নির্মাতা ইশিরো হনডা ‘গডজিলা’ এনেছিলেন ১৯৫৪ সালে। এর ১০ বছর আগে জাতীয় শোকের ঘটনা ঘটে জাপানে। ১৯৪৫ সালের নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের বাসিন্দাদের উপর নেমে আসে অমানিশা। সেসব দুর্যোগ প্রভাব ফেলেছিল ‘গডজিলা’ সিনেমাতেও।
কারো কাছে ‘গডজিলা’ মানে হলো গোলাপি পাখনা বসানো এক সুপারহিরো যে ২০২৪ সালের ‘গডজিলা এক্স কং: দ্য নিউ এম্পায়ার’ সিনেমায় কুড়াল হাতে ধরা কিংকং দানবের সঙ্গে মহাকাব্যিক যুদ্ধে নেমেছে। দুই প্রাচীন দানবকে নিয়ে অ্যাডাম উইংগার্ড পরিচালিত বক্সঅফিস কাঁপানো এই সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল চলতি বছরের ২৯ মার্চ।
আবার অনেকের কাছে ‘গডজিলা’ হলো ৭০ দশকের হ্যানা-বারবেরা কার্টুন সিরিজের লেজার-বিম চোখের দয়াবান রক্ষাকারী দেবদূত, যার গডজুকি নামে এক আদুরে ভাইপো ছিল।
এসব ধারণার বাইরে গডজিলার জীবন শুরু হয়েছিল দানব চরিত্রেই। ১৯৫৪ সালের সিনেমায় দেখানো ফুঁসে ওঠা মহাসাগরের বুক থেকে উঠে আসা গডজিলা ছিল পারমাণবিক ধ্বংসের নির্মম চিত্রায়ন। ৭০ বছর পরেও মনস্তত্ত্বের অন্ধকার দিক নিয়ে পৃথিবীর সেরা ভয়াল সিনেমা এই গডজিলা।
বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অ্যালেক্স ডেভিডসন লন্ডনের বার্বিকান সেন্টারে এই বছরের গোড়ার দিকে কাইজু ফিল্মস অর্থাৎ দানব চরিত্র ভিত্তিক সিনেমা নিয়ে এই প্রদর্শনীর তদারকি করেছিলেন।
বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ডেভিডসন বলেন, “ওতে প্রথমে দেখেছিলাম ১৯৬৬ সালের ’ইবিরাহ, হরর অব দ্য ডিপ’। এতে গডজিলা একটা বিরাট আকারে চিংড়ির সঙ্গে লড়াই করে। আমার এই সিনেমা ভালই গেলেছে।
“তবে ৯০ -এর দশকে আমি চ্যানেল ফোরে একটি সংস্করণ দেখেছিলাম। ওটা একেবারে খারাপ ডাবিং ছিল ইংরেজিতে। এই সিনেমায় গডজিলাকে দেখা গেলো সদয় এক প্রাণী। সিনেমা দেখে আনন্দ পেয়েছি; যদিও এই সিনেমা খুব গুরুগম্ভীর বলে বিবেচিত হওয়ার মতো না। ”
“পরের বছর চ্যানেল ফোর প্রথম মূল জাপানি ভাষায় প্রথম গডজিলা সিনেমাটি দেখিয়েছিল। আমি ওই সিনেমা দেখে চমকে উঠেছি। সিনেমাটি দারুণ; আর ভূতুড়ে ও নিরানন্দ অনুভূতি জাগিয়ে তোলে প্রবলভাবে।”
কাইজু পুরাণ অনুসারে, গডজিলা হলো প্রাগৈতিহাসিক দৈত্য।
যদিও অনেকেই একমত হবেন, গডজিলা আসলে জন্ম নিয়েছিল ১৯৪৫ সালের অগাস্টে; যখন জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে মার্কিন পরমাণু বোমার আঘাতে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
স্টিভেন স্লস একজন কাইজু গবেষক।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমাদের মনে রাখা দরকার, জাপান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যা সরাসরি পরমাণু আক্রমণের শিকার হয়েছে।”
এ কারণে গডজিলা এমন একটি সিনেমা যা শুধু জাপানই তৈরি করতে পারতো।
এই বোমা হামলার গভীর প্রভাব পড়েছিল জাপানের মানুষের মনোজগতে। যদিও হিরোশিমা ও নাগাসাকির বাসিন্দারাই এমন ঘটনার সর্বশেষ শিকার ছিলেন না।
১৯৫৪ সালের মার্চের ঘটনা। প্রশান্ত মহাসাগরের বিকিনি অ্যাটলে যুক্তরাষ্ট্রের তাপমাণবিক পরীক্ষার সময় এর তেজষ্ক্রিয়তার শিকার হয় ডাইগো ফুকুরিউ মারু বা লাকি ড্রাগন ফাইভ নামে একটি টুনা মাছ ধরার নৌকা। ওই নৌকার রেডিও অপারেটর তেজষ্ক্রিয় অসুখে মারা যান। পরে জাপানের সরকার জানতে পারে এখানকার তেজস্ক্রিয় দূষণ আক্রান্ত মাছ সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে।
বার্বিকান এবং জাপান ফাউন্ডেশন লন্ডন আয়োজিত এক সেমিনারে ওয়েস্টার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জেফ্রি অ্যাঙ্গেলস এসব তথ্য তুলে ধরেন।
“জাপানবাসীর কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছিল, বাইরে থেকে হামলা করা এসব তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষতি তারা এড়াতে পারবে না।”
বাস্তব জীবনের বিভীষিকাকে একটি বিশাল দৈত্য দিয়ে তুলে ধরার কথা ভেবেছিলেন তোহো স্টুডিওর একজন প্রযোজক তমোয়ুকি তানাকা। তিনি দুটি সিনেমা থেকেও প্রভাবিত হয়েছিলেন। একটি হলো ১৯৩৩ সালের সিনেমা ’কিং কং’, যা ১৯৫২ সালে পুনরায় মুক্তি পেয়েছিল। এছাড়া আধুনিক নিউ ইয়র্কে বিশাল ডাইনোসরের তাণ্ডবের কাহিনী নিয়ে ১৯৫৩ সালের ’দি বিস্ট ফ্রম ২০,০০০ ফ্যাথমস’ সিনেমা।
তানাকা একজন প্রসিদ্ধ সাই-ফাই লেখক শিগেরু কায়ামাকে নিয়োগ দেন ’প্রজেক্ট জি’ নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে।
“তিনি কাজ নিউক্লিয়ার বিরোধী প্রকল্প হিসাবে দেখেছিলেন”, বললেন ড. জেফ্রি অ্যাঙ্গেলস।
কায়ামার উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ হয়েছিল অ্যাঙ্গেলসের হাতেই।
আর সবার কাছেও এই প্রযোজনার গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। এদের মধ্যে আছেন পরিচালক ও সহ-লেখক ইশিরো হোন্ডা এবং ডিজাইন ও ভিজ্যুয়াল অ্যাফেক্টস সুপারভাইজার এজি তসবুরায়া।
লাকি ড্রাগন ফাইভ ঘটনার আট মাস পরেই প্রেক্ষাগৃহে আসে ’গডজিলা’।
জাপানিরা উচ্চারণ করে ‘গোজিরা’, যা হলো ডাইনোসরের মতো দানবীয় প্রাণী টাইরানোসর। এরা লাখ লাখ বছর সমুদ্রে লুকিয়ে ছিল।
“সাগরে মাছ খুঁজে না পেয়ে স্থলে উঠে এসে মানুষ শিকার করে এই দানব”, এক দ্বীপের গ্রামপ্রধান বললেন একথা।
কিন্তু পারমাণবিক বোমা এই প্রাণীকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। গডজিলার নিঃশ্বাসেও তেজস্ক্রিয়াতা মিশে গেছে। সবমিলিয়ে গডজিলা হয়ে ওঠে বদমেজাজী এক প্রাণী যে টোকিও শহর ধ্বংস মেতে ওঠে, লেজের ধাক্কার একেকটি ভবন উপড়ে ফেলে এবং গোটা শহর জ্বালিয়ে দেয়।
‘কিং কং’ সিনেমায় উইলিস এইচ ও’ব্রায়েন দুর্দান্ত স্টপ-মোশন অ্যানিমেশনের কাজ করেছিলেন। ‘গডজিলা’ নির্মাণেও এমন পথ অনুসরণের কথা ছিল। কিন্তু এজি তসবুরায়ার হাতে সেই বাজেট ও সময় ছিল না।
গডজিলা চরিত্রে হারুও নাকাজিমা পরলেন রাবারের স্যুট; এর পা মোটা এবং পেছনে পাখনা দুলতে থাকে। তিনি নকল ক্ষুদে শহরের মাঝে দিয়ে এই পোশাকে হেঁটে চলেন। এখানে খুব সামান্যই অ্যানিমেশন ও পাপেট্রি রাখা হয়। এরপরও গডজিলা সিনেমায় জাপানের রাজধানী টোকিওতে তাণ্ডব চালানোর দৃশ্যগুলো ’কিং কং’ সিনেমার চেয়েও ভীতিকর হিসাবে দাগ করে দর্শকের কাছে।
১৯৪৫ সালে চীনে যুদ্ধবন্দি ছিলেন হনডা। তিনি হিরোশিমার ধ্বংসাবশেষ চোখের সামনে দেখেছিলেন। তখনই তিনি শপথ নিয়েছিলেন, এসব পর্দায় তুলে ধরবেন।
“প্রাপ্তবয়স্করা এই সিনেমা দেখতে দেখতে অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল সিনেমাহলে”, বললেন ড. অ্যাঙ্গেলস।
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরনো আতঙ্কের সঙ্গে এই সিনেমা সেতুবন্ধন তৈরি করতে পেরেছিল।”
এক দানবের নৃশংতার বলি হয় অসংখ্য নিরীহ মানুষ – এই বিষয়বস্তু দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল।
একটি দৃশ্যে দেখা যায় মা তার শিশুকে বুকে আঁকড়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে রাস্তায় চলছে আর বলছে, “শিগগিরই তোমাদের বাবার সঙ্গে দেখা হবে। আমরা স্বর্গে যাচ্ছি তার সঙ্গে থাকতে।”
আরেকটি দৃশ্যে আছে হাসপাতালের করিডরে স্ট্রেচার নিয়ে ছুটোছুটি, রক্তাক্ত শরীর এবং আর্তনাদ করা শিশুরা।
“মূল সিনেমাটি একেবারে অতুলনীয়,” বলেন স্লস।
“কেউ কেউ ‘দি বিস্ট ফ্রম ২০,০০০ ফ্যাথমস’ সিনেমার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। কারণ দুটি সিনেমাতেই তেজিষ্ক্রিয়তা, প্রাগৈতিকহাসিক যুগের সরীসৃপ দৈত্য রয়েছে। দুটি সিনেমাই সাদা-কালো এবং ৪:৩ স্ক্রিনে দেখানো হয়েছে।”
“যদিও এসব আসলে উপরিতলের তুলনা। ’দি বিস্ট ফ্রম ২০,০০০ ফ্যাথমস’ সিনেমা হয়েছিল শনিবারের ম্যাটিনি দর্শকদের জন্য; শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের জন্য। ওতে কোনো কষ্ট বা ট্র্যাজেডি ছিল না। কিন্তু গডজিলা সিনেমা যন্ত্রণা ভোগের দীর্ঘ দৃশ্যগুলো রীতিমত হৃদয়বিদারক হয়ে ধরা দেয়।”
সিনেমায় প্রধান চরিত্র হল ড. ইয়ামানে। এই চরিত্রে কাজ করেছেন কুরোসাওয়া ক্লাসিক ‘রাশোমন’ এবং ‘সেভেন সামুরাই’ সিনেমার অভিনেতা তাকাশি শিমুরা।
ড. ইয়ামানে একজন প্যালিয়োনটোলজিস্ট, যাকে সবসময় অন্ধকারে বসে থাকতে দেখানো হয়। গবেষণার বদলে গডজিলাকে মেরে ফেলার সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন।
এক চোখে পট্টি দেয়া বিজ্ঞানী ড. সেরিজাওয়া চরিত্রে কাজ করেছেন আকিহিকো হিরাতা। বিজ্ঞানী ড. সেরিজাওয়া ‘অক্সিজেন ক্ষয়কারী’ উপাদান আবিষ্কার করেন; যা পানিতে মিশিয়ে দিলে সেকেন্ডের মধ্যে সামুদ্রিক জীব কঙ্কাল হয়ে যাবে। সেরিজাওয়া ভালো করেই জানেন এই আবিষ্কারে গডজিলাকে কাবু করা যাবে। কিন্তু তার ভয় হচ্ছে, দেশের সরকারের হাতে এই আবিষ্কারের ফর্মুলা পৌঁছে গেলে অন্য কোনো ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে এর প্রয়োগ হবে।
গডজিলা কেবল একটি ব্লকবাস্টার সিনেমা হয়ে থাকেনি। এই সিনেমা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় সবাইকে; মৃত্যুর পাহাড় আরও উঁচু হবে জানার পরও আমাদের কি আরও শক্তিশালী অস্ত্র বানানোর দৌড়ে সামিল হতেই হবে?
সিনেমায় ড. সেরিজাওয়া তার ফর্মুলার প্রয়োগ করেছিলেন, তবে এরপরই তিনি সব নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেন। এমনকি সুরের মাঝে ডুবে যেতে যেতে বেছে নেন মৃত্যু।
হলিউডের সিনেমায় দেখানোর জয়ের চেয়ে গডজিলা একেবারেই ভিন্ন; সিনেমায় গডজিলার পরাজয় আসে অনেক বড় ত্যাগের বিনিময়ে।
স্লস বলেন, “গডজিলার শেষ অনেকটা ওপেনহাইমার সিনেমার মতো। ওপেনহাইমার আইনস্টাইনকে বলেন, ’আমরা এমন একটি চেইন রিঅ্যাকশন চেয়েছিলাম যা গোটা পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে… আমরা তা পেরেছি’। এখানে মূল বার্তাটি হলো, অস্ত্র প্রতিযোগিতা কখনোই শেষ হবে না। সব সময় আরও বড় কোনো হুমকি আসবে, আমরা সব সময় আমাদের নিজের ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছি। আর তা হবে আমাদের হাতেই।”
গডজিলা সিনেমার শেষে ড. ইয়ামানে হুঁশিয়ার করে বলেন, “এটা শুধু গডজিলা নিয়ে নয়; যদি তারা মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েই যায়, তবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আরেকটি গডজিলা দেখা দেবে।”
এখন পর্যন্ত ৩৩টি জাপানি গডজিলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। প্রত্যেকটি নিজের জায়গা ভালো সিনেমা হলেও স্লস ও ডেভিডসনের দাবি, ১৯৫৪ সালের ওই গডজিলা সিনেমার মতো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারেনি একটিও।
স্লস মনে করেন, জাপানি জনপ্রিয় সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে সুরেলা ফ্র্যাঞ্চাইজি হলো গডজিলা।
গডজিলা পারমানবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে নির্মাণ হলেও পরে তা দূষণ, জলবায়ু বদল এবং লাগামহীন ভোগবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে।
হলিউডে গডজিলা কেমন প্রভাব রেখেছে?
এর উত্তর দেয়া সহজ না হলেও স্লসের ২০১৬ সালের ‘শিন গডজিলা’ এবং ২০২৩ সালের ’গডজিলা মাইনাস ওয়ান’ স্পেশাল ইফেক্টের জন্য অস্কার জিতে নিয়েছিল।
তবে গডজিলা সিনেমার সত্যিকারের ‘আধ্যাত্মিক’ সিকুয়েল হতে পেরেছে ওপেনহাইমার বলে মনে করছেন স্লস।
যখন গডজিলা টোকিওতে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠে, দর্শকরা হয়তো ওপেনহাইমার সিনেমা থেকে ভগবদ্গীতার উদ্ধৃতিটি মনে করতে পারবেন, “এখন আমি মৃত্যু হয়ে গেছি, গোটা বিশ্বের ধ্বংসকারী।”
(বিবিসি অবলম্বনে)