যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচনে জনমত জরিপে এগিয়ে আছে বিরোধী দল কিয়ার স্টার্মারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি। তবে তার এক বক্তব্যে বিপাকে পড়েছেন লেবার পার্টির মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা। যুক্তরাজ্যে বাঙালি সম্প্রদায়ের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন তারা।
বলা হচ্ছে, লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ব্রিটিশ নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন কিয়ার স্টার্মার। তবে লেবার পার্টি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দলনেতার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
তারপরও ধারণা করা হচ্ছে, স্টার্মারের বক্তব্যের জেরে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় শেষ মুহূর্তে ভোটের হিসাব পাল্টে যেতে পারে। সুবিধা পেতে পারে সেসব আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
যুক্তরাজ্য কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনে আগামী ৪ জুলাই ভোট হবে। এ নির্বাচনে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন।
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ডেইলি সানের ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টার্মার। সেসময় একজন অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান জানতে চান।
জবাবের একপর্যায়ে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে স্টার্মার বলেন, “যারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এদেশে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। কয়েকটি দেশের মানুষের এখানে আসা বন্ধ করতে পারি আমরা।”
রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যানকে ‘ব্যয়বহুল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে দেশ থেকে তারা এসেছেন, সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। আমি নিশ্চিত করব সেটা।”
২০২২ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যান নামের একটি অভিবাসন নীতি প্রস্তাব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পুনর্বাসনের জন্য স্থানান্তর করা হবে।
ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টার্মারের দেওয়া ওই বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মাঝে। তার বক্তব্য সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয়নি; চলছে ব্যাপক সমালোচনা।
নেটিজেনদের অনেকে লেবার পার্টির নেতার বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পদত্যাগ করেছেন লেবার পার্টির টাওয়ার হ্যামলেটস শাখার ডেপুটি লিডার ও কাউন্সিলর সাবিনা ইয়াসমিন।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিদের ক্ষোভ প্রশমনে বিবৃতি দিয়েছে লেবার পার্টি।
নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যে ৩৪ জন লড়ছেন তাদের মধ্যে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন ৮ জন। এই আটজনের মধ্যে আছেন বর্তমানে এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আপসানা বেগম।
রুশনারা আলী বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড স্টেপনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন, রুপা হক ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন এবং আপসানা বেগম পপলার অ্যান্ড লাইম হাউস আসন থেকে লড়ছেন।
লেবার পার্টির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কিয়ার স্টার্মারের বক্তব্য সম্পাদনা করে নেচিবাচকভাবে সোশাল মিডিয়ায় উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশি সম্প্রদায়কে অনেক ভালোবাসেন। যুক্তরাজ্যের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিকদের অবদান আছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ হিসেবে দেখেন কিয়ার স্টার্মার। নিরাপদ দেশ থেকে যারা যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে বাস করছেন, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের কোনও উদ্দেশ্য তার ছিল না।
লেবার পার্টির এই বক্তব্যে অবশ্য শান্ত হয়নি বাংলাদেশি সম্প্রদায়। তাদের বড় একটি অংশ লেবার পার্টিকে এবারের নির্বাচনে ভোট না দেওয়ার প্রচারে নেমেছে। ফেইসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে লেবার পার্টিকে বয়কটের ডাকও দিয়েছেন তারা।
কিয়ার স্টার্মারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ কেউ কেউ আবার নির্বাচনে কোনও দলীয় প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেছে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশেষ করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত যেসব এলাকায় বর্তমানে লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রয়েছেন, সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কিয়ার স্টার্মারের মঙ্গলবারের বক্তব্য তুলে ধরে নিজেদের পক্ষে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন।
কিয়ার স্টার্মারের বক্তব্য ভোটযুদ্ধে প্রভাব ফেলতে পারে- এমন আশঙ্কায় এরই মধ্যে লেবার পার্টির এমপি রুশনারা আলী ও আপসানা বেগম নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন।
বুধবার এক ভিডিও বার্তায় আপসানা বেগম বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলছি, আমি যতদিন আছি, অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দোষারোপ সহ্য করব না। আমাদের বাংলাদেশি সম্প্রদায় ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে ইস্ট লন্ডনে ২৫ বছর বয়সী আলতাব আলী নিহত হন।
“তখন আমাদের স্লোগান ছিল- ‘আমরা এখানে ছিলাম, আমরা এখানে থাকব’। আপনারা আমাকে ভোট দিলে শক্তিশালী আওয়াজের জন্য ভোট দিচ্ছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন। যিনি সংসদে গিয়ে যেকোনও উপায়ে আমাদের অভিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার এবং সম্মান রক্ষা করবে।”
দলনেতা কিয়ার স্টার্মারের বক্তব্যের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড স্টেপনি আসন থেকে টানা চারবার নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী।
তিনি বলেছেন, “কোনও দেশকে এভাবে এককভাবে বলা ঠিক নয়। এটা ভুল হয়েছে। আমি আমার নেতাদের জানিয়েছি, এভাবে এককভাবে বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।”
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটাদের ভুল বোঝাচ্ছেন অভিযোগ এনে রুশনারা আলী বলেন, “আমাদের লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ব্রিটিশ নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এটা গুজব। বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক বেশ ভালো এবং তা অটুট থাকবে।”
কিয়ার স্টার্মারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লন্ডনের বাসিন্দা তানভীর আলম পিয়াস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তার বক্তব্য বাঙালি সম্প্রদায়ে প্রভাব ফেলেছে। তাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় শেষ মুহূর্তে ভোটের হিসাব পাল্টে যাবে।”
যুক্তরাজ্যের উদারপন্থি রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটসের (লিবডেম) লুটন শাখার নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহবুবুল কারীম সুয়েদ বলেন, “লেবার পার্টির নেতার এমন বক্তব্য আমাদের হতাশ করেছে। একজন নেতার এমন বক্তব্য তার নেতৃত্বের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
“পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যে ইরান ও আফগানিস্তানের আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা সর্বাধিক। সেক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে কিয়ার স্টার্মারের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া আগামী নির্বাচনে তিনি দেখবেন।”
যুক্তরাজ্যে এবারের নির্বাচনে লেবার পার্টির মনোনয়নে ভোটে দাঁড়ানো আট প্রার্থীর মধ্যে আরও আছেন নুরুল হক আলী, রুমি চৌধুরী, রুফিয়া আশরাফ ও নাজমুল হোসেন।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই নাগরিক। তারা হলেন, দক্ষিণ লন্ডনের টটেনহাম আসন থেকে আতিক রহমান এবং ইলফোর্ড সাউথ আসন থেকে সৈয়দ সাইদুজ্জামান।
লেবার পার্টির ৮ জন ও কনজারভেটিভ পার্টির ২ জনের বাইরে ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেন, লিবারেল ডেমোক্রেটস, রিফর্ম পার্টি, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট, গ্রিন পার্টি ও সোশালিস্ট পার্টি থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১৩ জন মনোনয়ন পেয়েছেন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১১ জন আছেন ভোটের মাঠে।