বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানো নিয়ে পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ তিনটি মামলা করেছে পুলিশ। বুধবার করা এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দেড় হাজার জনকে।
একাধিক মামলায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তারও দেখানো হয়েছে, যাদেরকে মঙ্গলবার রাতে যৌথবাহিনীর অভিযানে আটক করা হয়। তবে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মামলা হয়নি।
তিন মামলায় যে ২৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় জানাতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে, তারা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকনের সদস্য এবং চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারী হিসেবে পরিচিতি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে সমাবেশ আয়োজনে ভূমিকা রেখেছিলেন ইসকন নেতা চিন্ময়। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে সমাবেশের পর ‘বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট’র ব্যানারে নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
তবে ২৫ অক্টোবরের সমাবেশের দিন চট্টগ্রাম নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে ইসকনের গেরুয়া রঙের আরেকটি পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে ৩০ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন বিএনপির স্থানীয় এক নেতা।
ওই মামলায় মঙ্গলবার ঢাকা থেকে চিন্ময়কে গ্রেপ্তার করে পরদিন চট্টগ্রামের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার চট্টগ্রামে চিন্ময়কে নেওয়ার পর তার অনুসারীরা আদালত পাড়ায় বিক্ষোভ শুরু করে। তা সংঘর্ষে গড়ালে নিহত হন চট্টগ্রামের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হিসাবে সদ্যই নিয়োগ পাওয়া সাইফুল ইসলাম আলিফ।
চিন্ময়কে কারাগারে পাঠানো ঘিরে পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগে বুধবার সন্ধ্যায় নগরীর কোতোয়ালী থানায় মামলা তিনটি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি-মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ।
তিনি বলেন, “পুলিশের ওপর হামলা, কর্তব্যকাজে বাধাদান, সংঘাতের মাধ্যমে জনমনে ভীতিসঞ্চারসহ বিভিন্ন অভিযোগে তিনটি মামলা পুলিশের পক্ষ থেকে হয়েছে। আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় আরেকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।”
এডিসি তারেক আজিজ বলেন, চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণের ঘটনায় হওয়া মামলায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি আরও ৬০০-৭০০ জন।
আদালত ভবনের মূল প্রবেশপথের বিপরীতে রঙ্গম সিনেমা হলের সামনের ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০০-৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। নগরীর কোতোয়ালীর মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মালায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ২৫০-৩০০ জনকে।
তাদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, “তিনটি মামলা হয়েছে। আসামিরা সবাই ইসকন সদস্য এবং চিন্ময় দাসের অনুসারী।”
এপিপি সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় ছয় জনকে গ্রেপ্তার করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয় বলে বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের পরিচয় জানানো হয়নি।
চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সোমবার বিকালে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইসকনের বহিষ্কৃত সংগঠক ও সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে তাকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।
তাকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে বিক্ষোভ শুরু করে তার অনুসারীরা। প্রায় তিন ঘণ্টা আদালতের প্রাঙ্গণে আটকে থাকার পর পুলিশ-বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে নেওয়া হয়।
এরপর তার অনুসারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বেশ কিছু গাড়ি ভাংচুর করে। আদালত থেকে একদল আইনজীবী, স্থানীয় জনতা মিলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা চালালে সংঘর্ষ বড় আকার ধারণ করে। পরবর্তীতে নগরীর লালদিঘীর পাড় থেকে কোতোয়ালী এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
সেই ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দুরে সেবক কলোনী এলাকায় এপিপি সাইফুল ইসলাম আফিলকে হেলমেট পরা একদল লোক তার ওপর হামলা করে। তার পিঠে কোপ, মাথায় ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত দেয় তারা। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বুধবার দিনভর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ হয়। তিন দফা জানাজা শেষে সাইফুল ইসলাম আফিলকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।