিংবা সরকারি কর্মকর্তাদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
দেড় দশকের আওয়ামী লীগের শাসনকালে স্থানীয় সরকারের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় ছিল এই দলটির নেতারা। সরকার পতনের পর তাদের অনেকেই রয়েছেন পালিয়ে।
এরমধ্যেই বাংলাদেশ ইউনিয়ন সদস্য সংস্থার (বাইসস) কক্সবাজার জেলা শাখার আয়োজনে শুক্রবার রাতে ইউনি রিসোর্টে সভা ডাকা হয়েছিল।
রাত ১২টার দিকে সেখান থেকে ১৯ জনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তারপর চারজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ১৫ জন ইউপি সদস্যকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয় আদালতে। সেখান থেকে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কেন গ্রেপ্তার?
ইউপি সদস্যদের ওই সভায় হানা দেওয়ার বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ফয়জুল আজিম নোমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আওয়ামী লীগ সমর্থিত ইউপি সদস্যরা ইউনি রিসোর্টে গোপন বৈঠক করছে– এমন তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান পরিচলনা করা হয়।”
প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কারও কাছ থেকে এই বৈঠকের অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ওই রিসোর্ট ঘিরে ফেলে পুলিশ অভিযান চালায়। সেখান থেকে ১৯ জনকে ধরে প্রিজনভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।
ওসি নোমান বলেন, “আটক ইউপি সদস্যরা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির নেতা। তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বিরোধিতাসহ বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।”
থানায় জিজ্ঞাসাবাদের পর যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেই ১৫ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শনিবার বিকালে আদালতে পাঠানো হয় বলে জানান তিনি।
বাকি চারজনকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ না থাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়।”
ওই হোটেলে যাওয়ার বিষয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলমগীর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, শহরের একটি আবাসিক হোটেলে ‘গোপন বৈঠক’ থেকে আওয়ামী লীগের ‘কিছু অপরাধী নেতা’ আটকের খবরে তিনিসহ কয়েকজন ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তবে কিছু সংখ্যক কর্মী আগেই পৌঁছেছিল।
সভার উদ্দেশ্য কী ছিল?
বাইসসের কক্সবাজার জেলা শাখার পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইউনি রিসোর্টের সম্মেলন কক্ষে ‘রাষ্ট্র সংস্কার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্থানীয় উন্নয়নে তৃণমূল জনপ্রতিনিধিদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা ডাকা হয়েছিল।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো. গফুর উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন এই সভার প্রধান আয়োজন। সভায় তিনিই সভাপতিত্ব করেন। তিনি এলাকায় বিএনপি নেতা হিসাবেই পরিচিত।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার ৫ শতাধিক ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যান এই সভায় অংশ নিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় সভা শেষ হওয়ার পর অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি সেখান থেকে চলে গেলেও কক্সবাজার জেলার কিছু সংখ্যক ইউপি সদস্য অবস্থান করছিলেন।
ইউপি চেয়ারম্যান গফুর বলেন, “সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু সংখ্যক কর্মী আকস্মিক হোটেল ঘেরাও করে। তিন ঘণ্টা পর ১৯ জনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।”
পুলিশ ধরে নেওয়ার সময় টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জহির আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, তাদের আলোচনার সময় পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা অতর্কিতভাবে ঢুকে পড়ে এবং তাদের আটক করে।
“দেশের ক্রান্তিকালে কীভাবে কাজ করা যায়, সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশ ও সমন্বয়ক ঢুকে আমাদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে এবং আটক করে।”
গোপন বৈঠকের অভিযোগ নিয়ে এই ইউপি সদস্য বলেন, “আমাদের যদি গোপন হতো, তাহলে সড়কের পাশে হোটেলে এতবড় অনুষ্ঠান হতো না।”
সাংবাদিকদের ওপর হামলা
হোটেল থেকে ইউপি সদস্যদের আটকের খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে হামলার মুখে পড়েন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের অভিযোগ, পুলিশের সামনেই সাংবাদিকদের মারধর ও ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি।
মোহনা টিভির জেলা প্রতিনিধি আমানুল হক বাবুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয়দানকারী একদল তরুণ-তরুণী প্রথমে সাংবাদিকদের হোটেলের সম্মেলন কক্ষে যেতে বাধা দেয়।
“তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে সাংবাদিকদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে। পরে তারা সাংবাদিকদের কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে আহত করে। ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভাংচুরের চেষ্টা চালায়।”
আহত সংবাদকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ক্যামেরাম্যান সাদেক হোসেন খোকা, স্থানীয় অনলাইন পোর্টাল সিসিএন’র সংবাদকর্মী মিশু দাশগুপ্ত ও টিটিএন’র সংবাদকর্মী আয়াছুল সিফাত।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলমগীর।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হোটেলটির সম্মেলন কক্ষের ভেতরে পুলিশ আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করায় ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেন। এনিয়ে সাংবাদিকদের সাথে আমাদের কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে মাত্র।”
কাউকে মারধর করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ‘সামান্য ধস্তাধস্তির ঘটনা’ ঘটেছিল।