মাগুরায় ধর্ষণের পর হত্যাচেষ্টার শিকার আট বছরের মেয়েটির সব ছবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনলাইন থেকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
৩০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার তদন্ত শেষ করে আইনে নির্ধারিত ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশও দিয়েছে আদালত।
রবিবার এক রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ বেশকিছু নির্দেশনাও দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হামিদুল মিজবাহ ও ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন রিট আবেদনটি করেন। তারাই রিটের পক্ষে শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তানিম খান।
ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন এর আগে শিশুটির প্রতি নির্মমতার ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনলে স্ব-প্রণোদিত হয়ে অবিলম্বে মেয়েটির সব ছবি অনলাইন থেকে অপসারণের নির্দেশ দেয় হাই কোর্টের একই বেঞ্চ। বিটিআরসিকে ওই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
ব্যারিস্টার মাহসিব হোসাইন শিশুটির স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জিও জানান। পরে আদালত লিখিত আবেদন জানাতে বললে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হামিদুল মিজবাহকে সঙ্গে নিয়ে রিট আবেদনটি করেন তিনি।
আদেশের বিষয়ে ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন বলেন, গণমাধ্যমসহ অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশুটির যেসব ছবি, ভিডিও ও নাম প্রচার হয়েছে, সেগুলো অপসারণ করতে বলা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে (সাইবার পুলিশ) এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
তিনি জানান, নির্ধারিত সময়ে নির্দেশ বাস্তবায়ন না করলে সরকারের এই দুই সংস্থার পাশাপাশি যারা যারা শিশুটির ছবি ও নাম প্রচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আদালত বলেছে।
ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন জানান, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুইজন সমাজসেবা কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশও দিয়েছে আদালত। তাদের একজন মাগুরায় এবং অপরজন ঢাকায়। তারা শিশুটি ও তার ১৪ বছরের বিবাহিত বোনকে দেখাশোনা, স্বাস্থ্য, কল্যাণ, নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের সামাজিক অবস্থা যেন কোনোভাবে সঙ্কটে না পড়ে, সেই অবস্থা নিশ্চিত করবেন।
হাই কোর্ট এছাড়া উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে রিটকারী এই আইনজীবী বলেন, কমিটিকে একটি গাইডলাইন তৈরি করতে বলা হয়েছে; যাতে সারা দেশে নারীর প্রতি যে সহিংসতা হচ্ছে, সেই সহিংসতা দমন ও ভিটটিমদের সহায়তা করা যায়।
আগামী ১৭ মার্চ মামলার পরবর্তী তারিখ রাখা হয়েছে জানিয়ে ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন বলেন, “ওই দিন মামলাটি আদালতের কার্যতালিকায় আসবে। সেদিন বিবাদীদের এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন আদালত।”
হাই কোর্টের স্ব-প্রণোদিত ওই আদেশের বিষয়ে ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত এ বিষয়ে শিশুটির ছবিগুলো অপসারণের জন্য প্রাথমিকভাবে আদেশ দিয়েছেন। আজকেই (রবিবার) বিস্তারিত আদেশের জন্য রাখা হয়েছে।”
পুলিশ ও ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির পাশে তাকে রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পরিবারের সদস্যরা প্রথমে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সেখান থেকে শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে শুক্রবার রাত ৯টা থেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসার জন্য শনিবার বিকালে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতাল থেকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) পাঠানো হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার বিকালে শিশুটির মা বাদী হয়ে চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, ভগ্নিপতির ভাই, তার বাবা ও মা- চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছে মেয়েটির পরিবার।
ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শনিবার মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে রবিবারও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছেন।
রবিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, মাগুরার যৌন নিপীড়নের শিকার শিশুটির অবস্থা অপরিবর্তিত আছে বলে জানিয়েছেন তার মামা। এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি। কৃত্রিম উপায়ে চলছে তার শ্বাস-প্রশ্বাস।
রবিবার তার সর্বশেষ শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্ট দেওয়ার কথা রয়েছে। শিশুটির চিকিৎসায় চার সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড কাজ করছে।
শিক্ষার্থীদের সরব প্রতিবাদের মধ্যে ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন ঠেকাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধূরী।
মাগুরায় ধর্ষিত শিশুটিতে দেখতে রবিবার সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) গিয়ে তিনি একথা জানান বলে বাসস জানিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নারী হয়রানি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।
“এ যাবত নারীর প্রতি যত সহিংসতা হয়েছে, সেগুলোর তালিকা করে দ্রুত তদন্ত সম্পন্নপূর্বক আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছি।”