Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রাম আদালতের দুই হাজার নথি গায়েব, বিচারে কী প্রভাব  

SS-ctg-court-document-060125
[publishpress_authors_box]

চট্টগ্রাম আদালত ভবনের তৃতীয়তলায় মহানগরের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কার্যালয়ের সামনে থেকে প্রায় দুই হাজার নথির হদিস মিলছে না; সেখানে ২০০২-২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন হত্যা, সন্ত্রাস, মাদক, চোরাচালান ও বিস্ফোরক মামলার নথি ছিল বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

সুরক্ষিত এলাকা থেকে কীভাবে এতগুলো নথি গায়েব হলো—তার হিসাবে কোনোভাবেই মিলছে না। এই ঘটনার পর আদালতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আদালতের অবকাশকালীন সময়ে ১৩-৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নথিগুলো গায়েব করা হয়েছে বলে মামলার জিডিতে উল্লেখ করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর পিপি মফিজুল হক ভুঁইয়া।

২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে নথিগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পিপি কার্যালয়ের দরজার বাইরে পলিথিন বস্তায় মোড়ানো ছিল; ফলে যারা নথি গায়েব করেছেন, তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

আদালত যখন বন্ধ ছিল, তখন নথিগুলো গায়েব করে ফেলাটা খুব সহজ ছিল—এমনই ইঙ্গিত পিপির জিডিতে রয়েছে। 

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে চট্টগ্রামে অনেকগুলো থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ছিল বিপুল পরিমাণ নথিপত্র, মামলার প্রমাণসহ কাগজপত্র।

তখন অভিযোগ উঠেছিল- নথি গায়েবের সুযোগে শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, হত্যা মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে অনেকেই জামিনে খালাস পেয়েছেন।

এখন দুই হাজার নথির হদিস না মেলায় আরও অনেক অপরাধীর জামিনে বের হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলো—এমনই আশঙ্কা করছেন আইনজীবীদের অনেকে। 

যদিও যার কার্যালয়ের সামনে থেকে নথি গায়েব হয়েছে, সেই পিপি মফিজুল হক ভূঁইয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেগুলো চুরি হয়েছে, সেগুলো মূল কপি নয়। তার একটি কপি আদালতের সেরেস্তাদারের কাছে জমা আছে। গায়েব হওয়া নথিগুলো তারই একটি কপি। ফলে শুনানিতে সেটি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

“আমি জেনেছি, সেই নথিগুলো ২০১৫ সালের আগের মামলার। অবকাশকালীন ছুটি শেষে যখন আমরা আদালতে আসলাম, তখনই বিষয়টি নজরে আসে। এরপর আমি জিডি করি।”

তবে পিপির বক্তব্যে সন্তুষ্ট নন আইনজীবীদের অনেকে। তারা বলছে, আসামিদের সংঘবদ্ধ চক্র শুনানি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই এমনটি করেছে। এটা জঘন্যকাজ। আদালতে যখন শুনানি হবে, তখন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শুনানির পক্ষে আগের রেফারেন্স আদালতে উপস্থাপন করতে গেলেই বোঝা যাবে কতটা ক্ষতি হয়েছে। আর এত মামলার নথি গায়েবের পর আদালতের নিরাপত্তা কতটা সুরক্ষিত, সেটিও প্রশ্ন।

চট্টগ্রাম আদালতের এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোনও বড় ঘটনা ঘটলে কিছুই হয়নি এমন ভাব আমাদের আছে। পিপির বক্তব্যের মাধ্যমে আমরা আবারও সেটি দেখলাম। এখন তাদের উচিত দুই হাজার নথি গায়েবের তালিকা করে সেই নথিতে কতগুলো চাঞ্চল্যকর মামলা, শীর্ষ সন্ত্রাসী অভিযুক্ত আছেন সেটি খতিয়ে দেখা। এবং সেটি প্রকাশ করা।”

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, “কেস ডকেট হচ্ছে মামলার শুনানির ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জেনেছি গায়েব হওয়া নথিগুলোতে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলা আছে। আদালত প্রাঙ্গণের মতো এমন স্পর্শকাতর জায়গার নিরাপত্তার এমন শৈথিল্যভাব এই চুরির মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে।

“তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন হলে নতুন কর্মকর্তাও একই সিডিতে বিবরণ লেখেন। সে অনুযায়ী আদালতে সাক্ষ্য দেন। সিডি থাকলে ৫ থেকে ১০ বছর পরও সাক্ষ্য দিতে সুবিধা হয়। নইলে মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।”   

নথিগুলো গায়েব করল কারা

গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যখন অবকাশকালীন ছুটি ছিল তখন আদালত ভবনের বিভিন্ন স্থানে রঙ করার কাজ চলছিল। ফলে তাদের কেউ এই চুরি করে থাকতে পারে বলে আইনজীবীদের অনেকে মনে করছেন। তারা বলছেন, কোনও রঙ মিস্ত্রি যদি ভুলবশত এটি করেন, তাহলে তো সেগুলো ফেরত পাওয়ার কথা নয়; না ফেরাই প্রমাণ করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র এই কাজ করেছে।  

১৩-৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে চুরির ঘটনা ঘটেছে; সেটি জানা যায় আদালত ১ জানুয়ারি খোলার পর। কিন্তু মহানগর পিপি জিডি করেছেন ৫ জানুয়ারি বিকালে।

জিডি করতে এতদিন সময় লাগলো কেন—এ প্রশ্নের জবাবে পিপি বলেন, “হারানোর পর আমি খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু কোথাও না পেয়ে বাধ্য হয়ে জিডি করেছি। জিডি করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব কপি নিয়ে যাতে কেউ মামলার শুনানিতে গুজামিল করতে না পারে।”

আবার ঘটনাটি ঘটেছে আদালত ভবনের তৃতীয় তলায়; সেখানে কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো নেই। তবে নীচতলা-দ্বিতীয় তলায় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। ফলে নথি যারা গায়েব করেছেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্তের সুযোগ কম। সে কারণে জিডির পর সোমবার তদন্ত করতে গিয়ে ভিডিও ফুটেজ পায়নি পুলিশ।

পুলিশের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথি এভাবে উম্মুক্ত স্থানে রাখাটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আর তৃতীয় তলায় সিসি ক্যামেরা নেই। ফলে আমরা ফুটেজ পাইনি। এখন সেই ভবন থেকে নেমে যাওয়ার সময় কোনও ফুটেজ মেলে কিনা, তার খোঁজে আছি।

“আদালত বন্ধ থাকলেও নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী আছে। পুলিশ টিম থাকে। ভিডিও ফুটেজ না পাওয়ায় আসলেই কারা এই গায়েবের কাজটি করল, সেটি উদঘাটন করতে বেশ সময় লাগবে।”

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ক্রাইম) রইচ উদ্দিন বলেন, “এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট কক্ষের ভিতরে না রেখে বারান্দায় বাইরে রাখলেন, সেটি আমার কাছে বড় প্রশ্ন। এখন তারা কেন করলেন এতে কোনও গাফলতি আছে কি না, তদন্তে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে।”

গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথিগুলো এতদিন কেন বারান্দায় ছিল—এ প্রশ্নের জবাবে মফিজুল হক ভুঁইয়া বলেন, “আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। নথিগুলো রাখার জন্য কক্ষ পাওয়া যাচ্ছে না। কক্ষ চাওয়া হয়েছিল। আমার কক্ষটি নথিতে ঠাসা হয়ে আছে।”  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত