সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতায় আঠারো বছরের জয়ধ্বনি শুনেছে সবাই; ‘বিরাট দুঃসাহসেরা উঁকি দেয়’ এই বয়সেই। অনেক কিছুর ভার নেওয়ার সময় হয় এই বয়সেই, বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স এই ১৮ বছর।
১৮ বছর বয়স বাংলাদেশে নতুন করে আলোচনায় উঠল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এক কথায়। তিনি বলেছেন, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর হওয়া উচিৎ।
তরুণদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনায় আসা ড. ইউনূস শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে এই মত প্রকাশের পাশাপাশি তার যুক্তিও হাজির করেছেন।
তিনি বলেছেন, “তরুণরা যেহেতু সংখ্যায় বেশি এবং দেশের ভরিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহী, তাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের মতামত নিতে আমি মনে করি, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর হওয়া উচিৎ।
“আমি তরুণদের তাড়াতাড়ি ভোটার করার পক্ষে। যে যত তরুণ, পরিবর্তনের প্রতি তার আগ্রহ তত বেশি-এই হলো আমার যুক্তি।”
অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা যখন নতুন দল গঠনে উদ্যোগী, তখন ড. ইউনূসের এই প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্য থেকে এসেছে প্রতিক্রিয়া।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শনিবার বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্য নির্বাচন কমিশনের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি করবে।
তিনি বলেন, “ইউ আর দ্য চিফ এক্সিকিউটিভ, আপনি প্রথমেই বলে দিচ্ছেন যে, ১৭ বছর হলে ভালো। আপনি যখন বলছেন, তখন দ্যাট বিকামস বাইন্ডিং অন ন দ্য ইলেকশন কমিশন, যেটা ইলেকশন কমিশন ঠিক করবে। এই বিষয়টা ইলেকশন কমিশনকে ছেড়ে দিন।”
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচিত হবে। আর ভোটার হওয়ার যোগ্যতা ১৮ বছর।
আবার দেশের শিশু আইনে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সীদের শিশু ধরা হয়। শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী এই আইন প্রণীত হয়। শিশুরা কোনও অপরাধে জড়িয়ে পড়লে দেশের প্রচলিত কারাগারে না নিয়ে নেওয়া হয় কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। তাদের বিচারও হয় প্রচলিত আদালতের বাইরে অন্য আদালতে।
কারণ ১৮ বছরের আগে কোনও মানুষের মানসিক গঠন পরিপূর্ণ হয় না, বলছেন মনোবিজ্ঞানীরা।
প্রধান উপদেষ্টা মত জানানোর পর এই বয়সের গুরুত্ব বুঝতে সকাল সন্ধ্যা কথা বলেছে একজন মনোবিজ্ঞানী ও একজন মনোচিকিৎসকের। তারা দুজনে কথা বললেও নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
তাদের একজন বলেন, মানসিক বিকাশ নিয়ে ১৮ বছর বয়সের গুরুত্ব জাতিসংঘ সংস্থা ইউনিসেফ বিশদভাবে বলেছে। এখন ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করাই যায়, তবে তা প্রশ্ন তৈরি করবে। কারণ অন্য আইনে তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক হিসাবে ধরা হচ্ছে না। আবার যেহেতু আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা আছে, সেই আইন বদলাতে গেলে আবার নতুন করে জটিলতা দেখা দেবে।
প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার বয়স ১৮ বছর ধরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর। তবে কিছু কিছু দেশে ১৭ বছরও রয়েছে, আবার ২১ বছরও রয়েছে দুই-একটি দেশে।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা যেটা বলেছেন, সেটা পুরোপুরি খারাপও বলেননি। তবে মনে রাখতে হবে, আমরা অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছি। এসব কিছুতে তখন পরিবর্তন আনতে হবে। নয়তো এগুলো নিয়ে কথাবার্তা উঠবে।
“তবে তার আগে এই পরিবর্তন কীসের জন্য করা হবে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় ১৮ বছরের কাছাকাছি সময়।”
নানা দেশে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ বছর কম থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, মানসিক গঠন সম্পূর্ণ হওয়ার বিষয়টি পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপরও নির্ভর করে।
“যদি চারপাশ, পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র পজিটিভ হয়, ইতিবাচক হয়, তাহলে তার সিদ্ধান্ত নেওবার সক্ষমতা তৈরি হয়।”
তবে বাংলাদেশে ১৮ বছরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কতটুকু তৈরি হয়, সে বিষয়ে একটি গবেষণা করা িদরকার বলে মত দেন তিনি।
১৭ থেকে ১৮ বছর ‘খুব দূরের কোনও পথ না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ভোটার হওয়ার বয়স কমানো যেতেই পারে, তবে তা যেন আন্তর্জাতিক সনদগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিংবা বিতর্ক তৈরি না করে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা উচিৎ।
ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ থেকে কমাতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। সংবিধান সংস্কারের উদ্যোগ এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজের মত জানালেও বলেছেন, ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৭ বছর করার ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সবাই একমত হলেই কেবল তা করা যায়।
ভোটার হওয়া বয়স ১৭ বছর করলে তাতে কোনও সমস্যা দেখছেন না সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কিছুদিন আগে ভোটার হওয়ার বয়স ছিল ২১ বছর, সেখান থেকে কমিয়ে আনা হয় ১৮ বছরে। যদি সরকার চায়, অসুবিধার কোনও কারণ দেখি না।
“তবে এটা তো সংবিধানের বিষয়। বয়স পরিবর্তন করতে গেল অনেক কিছু করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। সবচেয়ে বড় কথা সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। তাই এটা খুব একটা সহজ হবে না।”
তবে এক্ষেত্রে আরেকটি জটিলতার কথা তুলে ধরেন কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন ইসিতে দায়িত্ব পালন করে আসা রফিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ভোটার তালিকা প্রতি বছর হালনাগাদ হয়, কিন্তু ১৭ বছর করতে গেলে ভোটার তালিকা সংশোধন না, নতুন করে তালিকা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে খুব কষ্টকর হবে, আমার ধারণা সেটা সেটা সম্ভব হবে না।”
বাংলাদেশে ভোটার এখন ১২ লাখের বেশি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে হালনাগাদে ভোটার বেড়েছিল ২১ লাখের মতো। ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
আগামী দেড় বছরের মধ্যে ত্রয়োদশ সংশোধন নির্বাচন আয়োজনের আভাস এরই মধ্যে দিয়েছেন ড. ইউনূস।
“সরকার থেকে যে সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে নতুন করে তালিকা তৈরি করা খুব একটা সহজ হবে না। কারণ এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত,” বলেন রফিকুল।