Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
শ্যামলী নিসর্গের সেকাল একাল-৫

ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: আষাঢ় পর্ব

শিরীষের ফুল ও ফল। আলোকচিত্র: লেখক।

নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের গাছপালা নিয়ে লিখেছিলেন ‘শ্যামলী নিসর্গ’। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত সে বইটি এখনও ঢাকার বৃক্ষচর্চার আকরগ্রন্থ। তিনি শ্যামলী নিসর্গ লিখে রেখে না গেলে সেকালের ঢাকার পথতরুর বৃত্তান্ত আমরা হয়তো জানতে পারতাম না। কিন্তু ঢাকার সেসব পথতরুর এখন কী অবস্থা? আজও কি সেগুলো বেঁচে আছে? দ্বিজেন শর্মার আত্মজ সে বৃক্ষরা এখন ঢাকার কোথায় কীভাবে আছে সে কৌতুহল মেটানো আর একালের পাঠকদের সঙ্গে ঢাকার সেসব গাছপালা ও প্রকৃতির পরিচয় করিয়ে দিতে এই লেখা। কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় সরেজমিন অনুসন্ধানে তুলে ধরছেন ঢাকার শ্যামলী নিসর্গের সেকাল একাল। ঢাকার প্রাচীন, দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য ও অনন্য পথতরুর বৃত্তান্ত নিয়ে সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বাংলা বারো মাসে বারো পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন আষাঢ় পর্ব।  

সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজে গিয়ে কনকচূড়ার দাপটই বেশি দেখা গেল। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক ভবনের গা বেয়ে ছাদে উঠে গেছে একটি লতানো ব্রাশ ফুলের গাছ। কৃষ্ণচূড়া ও ছাতিম গাছও সেখানে আছে। ঢাকা শহরে গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে আসে বর্ষা, ফুটতে থাকে গাছে গাছে হলদে-সাদা কদম, গোলাপি-সাদা মেঘশিরীষ, সোনারঙ স্বর্ণচাঁপা ও শ্বেতবর্ণা শ্বেতচাঁপা, নানা রঙের সুগন্ধি কাঠগোলাপ ফুলেরা— ফলতে থাকে ফলসা, চালতা, জাম, ডেউয়া, কাঁঠাল, চাপালিশ ইত্যাদি ফল।

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা নটর ডেম কলেজে শিক্ষকতাকালে একাধিক কলেজে পার্ট-টাইম কাজ করতেন। টিকাটুলিতে অভয়দাস লেনের সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজেও পড়াতেন। সেই ক্যাম্পাসের একাংশে নানা রকম বৃক্ষ লাগিয়ে তিনি এক উদ্যান গড়ে তুলেছিলেন। ছোট হলেও সেই উদ্যান তাকে বেশ প্রশান্তি দিত।

তিনি নিজেই সে উদ্যানের প্রশস্তি করেছেন তার ‘জীবনস্মৃতি: মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ বইয়ে। লিখেছেন, ‘‘সেই ক্যাম্পাসের একাংশে আমি একটি ছোট ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন করেছিলাম। ভারি সুন্দর। অনেকদিন কলেজ ছুটি হওয়ার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে যেতাম কলেজে। সবাই চলে গেলে ছাদে গিয়ে বসতাম। নিঃশব্দ চারদিক। পাখিরা উড়ে এসে বাগানের গাছে বসত। সন্ধ্যার সেই সময়টা একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম, যেন ঢাকায় নয়, আছি অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। দক্ষিণ দিকে একসার পেল্টোফোরাম ও কৃষ্ণচূড়া, ভেতরে এক লাইনে দশটি চাঁপাগাছ লাগিয়েছিলাম এবং এক দুটি করে অন্যান্য গাছ— অশোক, নাগেশ্বর, কদম, ছাতিম, নাগলিঙ্গম ও মিলেশিয়া। বন্যার জলে চাঁপাগাছগুলি একবার ফুল ফুটিয়েই মারা যায়, বাকিগুলি আজও আছে।’’

সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজে গিয়ে কনকচূড়ার দাপটই বেশি দেখা গেল। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক ভবনের গা বেয়ে ছাদে উঠে গেছে একটি লতানো ব্রাশ ফুলের গাছ। কৃষ্ণচূড়া ও ছাতিম গাছও সেখানে আছে। ঢাকা শহরে গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে আসে বর্ষা, ফুটতে থাকে গাছে গাছে হলদে-সাদা কদম, গোলাপি-সাদা মেঘশিরীষ, সোনারঙ স্বর্ণচাঁপা ও শ্বেতবর্ণা শ্বেতচাঁপা, নানা রঙের সুগন্ধি কাঠগোলাপ ফুলেরা— ফলতে থাকে ফলসা, চালতা, জাম, ডেউয়া, কাঁঠাল, চাপালিশ ইত্যাদি ফল।

ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: জ্যৈষ্ঠ পর্ব

‘‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’’
কৃষ্ণচূড়া যেমন গ্রীষ্মের প্রতীক, কদম তেমনি বর্ষার। পঞ্জিকার পাতা না দেখেও কদম ফুলের ফোটা দেখে বলে দেওয়া যায়, বর্ষাকাল এসেছে। আষাঢ়-শ্রাবণ দু’মাস বর্ষাকাল। এই বর্ষাকাল ভরে উঠুক বৃষ্টি ও কদম ফুলে সেরকমই প্রত্যাশা কবিদের। ‘বনবাণী’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকালের প্রত্যাশা করেছেন ‘প্রত্যাশা’ কবিতায়:

‘‘অঝোর-ঝরণ শ্রাবণজলে,
তিমিরমেদুর বনাঞ্চলে
ফুটুক সোনার কদম্বফুল
নিবিড় হর্ষণে।’’

আষাঢ়ে বৃষ্টির আগমন নিয়ে আসে কদম ফুলেরা, আমন্ত্রণ জানায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের সেই নবধারা জলে অবগাহনের:

‘‘এসো নীপবনে ছায়াবিথী তলে
এসো করো স্নান নবধারা জলে’’ 

রবীন্দ্রসঙ্গীতে উচ্চারিত এই ‘নীপ’ হলো আমাদের কদম। কিন্তু কবি কালিদাস একই কবিতায় আলাদাভাবে নীপ ও কদমের নাম বলেছেন, ‘‘মুক্তা কদম্ব-কূটার্জ্জুন-সর্জ-নীপান সপ্তচ্ছদানুগতা কুসুমোদ্গমশ্রীঃ’’।

এ কথা ভাবলে খটকাটা থেকে যায়— তাহলে কি নীপ ও কদম দুটি আলাদা গাছ? বাংলা সাহিত্যের কোথায় নেই কদম? লোকগীতি, পল্লীগীতি, বৈষ্ণব পদাবলী, কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস— সব জায়গাতেই রয়েছে কদমের উজ্জ্বল ও সৌন্দর্যময় উপস্থিতি। কবি কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ—

সকলেই করেছেন কদমের স্তুতি। কবি কালিদাস তার ‘ঋতুসংহারম্’ কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে বর্ষার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন:

‘‘কদম বকুল কেতকী কুসুমে গাঁথিয়া মোহন মালিকা
          বিলাসিনীদল আজি কুন্তলে বাঁধে,
কূটজ কুসুম-মঞ্জরী লয়ে রচি বিচিত্র আভরণ
          পরিতেছে তারা কর্ণে কত না ছাঁদে।’’

কি চমৎকার এই বর্ণনা সে কবিতায়, কবিতার চেয়ে পুষ্পসজ্জার ছন্দটাই যেন বেশি— একদিকে বর্ষার আগমন, বর্ষার ফুল ও সেই ফুলে বিলাসিনীদের মনের আনন্দ। ওরা ওদের প্রিয়ের জন্য বর্ষার ফুলগুলো দিয়ে মালা গেঁথে, চুলে ফুল গুজে কি বিচিত্র পুষ্প পোশাকে না সেজেছে! আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগের সাহিত্যেও কদমের আদরণীয় উজ্জ্বল উপস্থিতি আমাদের সত্যিই বিস্মিত করে। বৈষ্ণব ঐতিহ্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রিয় আমাদের কদম গাছ।

জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পাশে কদমগাছ। আলোকচিত্র: লেখক।
কদম ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।
কদম কুঁড়ি। আলোকচিত্র: লেখক।

নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরে কদম কোথায় আছে তা বলতে গিয়ে তিনি তার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘ঢাকার বক্সীবাজার অঞ্চলের সিটি রোডের কদমবীথি বয়স্ক, তবু বিরাট নয়। আকৃতি ও অবয়বে একটি অবক্ষয় স্পষ্ট। অথচ ঢাকার অন্যত্র ইদানীং লাগানো অনেক কদমই বর্ধমান ও বলিষ্ঠ। সম্ভবত ভুল স্থান নির্বাচনের জন্যই সিটি রোডের কদমবিথীর এই বিষ্টব্ধতা।’’

বক্সীবাজারের সিটি রোডে গিয়ে দেখা গেল সেখানকার কদমগাছগুলো এখন আর নেই। কাছেই ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ পথের পাশে রয়েছে কয়েকটা কদম গাছ। তবে কদম বর্তমানে ঢাকা শহরের আরও অনেক স্থানে শোভা পাচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পথপাশে একটি সুদর্শন বৃহৎ কদমবৃক্ষ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কদম গাছ আরও আছে রমনা উদ্যানে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজের প্রাচীরের কোলে, শাহবাগে চারুকলা অনুষদে, মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের গেইটে, এলিফ্যান্ট রোডে সায়েন্স ল্যাবের মধ্যে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, চন্দ্রিমা উদ্যানে।

একসময় কদমের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ছিল Anthocephalus chinensis, Anthocephalus indicus var glabrescens ও Anthocephalus Cadamba ইত্যাদি, গোত্র রুবিয়েসী। ১৭৮৫ সালে জেন-ব্যাপ্টিস্টি ল্যামার্ক এ নামকরণ করেন। গ্রিক শব্দ ‘অ্যান্থোসেপফালাস’ অর্থ মস্তকাকৃতির ফুল, ‘চাইনেনসিস’ অর্থ চৈনিক বা চীনদেশীয়।

কদমকে আমাদের দেশী গাছ মনে হলেও আসলে সে ভারতবর্ষে এসেছে দক্ষিণ চীন থেকে, মতান্তরে মাদাগাস্কার। কদমের বর্তমান উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Neolamarckia cadamba। ইংরেজি নাম Burflower-tree, Leichhardt pine, Kadam, Cadamba ইত্যাদি। এর অন্য বাংলা নাম বল-কদম।

বক্সীবাজারের সিটি রোডে গিয়ে দেখা গেল সেখানকার কদমগাছগুলো এখন আর নেই। কাছেই ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ পথের পাশে রয়েছে কয়েকটা কদম গাছ। তবে কদম বর্তমানে ঢাকা শহরের আরও অনেক স্থানে শোভা পাচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পথপাশে একটি সুদর্শন বৃহৎ কদমবৃক্ষ সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। কদম গাছ আরও আছে রমনা উদ্যানে, লালমাটিয়া মহিলা কলেজের প্রাচীরের কোলে, শাহবাগে চারুকলা অনুষদে, মতিঝিলে নটর ডেম কলেজের গেইটে, এলিফ্যান্ট রোডে সায়েন্স ল্যাবের মধ্যে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, চন্দ্রিমা উদ্যানে।

কদম বা কদম্ব বহু ডালপালাবিশিষ্ট দীর্ঘাকৃতি দ্রুতবর্ধনশীল বহুবর্ষজীবী বৃহৎ বৃক্ষ। ডালপালা ঝুলন্ত। কাণ্ড সরল ও সোজা, বাকল ধূসর থেকে প্রায় কালো ও লম্বালম্বিভাবে বহু ফাটলে খসখসে। পাতা বড় ও ডিম্বাকার। পাতার বোঁটা খাটো। শীতে গাছের পাতা ঝরে যায় ও বসন্তে নতুন পাতা গজায়। বয়স্ক পাতার চেয়ে কচি পাতা বড়।

যাকে আমরা কদম ফুল বলি, আসলে সেটা একটা সুগোল বলের উপর খাড়াভাবে গেঁথে থাকা অনেকগুলো ফুলের সমষ্টিতে একটি পুষ্পমঞ্জরি। মাংসল পুষ্পাধার সুগোল করে মার্বেলের মতো। পূর্ণ ফোটা ফুলের রং সাদা-হলুদে মিশানো। ফল মাংসল ও স্বাদে টক, বাদুড় ও কাঠবিড়ালি পাকা ফল খায়। শুকিয়ে গেলে ফল থেকে বীজ হয়, বীজ থেকে হয় কদমের চারা। ছায়াতরু হিসেবে পথপাশে ও উদ্যানে কদম গাছ লাগানো যায়। গরুও কদমপাতা খায়।

মেঘশিরীষ বা রেইনট্রি
রৌদ্রতপ্ত এক দুপুরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘন নিবিড় শান্ত স্নিগ্ধ শীতল শ্যামল ছায়ায় দু’জন হাঁটছি আর গাছপালা দেখছি। হঠাৎ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের উদ্ভিদ গবেষক ও নিসর্গী আবদুর রহিম একটা গাছের তলা থেকে একটা ফল কুড়িয়ে এনে আমাকে দিয়ে বললেন, ‘‘চকলেট ফ্রুট, খেয়ে দেখুন কেমন মিষ্টি’’। লম্বা কালচে খয়েরি শিমের মতো ফলটা দেখেই চিনতে কষ্ট হলো না যে ওটা রেইনট্রি গাছের ফল।

ফলটা ভেঙ্গে তিনি চকলেটের মতো চুষে খাচ্ছেন দেখে আমিও সাহস পেলাম। ভাঙ্গা ফলের শাঁসে চোষ দিতেই বুঝলাম, কেন তিনি একে বলছেন চকলেট ফ্রুট। সত্যিই চকলেটের মতো আঠালো মিষ্টি শাঁস। রেইনট্রির পাকা ফল যে এত সুস্বাদু হয় আগে কখনও বুঝিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এস.এম. হলের সামনের রাস্তায় কালের সাক্ষী মেঘশিরীষ বা রেইনট্রি গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঘন নিবিড় নবীন পত্রপল্লবের ঠাস বুনুনিতে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে গাছটা, কালো কালো বিশাল থামের মতো গুঁড়ি আর ডালপালা। মানুষরা এ ফল খায় না, এর স্বাদটা আমিও আগে জানতাম না। কিন্তু বানরেরা ঠিকই তা জানে। এজন্য রেইনট্রির পাকা ফল তাদের খুব প্রিয়, প্রচুর খায় তারা। এ কারণে এ ফলের এক ইংরেজি নাম হয়েছে মাংকিপড, তেঁতুলের মতো ফলের গড়ন বলে এর অন্য নাম কাউ ট্যামারিন্ড, রেইনট্রি এ গাছের ইংরেজি নাম।

একসময় ঢাকা শহরে মেঘশিরীষ গাছের যে সংখ্যাধিক্য ছিল তাতে ঢাকাকে বলা যায় ‘সিটি অব রেইনট্রি’। ‘দ্য রেইনট্রি ঢাকা’ নামে ঢাকা শহরে এক অভিজাত হোটেলের নামও রাখা হয়েছে। কথিত যে, ব্রিটিশ আমলে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের জমিদার কালীনাথ বাবু কালিগঞ্জ থেকে কালীঘাট পর্যন্ত যশোর রোডের দু’ধারে প্রচুর রেইনট্রি গাছ লাগিয়েছিলেন তার মা কালীঘাটের মন্দিরে পূজো দিতে যাবেন বলে। যেন সেই যাত্রাপথে তার কোনও রৌদ্রকষ্ট না হয় সেজন্যই এই দ্রুতবর্ধনশীল ছায়াতরুকে পথতরু হিসেবে তিনি রোপণ করেছিলেন।

ফ্যাবেসি পরিবারের রেইনট্রির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম সামানিয়া সামান (Samanea saman), পূর্ব নাম ছিল অ্যান্টারোলোবিয়াম সামান। সামান শব্দটি এসেছে ক্যারিবিয়ান শব্দ জামাং (zamang) থেকে, যার অর্থ মাইমুসোয়ডি ট্রি। তবে ইংরেজি নাম রেইনট্রির অর্থটা খুব স্পষ্ট না, কেউ কেউ বলেন এ গাছ প্রস্বেদনের মাধ্যমে প্রচুর জলীয় বাষ্প উৎপাদন করে বৃষ্টি নামতে সাহায্য করে বলেই এর নাম রেইনট্রি, আবার ছাতার মতো বিশাল গাছ অল্প স্বল্প বৃষ্টি হলে পথিককে তার হাত থেকে রক্ষা করে বলেই এর নাম রেইনট্রি।

এ সবই সাধারণ মানুষের মনের মাধুরী মিশিয়ে বানানো ব্যাখ্যা। বহুকাল ধরে আমরা মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার এই শিরীষ গাছটিকে রেইনট্রি নামে চিনে এসেছি, বাংলা নাম পাইনি। অবশেষে দৈনিক অবজারভারে প্রকাশিত নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার লেখা ‘প্রাইড অব দ্য ট্রিজ’ নিবন্ধে রেইনট্রির বাংলা নাম পেয়েছিলাম মেঘশিরীষ। রেইনট্রি নাম নিয়ে কবিদের মধ্যেও বিভ্রান্তি কম নেই। তামিল কবি ড্যানিয়েল ট্রেভেলিন জোসেফের ‘রেইন-ট্রি’ কবিতাতেও দেখি সেই প্রশ্ন:

‘‘I have not understood why it is called rain-tree:
Are they attracted, peacock-like, to the rain-clouds,
Or does the rain-bird which drinks water straight from heavens
Prefer this tree, and inspire Kalidasa to write Meghdoot?’’

(ভাষান্তর: আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা কেন এ গাছের নাম রেইন-ট্রি, তারা কি মেঘ-বাদলের কাছে ময়ূরের মতো আকৃষ্ট হয়, অথবা চাতক পাখির মতো মেঘ থেকে স্বর্গীয় বারিধারা পান করে, নাকি এ গাছকেই পছন্দ করে কবি কালিদাস তার মেঘদূত কাব্য লিখতে উৎসাহিত হয়েছিলেন?)

একসময় ঢাকা শহরে মেঘশিরীষ গাছের যে সংখ্যাধিক্য ছিল তাতে ঢাকাকে বলা যায় ‘সিটি অব রেইনট্রি’। ‘দ্য রেইনট্রি ঢাকা’ নামে ঢাকা শহরে এক অভিজাত হোটেলের নামও রাখা হয়েছে। কথিত যে, ব্রিটিশ আমলে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের জমিদার কালীনাথ বাবু কালিগঞ্জ থেকে কালীঘাট পর্যন্ত যশোর রোডের দু’ধারে প্রচুর রেইনট্রি গাছ লাগিয়েছিলেন তার মা কালিঘাটের মন্দিরে পূজো দিতে যাবেন বলে। যেন সেই যাত্রাপথে তার কোনও রৌদ্রকষ্ট না হয় সেজন্যই এই দ্রুতবর্ধনশীল ছায়াতরুকে পথতরু হিসেবে তিনি রোপণ করেছিলেন।

রমনা উদ্যানে লেকের পাড়ে বিশাল মেঘশিরীষ বা রেইনট্রি গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনের পাশে প্রাচীন মেঘশিরীষ বা রেইনট্রি গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

মহীরুহের রূপ ধারণ করা সেসব গাছ দু’বছর আগেও দেখেছি, বেনাপোলের রাস্তায়ও দেখেছি। সড়ক সম্প্রসারণের নামে সেসব ঐতিহাসিক প্রাচীন গাছগুলো ধীরে ধীরে কেটে ফেলা হচ্ছে আর আমাদের মাথার ওপর থেকে মেঘশিরীষ গাছের ছায়াগুলোও সরে যাচ্ছে।

ঢাকা শহরের গাছও কাটা পড়ছে। ঢাকা শহরকে রেইনট্রির শহর বলা হতো, এখন আর ঢাকার সে খেতাব থাকবে কিনা সে সংশয়ও দেখা দিয়েছে।

দ্বিজেন শর্মা ঢাকা শহরের রেইনট্রি সম্পর্কে তার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘সংখ্যাধিক্য ও বিশালতায় বট ও অশ্বত্থের পর এই শহরে রেইনট্রিই উল্লেখ্য। উচ্চতা ও ব্যপ্তির আভিজাত্যে তরুরাজ্যে সে বিশিষ্ট। দিগন্তের পারে ঘনবিন্যস্ত রেইনট্রির সমারোহ যেন বিশাল অরণ্যের ছায়া। ঢাকার বহু পথ এ তরুতে আচ্ছাদিত। এস.এম. হলের সামনের ফুলার রোডের রেইনট্রির ছায়াচ্ছন্ন অংশটিকে অনেকটা তোরণের মতোই দেখায়। পিলখানা, পার্ক অ্যাভিনিউ, তোপখানা রোড এবং আরও অনেক জায়গায়ই এই গাছের প্রচন্ড অস্তিত্ব চোখে পড়ে।’’

১৯৬৫ সালে দ্বিজেন শর্মার দেখা ঢাকা শহরে এস.এম. হলের শতবর্ষী রেইনট্রি গাছগুলো এখনও সে এলাকার শোভা বাড়িয়ে চলেছে, পথিককে ছায়া দিচ্ছে।

লেখক জহুরুল হক তাঁর ‘সুখে-দুঃখে আমি, ঢাকার গাছপালা’ নিবন্ধে প্রায় ৬০-৭০ বছর আগে ঢাকা শহরে দেখা রেইট্রির যে বন্দনা ও তার সারল্য প্রকাশ করেছেন তা এক কথায় অসাধারণ। নিবন্ধের একটি অংশে তিনি লিখেছেন, ‘‘… বটগাছের মতো বিরাট গাছ, কিন্তু বটগাছ নয়। ছোট পাতা, কলি সবুজ। শীতের ধোঁয়াটে সন্ধ্যেয় দূর থেকে দেখলে পাহাড় বলে ভুল হয়। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনের রাস্তায় দুই ধারে দুই সার, ঐ পথে ঢুকলে যেন মনে হয় বিশাল তোরণের তলায় ঢুকে পড়লাম। ঢাকার নতুন বাসিন্দা যুবকটি— এই গাছের নাম শুনেছিল, আগে দেখে নি। শহরের আরও কয়েক জায়গায় এদের দেখা যায়। যুবক প্রায় ত্রিশ বছর পরে দ্বিজেন শর্মার বই শ্যামলী নিসর্গ পড়ে নিশ্চিত হয় ও কৃতজ্ঞ বোধ করে; এরাই রেইনট্রি, দক্ষিণ আমেরিকার ঘন জঙ্গল থেকে এসেছিল কতোকাল আগে কে জানে;- এখন এতো ছড়িয়ে পড়েছে কিছুটা অনুকূল আবহাওয়ায় যে ভেজা বাংলাদেশের আপন গাছই হয়ে গেছে।’’

এই যুবকটি আর কেউ না— স্বয়ং তিনি। এই দু’জনের বর্ণনা পড়ে এস.এম. হলের সামনে ফুলার রোডে ছুটে যাই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পাশে ওই রাস্তাটা এসে মিশেছে পলাশীতে। দৃষ্টি নন্দন এস.এম. হলের প্রবেশ পথের সামনে ও রাস্তার ওপারে আর এক সারি রেইনট্রি গাছ এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মেঘশিরীষ বা রেইনট্রি ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।
রেইনট্রির ডাল ও পাতা। আলোকচিত্র: লেখক।

তবে শতবর্ষী দুটি বিশাল রেইনট্রি গাছের দেখা পেয়েছি ওই ফুলার রোডের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের পাশে ‘স্মৃতি চিরন্তন’ সৌধের সামনে একটি ও রমনা পার্কের ভেতরে লেকের দক্ষিণ পাশে অন্যটি। চন্দ্রিমা উদ্যানে উড়োজাহাজ মোড়ের কোনায় বিজয় সরণি মেট্রো স্টেশনের ঠিক আগে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে ও ঢাকা প্রেস ক্লাবের মধ্যেও আছে প্রাচীন রেইনট্রি গাছ।

মেঘশিরীষ গাছ বাড়ে খুব দ্রুত, সেজন্য গাছের আকার দেখে এর সঠিক বয়সের পরিষ্কার ধারণা পাওয়া মুশকিল। বয়স্ক গাছের কাণ্ড বিশাল ও ছড়ানো, বাকলের রঙ কালচে, খসখসে, অজস্র ফাটলে ভরা। কাণ্ড দেখতে অনেকটা পোড়া কাঠের মতো। পাতা যৌগিক, পত্রদণ্ডের দুপাশে আয়ত ডিম্বাকার পত্রগুলো সাজানো থাকে। রাতের বেলায় পত্রকগুলো ভাঁজ হয়ে থাকে।

সকালবেলা রোদের তাপ পেলে আবার মেলতে শুরু করে। শীতকালে গাছের সব পাতা ঝরে যায়, বসন্তে নতুন পাতা আসে ডালপালা ভরে। প্রথম বর্ষণে অর্থাৎ আষাঢ়ে সে গাছ পূর্ণ যৌবনা, পত্র-পল্লব-পুষ্প-ফল শোভিত। পুষ্পমঞ্জরিতে হালকা গোলাপি রঙের ক্ষুদ্র ফুল ফোটে অজস্র কেশর মাথায় নিয়ে। ফল চ্যাপ্টা শিমের মতো, দীর্ঘ, ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকা, কচি ফল সবুজ, পাকলে হয় চকলেটের মতো খয়েরি-কালো রঙ। পাকা ফলের শাঁস মিষ্টি হওয়ায় তা কাঠবিড়ালি ও  বানরদের খুব প্রিয়। বীজ থেকে সহজে চারা হয়। সস্তা কাঠের গাছ হিসেবে এ দেশে মেঘশিরীষ অত্যন্ত জনপ্রিয়।

শিরীষ
শিরীষ আর রেইনট্রি গাছ নিয়ে প্রায়ই গোলমাল বাধে। দুটি গাছ এক না। রেইনট্রি গাছের বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে মেঘশিরিষ। শিরীষ ও মেঘশিরিষ গাছের সহজ পার্থক্যটা ধরা পড়ে ফুলে ও ফলে। শিরীষের ফুল সাদা ও সুগন্ধযুক্ত, মেঘশিরিষের ফুল গোলাপি ও গন্ধহীন। মেঘশিরীষের ফল কালচে, সরু ও ছোট। শিরীষের ফল বাদামি, চওড়া ও বড়। শিরীষ ফুলের সেই ঘ্রাণ পাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের রিক্তের বেদন গ্রন্থের স্বামীহারা গল্পে।

শিরীষ ফুলের সেই সুবাস যেন গোরস্থানে প্রজ্জ্বলিত আগরবাতির মতো ঘ্রাণ হয়ে বাতাসে ভেসে আসে। সেই সুগন্ধে যোগ দিয়েছে শেফালি আর হেনা ফুলের সুবাস।  গল্পের সেই চিত্রকল্পটি বেশ চমৎকার:

‘‘রাত্তিরে শিরীষ ফুলের পরাগমাখা ঐ যে একটানা হু হু শব্দ, ওকি তারই বর-অঙ্গের সুবাস? গোরস্থানের সমস্ত শিরীষ, শেফালি আর হেনার গাছগুলো ভিজিয়ে, সবুজ দুর্বা আর নীল ভুঁই-কদমের গাছগুলোকে আর্দ্র করে ঐ যে সন্ধ্যে হতে সকাল পর্যন্ত শিশির ক্ষরে, ওকি তাঁরই গলিত বেদনা?’’

শিরীষ ফুলের শুধু সুগন্ধ না— কবি নজরুলের গানে রয়েছে আর এক ধ্রুপদী সঙ্গীতের মাদকতা, রয়েছে নৃত্যরতার নুপুরের রিনিঝিনি—

‘‘শিরিষ পাতায় ঝিরিঝিরি, বাজে নূপুর তারি
সোনাল ডালে দোলে তাহার কামরাঙা রঙ শাড়ি।’’

কবি নজরুল শিরীষ ফুলের রূপে দেখেছেন কোমল-পেলবতাও। সংস্কৃত কবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যে শিরীষ ফুলকে বলেছেন চারুকর্ণের অলংকার। এ সবকিছুরই এক অবাক দৃশ্যগন্ধ পেলাম এক ভোরে ঢাকার ধানমন্ডি লেকের পার্কে হাঁটতে গিয়ে। একটা রেস্তোরাঁ পেরিয়ে সেতুর উপর উঠতেই আষাঢ়ের ভোরে সেই শিরীষ ফুলের সুবাস ভেসে এল, চোখ উপরে তুলে তাকাতেই সবুজাভ সাদা ফুলগুলোর অপরূপ রূপ মন ভরিয়ে দিল।

শিরীষ আর রেইনট্রি গাছ নিয়ে প্রায়ই গোলমাল বাধে। দুটি গাছ এক না। রেইনট্রি গাছের বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে মেঘশিরীষ। শিরীষ ও মেঘশিরীষ গাছের সহজ পার্থক্যটা ধরা পড়ে ফুলে ও ফলে। শিরীষের ফুল সাদা ও সুগন্ধযুক্ত, মেঘশিরীষের ফুল গোলাপি ও গন্ধহীন। মেঘশিরীষের ফল কালচে, সরু ও ছোট। শিরীষের ফল বাদামি, চওড়া ও বড়। শিরীষ ফুলের সেই ঘ্রাণ পাই কবি নজরুল ইসলামের রিক্তের বেদন গ্রন্থের স্বামীহারা গল্পে।
শিরীষের ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।

দুটি তরুণ শিরীষ গাছের দেখা পেলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, অন্যটি লালমাটিয়া মহিলা কলেজের সীমানা প্রাচীরের কোলে। ১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরে শিরীষ গাছের অবস্থান সম্পর্কে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা লিখেছেন, ‘‘পরিণত শিরীষ বিশাল তরু। কিন্তু ঢাকার এই গাছ সবই স্বল্পবয়স্ক এবং এজন্য জিপিও’র পশ্চিম, কারওয়ানবাজার এবং কুর্মিটোলার পথের পাশে শিরীষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিছু বয়সী শিরীষ আছে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুলের চত্বরে আওরঙ্গজেব রোডের কোলঘেঁষে।’’

দ্বিজেন শর্মার ধারণা, প্রাউডলক তার ঢাকা শহরের বৃক্ষরোপণ পরিকল্পনায় হয়তো শিরীষকে বর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগানো হয়। সে কারণে এসব গাছ তরুণ। জিপিও’র কাছের শিরীষ গাছগুলো এখন নেই।

শিরীষ বহুবর্ষজীবী পত্রঝরা প্রকৃতির বৃক্ষ, শীতকালে পাতা ঝরে যায়। গাছটি ১৮-৩০ মিটার লম্বা হয়। পাতা যৌগিক ও পত্রদণ্ডের দু’পাশে পত্রকগুলো সজ্জিত থাকে। ফুল সাদা, অসংখ্য সুতার মতো লম্বা পুরুষ কেশরবিশিষ্ট। দেখতে ব্রাশের মতো দেখায়। অত্যন্ত সুগন্ধ, রাতে ফোটে ও সুগন্ধ ছড়ায়। বসন্ত থেকে শিরীষের ফুল ফোটা শুরু হয়, বর্ষাকালেও ফুল ফোটে।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বসন্তে দেখেছিলেন শিরীষ ফুল ফোটার উচ্ছ্বাস:

‘‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসে
কী উচ্ছ্বাসে
ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা।’’

শিরীষের ফুল ফোটে যেন ক্লান্তিহীনভাবে, রোজ ফুটছে তো ফুটেই যাচ্ছে। উজ্জ্বল চকচকে সবুজ ঘন পত্রপল্লবের ভেতরে অসংখ্য ফুল ফুটে গাছ আলো করে ফেলে। দিনে ফোটা ফুল দিন শেষে ঢলে পড়ে। এরপর তার শুরু হয় ফল গঠনের পালা। ফল শিমের মতো চ্যাপ্টা ও ১৫-৩০ সেন্টিমিটার লম্বা, একটি ফলে গড়ে ১২টি বীজ থাকে। শিরীষ আমাদের দেশী গাছ। পথতরু ও উদ্যানতরু হিসেবে লাগানো যায়, দারুমূল্য আছে।

শিরিষের ইংরেজি নাম Siris, Indian siris, East Indian walnut, Broome raintree, lebbeck, lebbek tree, frywood, koko, woman’s tongue tree, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Albizia lebbeck (L.) Benth. ও গোত্র Fabaceae। ইতালীয় তরুবিদ অ্যালবিজির নামের স্মারক এর প্রজাতিগত নামের প্রথমাংশ, লেবেক আরবি নাম।

খেজুর
ঢাকা শহরে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকাটির এক সময় নাম ছিল খেজুর বাগান। এখনও সেখানে মণিপুরীপাড়ার মধ্যে খেজুরবাগান মসজিদ সে নামের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। এলাকাটির এরূপ নামের পিছনে রয়েছে অন্য এক ইতিহাস।

একসময় ওই জায়গাটি ছিল মণিপুরী ফার্ম, ফার্মের মধ্যে ছিল একটা খেজুর বাগান। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ১৯৬৫ সালেও তার কিছুটা দেখেছিলেন, শ্যামলী নিসর্গে তিনি তেজগাঁও এলাকায় থাকা খেজুর গাছের উল্লেখ করেছেন। খেজুর বাগানের সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছে গণপূর্ত বিভাগ। জাতীয় সংসদ ভবনের সেই এলাকাটিতে পরবর্তীকালে অনেকগুলো দেশী খেজুর গাছ লাগিয়ে একটি সুদর্শন খেজুরবিথী তৈরি করা হয়েছে।

জাতীয় সংসদ ভবনের পূর্বপাশে খেজুরবিথী। আলোকচিত্র: লেখক।
জাতীয় সংসদ ভবনের পূর্বপাশে খেজুরবিথীর ভেতরের অংশ। আলোকচিত্র: লেখক।

জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে উত্তর প্রান্তে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর পাশে ফুটপাতের উপরেই রয়েছে কয়েকটি তরুণ খেজুর গাছ ও ফিশটেইল পাম বা কিতুল গাছ। এছাড়া ঢাকা শহরে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খেজুর গাছ। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টলের মধ্যে কয়েকটি চমৎকার স্বাস্থ্যবান ফলবতী খেজুর গাছ হোটেলের সামনের অংশে শোভা বাড়িয়েছে। রমনা পার্কের মধ্যে পূবদিকে মৎস্য ভবনের কাছাকাছি আছে কয়েকটি রুগ্ন খেজুর গাছ, যত্নের অভাবে ধুঁকছে।

টিকাটুলীতে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের মন্দিরের সামনে এক পায়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে একটি নিঃসঙ্গ খেজুরগাছ। গাছটি অনেক লম্বা, জ্যৈষ্ঠ মাসে তার মাথায় খেজুরও দেখেছি। সারা গায়ে এপাশ ওপাশ করে কাটা ক্ষত চিহ্ন। আসলে ওগুলো বর্ষদাগ। গাছ কেটে খেজুরের রস নামানো হলে এরূপ খাঁজ খাঁজ বর্ষচিহ্ন তৈরি হয়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১৭ সালে হর্টিকালচার সেন্টারসমূহের মাধ্যমে আরবি খেজুর চাষের সম্প্রসারণ কার্যক্রম শুরু করে। এই আরবি খেজুর গাছটিও সে সময় খামারবাড়ি চত্বরে রোপণ করা হয়, এই সাত বছরে গাছটি অনেক বড় ও পুষ্প-ফলবতী হয়েছে।

একসময় ওই জায়গাটি ছিল মণিপুরী ফার্ম, ফার্মের মধ্যে ছিল একটা খেজুর বাগান। নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা ১৯৬৫ সালেও তার কিছুটা দেখেছিলেন, শ্যামলী নিসর্গে তিনি তেজগাঁও এলাকায় থাকা খেজুর গাছের উল্লেখ করেছেন। খেজুর বাগানের সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করেছে গণপূর্ত বিভাগ। জাতীয় সংসদ ভবনের সেই এলাকাটিতে পরবর্তীতে অনেকগুলো দেশি খেজুর গাছ লাগিয়ে একটি সুদর্শন খেজুরবিথী তৈরি করা হয়েছে।

খেজুর গাছ অ্যারিকেসি পরিবারের ফনিক্স (Phoenix) মহাজাতি বা গণভুক্ত। এ গণের ১৪টি প্রজাতির গাছ সারা পৃথিবীতে রয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ— ফনিক্স সিলভেসট্রিস (Phoenix sylvestris) প্রজাতির দেশী বা জংলী খেজুর ও ফনিক্স ডেকটাইলিফেরা (Phoenix dactylifera) প্রজাতির গাছ আরবি খেজুর, সৌদি খেজুর বা পিণ্ড খেজুর নামে পরিচিতি।

এছাড়াও আছে খুদি খেজুর, ভূ-খেজুর বা বন খেজুর (Phoenix acaulis), কোলা খেজুর (Phoenix rupikola) ও হেতাল খেজুর (Phoenix paludosa)। হেতাল খেজুর জন্মে সুন্দরবনে। প্রথমোক্ত প্রজাতির গাছ রস ও দ্বিতীয় প্রজাতির গাছ থেকে সুমিষ্ট ফল পাওয়া যায়।

খেজুর গাছ একবীজপত্রী, এক লিঙ্গ বিশিষ্ট বৃক্ষ। অর্থাৎ পুরুষ ও মেয়ে গাছ আলাদা। মেয়ে গাছে ফল ধরে। শাখাহীন গাছ লম্বা হয় প্রায় ৪-১৫ মিটার। গাছের বাকল সদৃশ আবরণে পত্রবৃন্তের দাগ সমস্ত কাণ্ডকে জড়িয়ে থাকে।

দেশী খেজুর গাছ বেশ দ্রুত বর্ধনশীল, শাখাবিহীন একটি কাণ্ড বিশিষ্ট গাছ। দেশী খেজুর গাছের গোড়াটা থাকে মোটা ও স্তূপের মতো শিকড় থাকে। কাণ্ডে পাতা ঝরে যাওয়ার পরও পত্রখোলের ভিত্তি অংশ কাণ্ডের সঙ্গে লেগে থাকে যা খেজুর গাছকে বাড়তি সৌন্দর্য দান করে।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের প্রাঙ্গণে খেজুরগাছ। আলোকচিত্র: লেখক।
খামারবাড়ির মধ্যে আরবি খেজুর গাছের উপরের অংশ। আলোকচিত্র: লেখক।
খামারবাড়ির মধ্যে আরবি খেজুর গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

পাতা পক্ষল, দণ্ডের দু’দিকেই হয়, অগ্রভাগ সূঁচালো, গোড়ায় তীক্ষ্ণ শক্ত কাঁটা। গাছের মাথায় পত্রগুচ্ছ নারকেল-সুপারি গাছের মতো জন্মে। চৈত্র মাসে ফুল ফোটে। কাঁদিতে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ফোটে। পুরুষ ফুল সাদা ক্ষুদ্রাকার।

ফল হয় গ্রীষ্মকালে। ফল প্রায় ডিম্বাকৃতি, হলুদ রঙের, লম্বায় প্রায় ২.৫ সেন্টিমিটার। ভেতরে হালকা বাদামি রঙের একটি বীজ থাকে। বীজের উপরে পাতলা আবরণের মতো শাঁস থাকে। কাঁচা শাঁস কইষট্যা-নোনতা। কিন্তু পাকলে তা বেশ মিষ্টি হয়। পাকা খেজুরের রং লালচে বাদামি থেকে খয়েরি হয়। পাকা খেজুর গ্রাম বাংলার শিশুদের কাছে খুব প্রিয়।

দেশী খেজুরকে চিনি বা গুড় উৎপাদনকারী ফসল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। খেজুর গাছের প্রধান ব্যবহার রস ও গুড় উৎপাদন করা। তবে এর ফলও খাওয়া যায়। দেশি খেজুরের ফল খুব নিম্নমানের হওয়ায় তা ফল হিসেবে অনেকেই খায় না। দেশী খেজুরের শাঁস পাতলা, বিচি বড়, পাকা ফলের সংরক্ষণ ক্ষমতা খুবই কম। তবু পাকা ফলের সুমিষ্ট গন্ধ ও মিষ্টি স্বাদ অনেককেই আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের।

খেজুরের রস থেকে গুড় ও চোলাই মদ বা বিয়ার তৈরি করা যায়। স্থানীয়ভাবে তৈরি করা এই মদকে ‘তাড়ি’ বলা হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে গাছের মাথার দিকে কাণ্ড চেঁছে রস নামানো হয়। কোথাও কোথাও না ফোটা পুষ্পমঞ্জরীর ডাটি কেটে রস নামানো হয়। রসের উৎপাদন গড়ে গাছপ্রতি ৫ লিটার। বীজ দিয়েই খেজুরের বংশবৃদ্ধি হয়।

স্বর্ণচাঁপা ও শ্বেতচাঁপা
শ্বেতচাঁপা আর স্বর্ণচাঁপা আত্মজ ফুল, দুটি ফুল একই গোত্রের, এক মহাজাতির। শ্বেতচাঁপা ফুলের রঙ সাদা, স্বর্ণচাঁপার ফুলের রঙ হলুদ বা ফিকে কমলা। একই পরিবারের এ দু’রকমের গাছ চন্দ্রিমা উদ্যানের পশ্চিম অংশে এখন শোভিত হচ্ছে বৃষ্টিস্নাত নবপত্রপল্লবপুষ্পে— যেন ‘‘স্বর্ণবন সমুজ্জ্বল নবচম্পাদলে’’।

গ্রীষ্মের শুরুতেই এই গাছগুলোতে ফুটতে শুরু করেছে ফুলেরা। উদ্যানের এই অংশে বেশ কয়েকটি স্বর্ণচাঁপার গাছ। এর ভেতরে চারটি গাছ গুচ্ছ করে লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি থাকা সেই চারটি গাছে ফুটেছে সাদা রঙের চাঁপা ফুল। ফুলের রঙ সাদা হলেও গাছ ও পাতার চেহারা স্বর্ণচাঁপার মতো প্রায় একই রকম। তবে ফুলের পাঁপড়ি স্বর্ণচাঁপার চেয়ে কিছুটা সরু ও ঘ্রাণ কম। স্বর্ণচাঁপার চেয়ে শ্বেতচাঁপা গাছের পাতাও কিছুটা সরু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলের পাশে প্রাচীন স্বর্ণচাঁপা গাছ ফুলে ফুলে পূর্ণ। আলোকচিত্র: লেখক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্জন হলের পাশে প্রাচীন স্বর্ণচাঁপা গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।

স্বর্ণচাঁপার চেয়ে শ্বেতচাঁপার ফুল একটু বেশিদিন ধরে ফোটে স্বর্ণচাঁপার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Magnolia champaca, পূর্বে নাম ছিল Michelia champaca। শ্বেতচাঁপারও উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম একই, সাদা রঙের কারণে এর প্রজাতিগত নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘এলবা’ শব্দটি। পরিবার ম্যাগনোলিয়েসি। এ ফুলের ইংরেজি নাম Champak, এ নামটা এসেছে সংস্কৃত নাম চম্পকা থেকে।

শ্বেতচাঁপা চিরসবুজ বৃক্ষ। বাকল ধূসর ও মসৃণ। পাতার অগ্রভাগ সূঁচালো, বড় ও গাঢ় সবুজ। প্রায় গোলাকার গুটির মতো ফল ধরে থোকা ধরে। ফল কাকের খুব পছন্দ। ফলের বীজ থেকে চারা হয়। বীজ থেকে লাগানো গাছে ফুল আসতে ৮ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। সুগন্ধি ফুল ও আসবাবপত্র তৈরির কাঠের জন্য চাঁপাগাছের কদর রয়েছে। গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ফুলের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। স্বর্ণচাঁপা ও শ্বেতচাঁপার জন্ম ভারত, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়ায়। এসব দেশ ছাড়া বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, চীন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে স্বর্ণচাঁপা গাছ আছে।

শ্বেতচাঁপা ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।
চাঁপা গাছ লাগিয়েছে তারা ফুলের জন্য নয়— দামী কাঠের জন্য। সারযুক্ত বাদামী নরম কাঠে নকশা তোলা সহজ আর পালিশ উত্তমভাবে করা যায় বলে আসবাবপত্র তৈরির জন্য কাঠের মূল্য বেশি। কাঠ নরম হলেও খুব টেকসই। তবে আমি দেখছিলাম তখন চাঁপা ফুলের রূপ। বর্ষা দিনে গাছ ভরে কেমন ফুটে ছিল চাঁপা ফুল! চাঁপা বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ই টের পাওয়া যায় যে সেখানে ফুল ফুটেছে। সুগন্ধে চারদিকে আমোদিত করে তোলে।

এ দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বর্ণচাঁপার গাছ বেশ দেখা যায়, শ্বেতচাঁপা খুব কম দেখা যায়। ওখানে স্বর্ণচাঁপা গাছ লাগানো হয়। ময়মনসিংহে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির সামনে একটা প্রাচীন শ্বেতচাঁপা গাছ আছে। প্রায় সাতাশ বছর আগে খাগড়াছড়ির রামগড়ে টিলার ঢালে ঢালে অসংখ্য চাঁপা ফুলের বাগান দেখে খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলাম। এভাবে মানুষেরা শত শত চাঁপা ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগান গড়ে তুলতে পারে? ওখানকার লোকেরা চাঁপাকে বলে চাম্পা ফুল।

পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, চাঁপা গাছ লাগিয়েছে তারা ফুলের জন্য নয়— দামী কাঠের জন্য। সারযুক্ত বাদামী নরম কাঠে নকশা তোলা সহজ আর পালিশ উত্তমভাবে করা যায় বলে আসবাবপত্র তৈরির জন্য চাঁপাকাঠের মূল্য বেশি। কাঠ নরম হলেও খুব টেকসই। তবে আমি তখন দেখছিলাম চাঁপা ফুলের রূপ। বর্ষা দিনে গাছ ভরে কেমন ফুটে ছিল চাঁপা ফুল! চাঁপা বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ই টের পাওয়া যায় যে সেখানে ফুল ফুটেছে। সুগন্ধে চারদিকে আমোদিত করে তোলে।

ফুল পুরোপুরি ফুটলে বর্শার ফলার মতো পাঁপড়ি চারদিকে তারার মতো মেলে পড়ে। ডালের মাথায় ফুল ফোটে এক বা একাধিক। ফুল ঝরে গেলে চাঁপা গাছ থোকা থোকা ফলে ভরে ওঠে। এই ফল পাখির খুব প্রিয় খাদ্য। গাছ মধ্যমাকৃতির বৃক্ষ, বর্শা ফলার মতো বড় পাতা। কাণ্ড সরল, মসৃণ  ও ধূসর রঙের। যত ডালপালাই হোক, মূল কাণ্ডটি ঠিকই সোজাভাবে বাড়তে থাকে। বীজ থেকে চাঁপার চারা জন্মানো সহজ। তবে গুটি কলম করেও চাঁপার চারা তৈরি করা যায়। চাঁপা ফুলের জন্মস্থান বাংলাদেশ, ভারত ও মালয়েশিয়ার উচ্চ অঞ্চল।

ঢাকা শহরে চাঁপা গাছের হদিস দিতে গিয়ে দ্বিজেন শর্মা তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে আমরা একসার চাঁপা গাছ লাগাই। … জুন মাসের এক সকালে কলেজে গিয়ে দেখলাম সব কটি চাঁপা গাছ ফুলে ফুলে ভরে গেছে, মধুগন্ধ ছড়িয়ে আছে সারা কলেজে, দোতলার বারান্দায়, তিনতলার ক্লাসঘরে এবং প্রবল ঢেউয়ের মতো।’’

স্বর্ণচাঁপা ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।
স্বর্ণচাঁপা ফল। আলোকচিত্র: লেখক।

১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরে হাটখোলা ও ডেমরা রোডের সংযোগস্থলে, সিদ্ধেশ্বরী ও সেগুনবাগিচায় তিনি চাঁপা দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। অভয় দাস লেনে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে গিয়ে পেলাম না কোনও চাঁপা গাছের দেখা। সেগুনবাগিচায় দু’একটি চাঁপা গাছ দৈবাৎ চোখে পড়ে। ধানমন্ডি সেন্ট্রাল রোডে ৫৯ নম্বর বাড়ির গেটের কাছে রয়েছে একটি বৃহৎ স্বর্ণচাঁপা গাছ। এর চেয়েও বড় আর একটি স্বর্ণচাঁপা গাছ আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগে যেতে ডান কোনাটায়। সুন্দর জীবন্ত গাছের হেজ বা বেড়া তৈরি করে তাকে মর্যাদাবান ও সুরক্ষিত-সুরম্য করা হয়েছে।

বৈশাখ থেকেই দেখছি গাছে প্রচুর ফুল ফুটছে। চন্দ্রিমা উদ্যান, রমনা উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও আছে চাঁপাগাছ। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের পুকুরের পাড়ে প্রাচীরের কোল দিয়ে লাগানো এক সারি চাঁপাগাছ পথের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে।

পথের দু’ধারে পথতরু হিসেবে শ্বেতচাঁপার গাছ লাগানো যায়, বিভিন্ন পার্ক বা উদ্যানের শোভা বাড়ানোর জন্যও লাগানো যেতে পারে।

শ্বেতচাঁপা ও স্বর্ণচাঁপা দুটি ফুলই পূজায় লাগে। বিশেষ করে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ আরাধনায় এই ফুলকে পবিত্র ফুল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কামদেবের পঞ্চশরের একটি ফুল হলো চম্পা বা চাঁপা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও চাঁপাকে অমর করে রেখেছেন তাঁর কবিতায়:

‘‘চাঁপার কলি চাঁপার গাছে,
সুরের আশায় চেয়ে আছে।’’

জানিনা কোনও প্রকৃতি শিল্পী এগিয়ে আসবেন কি না ঢাকা শহরের পথে পথে— স্কুলে স্কুলে স্বর্ণচাঁপার গাছ লাগিয়ে সুরভী-সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা দিয়ে ভরিয়ে দিতে।

মহাবৃক্ষ তেলশুর
শালের মতোই তেলশুর এ দেশের এক অরণ্যবৃক্ষ। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের অরণ্যে ওদের বেশি দেখা যায়। ঢাকা শহরে তার থাকার কথা না। তারপরও ঢাকা শহরে কয়েকটি স্থানে তেলশুর গাছের সগর্ব উপস্থিতি আমাদের সে অরণ্যবৃক্ষ দর্শনের স্বাদ পাইয়ে দেয়।

বিশেষ করে মৎস্য ভবনের কোণ থেকে কাকরাইল মসজিদের প্রান্ত পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে অনেকগুলো প্রাচীন তেলশুর গাছ মোটা মোটা থামের মতো কালো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় একই সময়ে লাগানো একটি তেলশুর গাছ রয়েছে মৎস্য ভবন প্রান্তের গেট দিয়ে ঢুকেই রমনা উদ্যানের ভেতরে, বাম দিকে।

ধারণা করা হয়, রমনা উদ্যানের গোড়া পত্তনের সময় রমনা এলাকা ও তার আশেপাশের কিছু এলাকায় প্রাউডলক বিদেশ থেকে এনে এ গাছগুলো সেখানে লাগিয়েছিলেন চমৎকার পথতরু হিসেবে। সে হিসেবে এসব এলাকার তেলশুর গাছগুলো শতবর্ষী।

রমনা উদ্যানে তেলশুর গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।
বছরে কয়েক দফায় ফুল ফুটলেও সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে গ্রীষ্মে। ফুটন্ত ফুল থেকে ধূপের ধোঁয়ার মতো গন্ধ আসে। এজন্য এ গাছের আর এক নাম ধুনা গাছ। গ্রীষ্মের পর বর্ষার শুরুতে প্রচুর ফলধরা গাছের সৌন্দর্য হয় দেখার মতো। তেলশুর কাঠ খুব মজবুত, শক্ত ও ভারি, ভালো পালিশ নেয়, ঘুণে ধরে না ও উঁই পোকায় নষ্ট হয় না। বীজ থেকে যেহেতু সহজে চারা হয়, শক্ত গাছ বলে ঝড়ে সহজে ভাঙে না— তাই এ গাছটিকে ঢাকা শহরের পথতরু হিসেবে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

জ্যৈষ্ঠের এক সকালে সে গাছের নীচে পড়ে থাকতে দেখলাম অনেকগুলো ডানাওয়ালা ফল ও বীজ, ঝড়ো হাওয়ায় ঝরে পড়েছে। বৃষ্টির জোলো পরশে সেসব বীজ অংকুরিত হতে শুরু করেছে। উপরে তাকিয়ে দেখি, থোকা ধরে ডালের সঙ্গে লালাভ-সবুজ ডানাওয়ালা ফলগুলো মৃত্তিকামুখী হয়ে ঝুলছে, যেন সেগুলো কোনও মেঘবালিকার কানের দুল।

বিক্ষিপ্তভাবে হলেও এরূপ আর একসারি তেলশুর গাছ দেখা যায় ধানমন্ডি-৫ নম্বর সড়কের পাশে। বহুকাল আগে থেকেই সেখানে সারি করে লাগানো বেশ কয়েকটি তেলশুর গাছ এখনও শোভা দিচ্ছে।

দ্বিজেন শর্মা ১৯৬৫ সালে ঢাকা শহরে তেলশুর গাছের অবস্থান সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের উত্তরে অর্ধবৃত্তাকার ফুলার রোডের যে অংশ আনবিক গবেষণা কেন্দ্রের কাছে বক্সীবাজার রোডে গিয়ে মিশেছে তার দু’পাশের ছায়াঘন উদ্ধত তরুবিথীটি তেলশুর গাছের।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের বাসভবনের কাছে স্মৃতি চিরন্তন সৌধের কোলে ফুলার রোডে সেই স্মৃতির স্মারক হয়ে একটি বিরাট তেলশুর গাছ এখনও ডালপালা ও পাতা ঝুলিয়ে সে রোডে আসা পথিকদের অভিবাদন জানিয়ে যাচ্ছে।

সেই অভিবাদনের ভাষা যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানতেন:

‘‘ওগো মহাশাল তুমি সুবিশাল কালের অতিথি,
আকাশেরে দাও সঙ্গ বর্ণরঙ্গে শাখার ভঙ্গিতে
বাতাসেরে দাও মৈত্রীপল্লবের মর্মর সংগীতে
মঞ্জরির গন্ধের গণ্ডুষে।’’

তেলশুর ফুল। আলোকচিত্র: লেখক।
অংকুরিত তেলশুর বীজ। আলোকচিত্র: লেখক।

তেলশুর গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হোপিয়া ওডোরাটা (Hopea odorata) ও গোত্র ডিপ্টেরোকার্পেসি। হোপিয়া নামটা এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জন হোপের স্মারণিক, আর ওডোরাটা অর্থ সুগন্ধি। এর ফুল সুগন্ধি। তেলশুর বৃহদাকার পাতাঝরা প্রকৃতির বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ। কাণ্ডের বাকল খসখসে, কালচে, লম্বা লম্বা ফাটা ফাটা দাগ আছে। পাতা দোলায়মান ঝুলন্ত শাখায় জন্মে। পাতার গোড়ার দিক গোলাকার ও আগার দিক সরু। পাতা মসৃণ ও উজ্জ্বল সবুজ।

শীতে পাতা ঝরিয়ে গাছ নিঃস্ব হয়ে যায়, বসন্তে আসে নতুন পাতা, গ্রীষ্মে আসে ফুল-ফল, বর্ষায় গজায় বীজ থেকে চারা। ছরে কয়েক দফায় ফুল ফুটলেও সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে গ্রীষ্মে। ফুটন্ত ফুল থেকে ধূপের ধোঁয়ার মতো গন্ধ আসে। এজন্য এ গাছের আর এক নাম ধুনা গাছ। গ্রীষ্মের পর বর্ষার শুরুতে প্রচুর ফলধরা গাছের সৌন্দর্য হয় দেখার মতো। তেলশুর কাঠ খুব মজবুত, শক্ত ও ভারি, ভালো পালিশ নেয়, ঘুণে ধরে না ও উঁই পোকায় নষ্ট হয় না। বীজ থেকে যেহেতু সহজে চারা হয়, শক্ত গাছ বলে ঝড়ে সহজে ভাঙে না— তাই এ গাছটিকে ঢাকা শহরের পথতরু হিসেবে সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

পুত্রঞ্জীব
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা পুত্রঞ্জীব নামকরণের এক সার্থক ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইতে, বলেছেন, ‘‘পুত্রঞ্জীব সংস্কৃত নাম, পুত্রদের দীর্ঘজীবন কামনার শাশ্বত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত, মেয়েদের নয়। প্রেতযোনির কোপদৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য শিশুদের এই ফলের কবজ পরানোর প্রাচীন রীতিই সম্ভবত নামকরণের হেতু। তবু গাছটির কোনো ভেষজ-মূল্য নেই। শুধু জ্বর ও সর্দিতে দৈবাৎ ব্যবহৃত হয়।’’

ঢাকা শহরে এ গাছের কোনও অভাব নেই, যত্রতত্র দেখা যায়। শেরেবাংলার মাজার, কলেজ রোড, আবদুল গণি রোড ও টেলিফোন হাউসের আশপাশে এবং আরও অনেক জায়গায়ই পুত্রঞ্জীব গাছ আছে বলে দ্বিজেন শর্মা উল্লেখ করেছেন। রমনা উদ্যানসহ আশেপাশের এলাকায় অনেক গাছ চোখে পড়ে।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনের উদ্যানে ও ভেতরে আছে দুটি প্রাচীন পুত্রঞ্জীব গাছ, ভেতরের গাছ দুটোর বয়স সত্তর-আশি বছরও হতে পারে। আবার একেবারেই অল্প বয়সী পুত্রঞ্জীবের ঝোঁপ দেখেছি মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রধান সড়কের দু’ধারে বেড়ায়, হেজ প্লান্ট হিসেবে সেগুলো লাগানো হয়েছে, ছেঁটে ছেঁটে গাছগুলো খাটো আর ঝোপালো করে রাখা হয়।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার বাগানে পুত্রঞ্জীব গাছ। আলোকচিত্র: লেখক।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনের উদ্যানে ও ভেতরে আছে দুটি প্রাচীন পুত্রঞ্জীব গাছ, ভেতরের গাছ দুটোর বয়স সত্তর-আশি বছরও হতে পারে। আবার একেবারেই অল্প বয়সী পুত্রঞ্জীবের ঝোঁপ দেখেছি মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রধান সড়কের দু’ধারে বেড়ায়, হেজ প্লান্ট হিসেবে সেগুলো লাগানো হয়েছে, ছেঁটে ছেঁটে গাছগুলো খাটো আর ঝোপাল করে রাখা হয়।
পুত্রঞ্জীব ফল। আলোকচিত্র: লেখক।

পুত্রঞ্জীব আমাদের দেশীয় গাছ, আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম পুত্রঞ্জীবা রক্সবার্গী (Putranjiva roxburghii), গোত্র ইউফরবিয়েসী। গোড়ার কাণ্ড খুব বেশি দীর্ঘ হয় না, মসৃণ বাকল, ধূসর রঙের, বহু ডালপালায় ঝাঁকড়া মাথা ও ছায়াঘন গাছ। বৃক্ষ প্রকৃতির এ গাছ বাঁচে অনেক বছর। ডালপালার আগা ঝুলন্ত। লম্বা পত্রদণ্ডের দু’ধারে আনত পত্রসজ্জা দেখতে খুবই সুন্দর। ফুল অনেক ছোট, প্রায় চোখে পড়ে না, কিন্তু কয়েকদিন পর ফল হলেই তা বোঝা যায়।

ফুল একলিঙ্গিক, একই গাছে ফিকে-হলুদ রঙের স্ত্রী ও পুরুষ ফুল ফোটে, তবে পৃথক পুরুষ ও স্ত্রী গাছও দেখা যায়। ফল ছোট, ডিম্বাকার মাকুর মতো, দুই প্রান্ত সরু ও সূঁচালো। শক্ত মেঝেতে এক প্রান্ত ধরে ঘুরালে তা লাটিমের মতো ঘুরতে থাকে। এজন্য শিশুরা এর শুকনো ফল বা বিচিকে ‘ঘুরঞ্চি’ হিসেবে খেলে।

গ্রীষ্মে গাছে ফুল ফোটে, জৈষ্ঠ্য-আষাঢ়ে গাছের ডালভরা অসংখ্য ফল দেখা যায়। প্রায় এক বছর পর ফল পাকে। ফলের ভেতরে একটি শক্ত বীজ থাকে। সহজে বীজ থেকে চারা হয়। চারার বৃদ্ধি খুব ধীর। এজন্য গাছ দেখে তার সঠিক বয়স আন্দাজ করা যায় না। পথের ধারে দীর্ঘজীবী ছায়াতরু ও স্থায়ী ঝোঁপ তৈরির জন্য পুত্রঞ্জীব গাছ উপযুক্ত। 

প্রকৃতি আমাদের বাড়ি
পরিবেশবাদী আমেরিকান কবি গ্যারি স্নাইডারের (১৯৩০-) বলা কথার চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। তাঁর কথা হলো, ‘‘তুমি প্রকৃতি দর্শনে যাচ্ছ যাও, তবে মনে রেখো, প্রকৃতি শুধু দেখা বা বেড়ানোর জায়গা নয়— ওটা আমাদের বাড়ি’’।

ইংরেজ লেখক ই. এম. ফস্টারের (১৮৮৯-১৯৭০) অনুভূতিও একই। তিনি বলেছেন, ‘‘কি হবে ওই নক্ষত্র আর বৃক্ষদের দেখে, সূর্যোদয় এবং বাতাস, যদি না ওগুলো তোমার নিত্যদিনের জীবনে প্রবেশ করতে না পারে?’’

আমার এই বৃক্ষ অনুসন্ধান মূল্যহীন, আমার এই লেখা অর্থহীন, ঢাকা শহরের গাছদের কথা শোনার বা শোনানোর কোনও মানেই নেই যদি না ওরা আমাদের জীবনে কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে, যদি না আমরা ওসব গাছেদের সঙ্গে আপন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ না হই, সেগুলো রক্ষা ও লালনে আমরা নিজেদের সন্তানের মতো উদ্বিগ্ন না হই, তাহলে এই প্রকৃতিপাঠ বৃথা।

অনেক দেশেই বয়স্ক গাছদের বয়োবৃদ্ধ গুরুজনের মতোই শ্রদ্ধা করা হয়। কেননা, ওরাই আমাদের অভিভাবক। একটা বিশাল প্রাচীন বৃক্ষ আমাদের বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন দেয়, কখনও একটা চারা বা তরুণ গাছ তা দিতে পারে না। যে কোনও মূল্যে হোক ঢাকা শহর ও অন্যান্য স্থানের প্রাচীন গাছগুলো রক্ষায় আমাদের বিশেষ মমতা ও দৃষ্টি দিতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক।
ইমেইল: [email protected]

মৃত্যুঞ্জয় রায়। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার।
ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত