বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটায় সময় যখন মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা, তখনও অপেক্ষা ৬ ঘণ্টার, শুরু হবে ২০২৫ সাল, সবাই মাতবে উদযাপনে। ততক্ষণে কিরিবাতিতে খ্রিস্টীয় নতুন বছর উদযাপন শুরু হয়ে গেছে।
পৃথিবীর আহ্নিক গতি সবার আগেই বর্ষবরণের উৎসব শুরুর সুযোগ পায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি। এরপর একে একে নিউ জিল্যান্ড, জাপানে শুরু হয়ে যাবে নতুন বছর বরণের উৎসব। আলোর ফোয়ারা ছুটবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অপেরা হাউজে।
ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের পর বাংলাদেশও মাতবে বর্ষবরণে; এরপর এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকায় নামবে উদযাপনের ঘটা। শেষ বেলায় উৎসবে যোগ দেবে প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা দ্বীপপুঞ্জগুলো।
যুদ্ধ, আর অর্থনীতির অস্বস্তির ২০২৪ সাল কাটিয়ে ২০২৫ সাল অন্য রকম হবে, এই আশাই ধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে উদযাপনে।
ইউক্রেইন যুদ্ধের সঙ্গে গাজা যুদ্ধ চলার মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৩ সাল; আশা ছিল পরিস্থিতির উন্নতির। কিন্তু তা ঘটেনি, বরং যুদ্ধ আরও বিস্তৃত হয়েছে। গাজা যুদ্ধ ছড়িয়েছে লেবাননে, ইরান আর ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় যুদ্ধের শঙ্কা ছড়িয়েছে।
এই যুদ্ধের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ভোগাচ্ছে সারাবিশ্বের মানুষকেই ভোগাচ্ছে; আর তার ফল হিসাবেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল ঘটল বলে মনে করা হচ্ছে। ডেমোক্রেটদের শাসন পাঁচ বছর দেখার পর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য খ্যাত আগের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফিরিয়ে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রবাসী।
২০২৪ সালকে বলাই হচ্ছিল ভোটের বছর। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়াসহ ৮০টি দেশে বছরজুড়ে নির্বাচন হয়েছে। তাতে অনেক দেশেই ক্ষমতাসীনদের বিদায় নিতে হয়েছে। আবার নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রেখেও শেষ রক্ষা হয়নি কোনও কোনও রাষ্ট্রনায়কের।
বাংলাদেশেও হয়েছিল নির্বাচন, বছরের একেবারে শুরুতেই। বিরোধীদলবিহীন সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন দেড় দশকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু তার সাত মাসের মধ্য অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানে বিদায় নিতে হয় তাকে। শুধু প্রধানমন্ত্রীর পদই ছাড়েননি তিনি, দেশও ছাড়তে হয় তাকে। বছরের শেষে এসে তার মতোই বিদায় নিতে হয়ে সিরিয়ার ২৪ বছরের শাসক বাশার আল আসাদকে।
ছাত্র-জনতার সেই অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাহলো রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি কি একই রকমভাবে চলবে? নাকি তা বদলে দেওয়া হবে? রক্তাক্ত এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর।
সাত মাস আগে যে শহীদ মিনার থেকে শেখ হাসিনাকে হটানোর এক দফা দাবি তুলেছিলেন তারা, বছরের শেষ দিনে সেখানেই সমাবেশ থেকে তারা দেশের নতুন শাসনতন্ত্র রচনার দাবি তুলেছে, সেজন্য আহ্বান জানিয়েছে গণপরিষদ গঠনের।
এই সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, “আমরা অভ্যুত্থানে ঘোষণা দিয়েছিলাম, নতুন বন্দোবস্ত চাই।”
এই অভ্যুত্থানের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও তারুণ্যের স্বপ্নের সহচর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
খ্রিস্টীয় নতুন বছরের বাণীতে তিনি বলেছেন, “নতুন বছরের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির নতুন শিখরে আরোহণে অঙ্গীকারবদ্ধ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
“আমরা দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করব এবং যেকোনো সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করব।”
রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিনও অভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বছরে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা দেখার কথা জানিয়েছেন তার বাণীতে।
“জুলাই’র গণ-অভ্যুত্থানের আত্মত্যাগ, আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার পথ ধরে বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাক নতুন বছরে, এ প্রত্যাশা করি।”
“আমি আশা করি, নতুন বছরে আমরা দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন এক সমাজ, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক মানবিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী এক ‘নতুন বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে সঠিক পথের দিশা পাব,” বলেছেন তিনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও আশা প্রকাশ করেছেন, নতুন বছরে বাংলাদেশ সামগ্রিক রূপান্তরের একটি পর্বে উপনীত হতে পারবে।
বিদায়ী বছর স্মরণ করে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি বলেছেন, “গেল বছরটি এখন আমাদের মনে জাগরুক হয়ে থাকবে। গত বৎসরের বেশকিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা, ছাত্র-জনতার আত্মদান এবং অধিকার হারানোর যন্ত্রণা আগামী বৎসরে আমাদের একদিকে যেমন বেদনার্ত করবে আবার অন্যদিকে নতুন উদ্যমে শান্তি, সম্প্রীতি ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের অধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনায় আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে।”