বাস্তবের ঘটনার ছায়া অবলম্বনে তৈরি আমিরপুত্র ‘মহারাজ’ সিনেমাটি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়ার পর ভালোই সাড়া ফেলেছে। ইতিমধ্যে সিনেমাটির ভিউ ২৫ লাখের কাছাকাছি হয়েছে।
মহারাজ সিনেমার প্রেক্ষাপট ভারতের প্রাক-স্বাধীনতা পর্ব। যার মূল চরিত্র গুজরাটি সাংবাদিক এবং সমাজ সংস্কারক কারসানদাস মুলজি। এই সিনেমার ক্লাইমেক্স আবর্তিত হয় ইতিহাসবিখ্যাত ‘মহারাজ লিবেল কেইস ১৮৬২’- কেন্দ্র করে।
তরুণ সাংবাদিক কারসানদাস ছিলেন একাধারে সমাজ সংস্কারক, লেখক, সাংবাদিক এবং বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আন্দোলনের সংগঠক। তিনি ধর্মের নামে বৈষ্ণব ধর্মীয় গুরু জদুনাথ মহারাজের যৌন নিপীড়ণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
সিনেমার শুরুতেই দেখানো হয়, ধর্মীয় গুরু মহারাজ চলে আসা ঐতিহ্যের অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছেন। এটিকে ওই কমবয়সী নারীদের বেশিরভাগই ধর্মীয় আচরণ হিসেবেই দেখছে। কখনও কখনও কোনও কোনও নারী একে নিপীড়ণ মনে করলেও, প্রতিবাদ ছিল ক্ষীণ।
মহারাজের এই অনৈতিক যৌনাচারের ধারাবাহিকতায় ‘কিশোরী’ নামের এক তরুণীর সঙ্গেও তার সম্পর্ক হয়। সিনেমায় দেখানো হয়, কিশোরী নামের ওই মেয়েটি ছিল সাংবাদিক কারসান দাসের বাগদত্তা। কারসান দাস মহারাজের এ অনাচার সহ্য করতে পারেন না। ওদিকে শুরুতে কিশোরীও এটিকে স্বাভাবিক ধর্মীয় আচার হিসেবেই দেখে। কারসান দাসের সঙ্গে তার বিতণ্ডাও হয়। ফলে তাদের মধ্যে হয় বিচ্ছেদ।
কিশোরী আত্মহত্যা করলে সাংবাদিক কারসানদাস আশ্রয় নেন কলমের। মহারাজের অনাচার নিয়ে লিখেন প্রবন্ধ।
১৮৬০ সালের ২১ অক্টোবর প্রকাশিত মুম্বাইভিত্তিক (তৎকালীন বোম্বে) গুজরাটি পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘হিন্দু নো আসলি ধারাম এন আতিয়ার না পাখান্দি মাতো’। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘দ্য ট্রু রিলিজিয়ন অব দ্য হিন্দুজ অ্যান্ড দ্য প্রেজেন্ট হিস্টোরিকাল অপিনিয়ন্স’।
বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পুস্তিমার্গ গোত্রের অনুসারীদের হাতে পত্রিকাটি পৌঁছে গেলে বোম্বে শহরে পড়ে যায় তোলপাড়। এরপর নানান ঘটনার অলিগলি পেরিয়ে গল্প গড়িয়ে যায় কোর্টে। কারসানদাস এবং জদুনাথের মধ্যে তৈরী হওয়া তুমুল টেনশনের নিষ্পত্তিও ইতিহাস বর্ণিত পথ ধরেই হয়।
‘মহারাজ’ সিনেমাটির লক্ষণীয় দিক হলো এর কাস্টিং। এতে বড় চমক হয়ে এসেছেন বলিউড সুপারস্টার আমির খানের ছেলে জুনায়েদ খান। অভিষেকেই কারসানদাসের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রে তিনি ছিলেন অনবদ্য। বোঝাই গেছে, যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই তিনি ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন। কিশোরী চরিত্রে অভিনয় করা শৈলিনি পান্ডের স্ক্রিনটাইম সংক্ষিপ্ত হলেও, তার উপস্থিতি ছিল বেশ প্রাঞ্জল। চরিত্রটিকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পেরেছেন একাধারে তামিল, তেলেগু এবং বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা এই অভিনেত্রী।
সিনেমায় বিরাজ চরিত্রের প্রবেশ ঘটেছে বলিউড ফর্মূলা মেনে। মূল ঘটনায় প্রবেশের প্রান্তে একজন ‘হিরোইন’ এর মৃত্যু ঘটাতেই কি গল্পজুড়ে আরেক ‘হিরোইন’ এর প্রয়োজন হলো- এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ পুরো গল্পে শর্বরী ওয়াগ অভিনীত বিরাজ চরিত্রটি খানিকটা মেদ মেদ ঠেকেছে। এই চরিত্র ছাড়াই গল্প এগিয়ে যেত দারুণভাবে।
ঐতিহাসিক চরিত্র কারসানদাস মুলজি ছিলেন বর্তমান মুম্বাইয়ের এলফিন্সটোন কলেজের ছাত্র। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন ভারতের বিখ্যাত ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক নর্মাদাশংকর দেভ। তার আরেক সহপাঠী ছিলেন মহীপাতরাম রুপরাম নীলকন্ঠ। পরবর্তীতে যিনি ভারতের একজন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক এবং শিক্ষাবিদে পরিণত হন। ধারণা করা হয়, কারসানদাসের মুক্ত চিন্তার খোরাক এই কলেজ থেকেই। এতে তার সহপাঠীরাও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সমাজ সংস্কার এবং বিধবা বিবাহসহ কারসানদাসের সাহসী সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছেন দাদাভাই নাওরোজির নাম। নাওরোজি ছিলেন একাধারে একজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং লেখক। নিজের পত্রিকা ‘সত্যপ্রকাশ’ এ লেখা প্রকাশের আগে, কারসানদাস দাদাভাই নাওরোজির পত্রিকা ‘রাস্ত গফতারে’ লিখতেন নিয়মিত।
‘মহারাজ’ সিনেমায় দাদাভাই নাওরোজির চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুনীল গুপ্ত। ২০১৯ সালে প্রাইম ভিডিওতে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ ধারাবাহিকেও অভিনয় করেছিলেন তিনি।
এর আগে নেটফ্লিক্সে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এই ছবিটির মুক্তির ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিল গুজরাট হাইকোর্ট। বৈষ্ণব পুস্তিমার্গী সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তির দায়ের করা এক মামলায় হাইকোর্ট এই সিদ্ধান্ত দেয়। কথা ছিল সিদ্ধার্থ মালহোত্রা নির্দেশিত এবং আদিত্য চোপরা প্রযোজিত মহারাজ ছবিটি ১৪ জুন মুক্তি পাবে।
বৈষ্ণব পুস্তিমার্গী সম্প্রদায়ের ওই সদস্যদের আশঙ্কা ছিল, ছবিটি মুক্তি পেলে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ভুলভাবে উপস্থাপিত হবে।
তবে বাঁধা কেবল আদালত থেকেই আসেনি, সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও এসেছিল। ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ ‘বয়কটনেটফ্লিক্স’ হ্যাশট্যাগে সোচ্চার হয়ে ওঠে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বনাম ধর্মানুভূতির প্রতি সম্মান বিতর্কে বিস্তর মত দিতে থাকেন আইনি বিশেষজ্ঞরা।
যদিও পরে হাইকোর্ট তাদের আদেশ তুলে নিলে এই সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইয়াশরাজ ফিল্ম তাদের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডলে এক বিবৃতি প্রকাশ করে।
বিবৃতিতে তারা সিনেমাটি মুক্তির অনুমতি দেওয়ার জন্য গুজরাট হাইকোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। এতে তারা দাবী করে, তারা কখনোই এমন কোন গল্প নির্মাণ করেনি যা ভারত ও ভারতের মানুষকে কলঙ্কিত করে।
সিনেমা মুক্তির আনন্দে আমীর পুত্র জুনায়েদ খান গণমাধ্যমে জানান তার প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, “আমার কী-যে খুশি লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। মহারাজ আমার জন্য এক দীর্ঘ জার্নি ছিল। কিন্তু শেষ ভালো যার সব ভালো তার।”