ধনী দেশগুলো কেন ধনী, গরিব দেশগুলো কেন ধনী হতে পারছে না- তার কার্যকারণ খুঁজে দিয়ে অর্থনীতিতে এবছর নোবেল পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের তিন অর্থনীতিবিদ।
তারা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক তুর্কি বংশোদ্ভূত আমেরিকান ড্যারন আশেমোগলু, একই প্রতিষ্ঠানের সায়মন জনসন এবং ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো, ইলিনয়ের অধ্যাপক জেমস রবিনসন।
সোমবার দ্য রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি ২০২৪ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাদের নাম ঘোষণা করে। এর মধ্যদিয়ে ২০২৪ সালের নোবেলবিজয়ীদের নাম ঘোষণা শেষ হলো। আগামী ডিসেম্বরে হাতে হাতে পদক তুলে দেওয়া হবে।
নোবেল কমিটি জানিয়েছে, এবার অর্থনীতিতে পদক বিজয়ীরা বিভিন্ন দেশের মধ্যে জাতীয় আয়ের স্তরের ব্যাপক বৈষম্যের পেছনে কারণ উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে দীর্ঘস্থায়ী পার্থক্য এই বৈষম্যের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। তারা ইউরোপীয় উপনিবেশের চালু করা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠান ও সমৃদ্ধির মধ্যকার সম্পর্ক প্রমাণ করেছেন।
এই তিন অর্থনীতিবিদ এমন তত্ত্বীয় কৌশলও উদ্ভাবন করেছেন, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পার্থক্য কেন স্থায়ী হয় এবং সেগুলো কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করতে পারে।
কেন কিছু দেশ ধনী ও অন্য কিছু দেশ দরিদ্র
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ২০ শতাংশ দেশ, সবচেয়ে গরিব ২০ শতাংশ দেশের তুলনায় প্রায় ৩০ গুণ বেশি ধনী। এই পার্থক্য বহুদিনের। গরিব দেশগুলো আগের চেয়ে কিছুটা ধনী হচ্ছে। তবুও তারা ধনী দেশগুলোর সমান সমৃদ্ধ হতে পারছে না।
কিন্তু কেন?
এই তিন অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, এই পার্থক্যের অন্যতম কারণ হলো সেসব দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো।
কোনও সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে সম্পর্কের কার্যকারণ প্রমাণ করা সহজ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মধ্যে অবশ্যই সম্পর্ক থাকবে, এমনটি ধরে নেওয়া যায় না।
ধনী ও গরিব দেশের মধ্যকার পার্থক্য অনেক। শুধু শাসন ব্যবস্থা বা আইন-কানুনই নয়, আরও অনেক কিছুতেই তারা ভিন্ন। তাই হয়তো একটি দেশ ধনী হওয়ার পেছনে শুধু শাসন ব্যবস্থাই কারণ নাও হতে পারে। আর সেই দেশের শাসন ব্যবস্থাও অন্য কোনও কারণে এমন হতে পারে।
সম্ভবত কোনও দেশ ধনী হওয়ার কারণে সেখানকার শাসন ব্যবস্থা, আইন-কানুন ইত্যাদি ভালো হয়। এটা বুঝতে ওই তিন অর্থনীতিবিদ নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। বিশ্বের যেসব দেশে ইউরোপীয়রা শাসন করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন আশেমোগলু, জনসন ও রবিনসন। তারা দেখতে পান, কিছু দেশ খুব ধনী আর কিছু দেশ খুব গরিব, এর বড় কারণ হলো সেসব দেশে ইউরোপীয়দের প্রবর্তিত শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
নোবেলজয়ীরা দেখিয়েছেন, ইউরোপীয়রা যেসব দেশ শাসন করেছিল, সেগুলোর ভাগ্য উল্টে যায়। আগে যে দেশগুলো ধনী ছিল, সেগুলো এখন গরিব।
গবেষকরা উপনিবেশকারীদের মৃত্যুহারের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখান, উপনিবেশ স্থাপনকারীদের মৃত্যুহার যত বেশি ছিল, সেই অঞ্চলের বর্তমান মাথাপিছু আয় তত কম। এর কারণ হলো, উপনিবেশ স্থাপনের ঝুঁকি যত বেশি ছিল, উপনিবেশকারীরা তত কম দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করেছিল। ফলে তারা সেখানে এমন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বসিয়েছিল, যেখানে তাদের নিজস্ব স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পেত দেশের মানুষের উন্নয়নের চেয়ে।
নোবেলবিজয়ীরা একটি নতুন তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করেছেন। এটি ব্যাখ্যা করে যে, কেন কিছু সমাজ ‘নিষ্কাষণমূলক প্রতিষ্ঠান’ নামক একটি অর্থনৈতিক ফাঁদে আটকে পড়ে এবং সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে তারা এটাও দেখিয়েছেন, পরিবর্তন সম্ভব এবং নতুন প্রতিষ্ঠান গঠিত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে একটি দেশ তার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এসব পরিবর্তন দারিদ্র্য হ্রাস করতে পারে।
ফাঁদ থেকে মুক্তি
আশেমোগলু, জনসন ও রবিনসনের মতে, জনগণকে শোষণে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেগুলো দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। আর যেখানে মৌলিক অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এমন প্রতিষ্ঠানগুলি এর জন্য উপকারী।
সাধারণত কোনও দেশের শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যদিও ক্ষমতাসীন এলিটরা দেশের সম্পদ নিজেদের কাছে রাখার মাধ্যমে স্বল্পকালের জন্য লাভবান হয়, তবুও সবাইকে সমান সুযোগ দিলে দীর্ঘমেয়াদে সবাই লাভবান হবে। তাহলে এই ক্ষমতাসীন এলিটরা কেন নিজেদের সুবিধার জন্য তৈরি করা ব্যবস্থাটা বদলাতে চায় না?
পুরস্কার বিজয়ীরা তাদের ব্যাখ্যায় রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং শাসক শ্রেণী ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের সমস্যার উপর জোর দিয়েছেন। যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা শাসক শ্রেণীর উপকারে আসবে, ততদিন জনগণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি রাখা হবে বলে বিশ্বাস করতে পারবে না।
তাদের মতে, এমন এক নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা উচিৎ যেখানে জনগণ নিজেরা তাদের নেতাদের বদলে দিতে পারবে, যদি সেই নেতারা নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলো না রাখেন। এমন ব্যবস্থা চালু হলে দেশের অর্থনীতিও সঠিক পথে চলতে পারবে।
ক্ষমতাসীনরা মনে করে না যে, নতুন ব্যবস্থা চালু হলে জনগণ তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে। এই ক্ষতিপূরণের অভাবকেই ‘প্রতিশ্রুতি সমস্যা’ বলা হয়। এই সমস্যা খুব কঠিন। এর ফলে সমাজ এক ধরনের ফাঁদে আটকে পড়ে। এই ফাঁদে থাকার মানে হলো, সমাজে শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো বজায় থাকে, বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র থাকে ও কয়েকজন খুব ধনী হয়ে ওঠে।
ওই তিন গবেষক দেখিয়েছেন, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দিতে না পারার কারণে কখনও কখনও গণতন্ত্রে পরিবর্তন হতে পারে। যদি কোনও অগণতান্ত্রিক দেশের জনগণের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক ক্ষমতা নাও থাকে, তবুও তাদের কাছে শাসকগোষ্ঠীকে ভয় দেখানোর অস্ত্র থাকে। আর সেটি হলো তাদের সংখ্যা।
সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে বড় আন্দোলন করলে তা শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এসব আন্দোলনে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। তবুও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই শাসকদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। কারণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অধিক সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে। এই বৃহৎ জনসমর্থন শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় চাপ তৈরি করে।
জনগণের আন্দোলন তীব্র হলে শাসকগোষ্ঠী দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়। তারা ক্ষমতায় থাকতে চায় এবং জনগণকে শান্ত করতে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ জনগণ জানে, যদি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকে, তাহলে তারা পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারে। এক্ষেত্রে, শাসকগোষ্ঠীর জন্য একমাত্র বিকল্প হতে পারে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং গণতন্ত্র প্রবর্তন করা।
নোবেলবিজয়ীদের মডেল অনুযায়ী, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে গঠিত হয় এবং পরিবর্তন হয়, তা ব্যাখ্যায় তিনটি উপাদান রয়েছে। প্রথমটি হলো সম্পদের বণ্টন এবং কোন গোষ্ঠী সমাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ধরে রাখে, (শাসকগোষ্ঠী বা জনগণ) তা নিয়ে সংঘাত। দ্বিতীয়টি হলো জনগণ কখনও কখনও একত্রিত হয়ে শাসকগোষ্ঠীকে হুমকি দিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ পায়। সুতরাং সমাজের ক্ষমতা শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নয়। তৃতীয়টি হলো প্রতিশ্রুতি সমস্যা, যার অর্থ হলো শাসকগোষ্ঠীর জন্য একমাত্র বিকল্প হতে পারে জনগণের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলে দেওয়া।
মডেলটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিশ শতাব্দীর প্রথমভাগে পশ্চিম ইউরোপে গণতন্ত্র প্রবর্তনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনে ভোটদানের অধিকার ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। প্রতিটি ধাপের আগে সাধারণ ধর্মঘট ও প্রতিবাদ হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এই হুমকির মুখে সামাজিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি। উল্টো তারা অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে ক্ষমতা ভাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
সুইডেনের পরিস্থিতিও একই রকম ছিল। সেখানে ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে সর্বজনীন ভোটদানের সিদ্ধান্ত রুশ বিপ্লবের পর ব্যাপক দাঙ্গার পরে নেওয়া হয়েছিল। এই মডেলটিও কিছু দেশে কেন গণতন্ত্র ও অগণতন্ত্রের মধ্যে বারবার পরিবর্তন হয়, তা ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পাশাপাশি যেসব দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান নেই সেগুলোর জন্য সমান প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কেন এত কঠিন এবং শাসকগোষ্ঠী কখনও কখনও কেন নতুন প্রযুক্তিকে বাধা দিয়ে উপকার পায়, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে মডেলে।
আশেমোগলু, জনসন ও রবিনসন দীর্ঘ সময় ধরে কোন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কীভাবে প্রভাবিত হয়, সে সম্পর্কে নতুন ধরনের গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে প্রমাণ মেলে, কোনও দেশের উপনিবেশকালে যে ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেগুলো দেশটির দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তাদের তাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে কিছু পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তারা দেখিয়েছেন, শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার সম্ভব। এই গবেষকদের কাজ অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চলমান গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কোনও দেশে ভালো অর্থনৈতিক অবস্থা হবে তখনই, যখন সেখানে গণতন্ত্র থাকবে এবং সবার সমান সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ একটি দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোই তার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র : নোবেলপ্রাইজ ডট ওআরজি