আদালতের এক রায়ের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছিল আওয়ামী লীগ, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবার আদালতই নির্বাচনকালীন এই সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে রায় দিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতার প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষে মঙ্গলবার এই রায় দেয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ নাগরিকের করা রিট আবেদনে রুল জারির পর ১১ কার্যদিবস শুনানি নিয়ে উচ্চ আদালতের এই রায় হলো।
এক যুগ আগে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে চলমান পরিস্থিতির উদ্ভব বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
যে সঙ্কটের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন ক্ষমতায়।
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি। তারপর তিনটি নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই হয়েছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়।
তার এক মাস আগেই সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল।
আপিল বিভাগের ওই রায়ের ভিত্তিতেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন করার কথা জানিয়েছিল তখনকার ক্ষমতাসীনরা।
কিন্তু এরপর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে যে তিনটি নির্বাচন হয়, তার সবগুলো নিয়েই ওঠে প্রশ্ন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত না এলে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও মত দেয় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ১৩ দিন পর গত ১৮ আগস্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট আবেদন করেন বদিউল আলম মজুমদাররা।
পরদিন ১৯ আগস্ট আদালত রুল দেয়। সেই রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
পরে এ রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসাবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণফোরাম ছাড়াও বেশ কয়েকজন ব্যক্তি যুক্ত হন। রুলের ওপর ৩০ অক্টোবর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ কার্যদিবস শুনানি হয়।
এতে রিট আবেদনকারী সুজনের বদিউল আলমের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন, বিএনপির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, রুহুল কুদ্দুস কাজল শুনানি করেন।
অন্যদিকে জামায়াতের পক্ষে রুলের ওপর শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী ছাড়াও অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থার পক্ষে একাধিক আনইজীবী শুনানিতে অংশ নেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষসহ অন্যান্য দলের পক্ষের আইনজীবীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দেন।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বুকে ‘কুঠারাঘাত’ করেছে বলে শুনানিতে মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়।