Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

কলাম

জনৈক আহমদ ছফা ভাই ও কিছু সাধারণ স্মৃতি

আফসান চৌধুরী। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকি ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার পর প্রথম ব্যাচ। তিনি তখনই  আমাদের শিক্ষকদের কাছেও ‘ভাই’, অতএব বেশ সিনিয়র। কিন্তু চলেন সবার সাথে উদারভাবে। থাকতেন আন্তর্জাতিক হোস্টেলে, সময় কাটতো আড্ডায়, ক্যান্টিনে বা টিচার্স কমন রুমে। খুব সজ্জন ছিলেন এবং এটাই বেশি মনে পড়ে। অহংকারমুক্ত, সরল মানুষ। সময়ের ব্যবধানে তার ভক্তকুল তাকে যে মহা মানবীয় রূপ দিয়েছেন সেই মানুষকে আমি চিনবো না। যাকে চিনতাম তাকে নিয়ে কিছু কথা, কিছু স্মৃতি।

২.
যুদ্ধের পরের ইউনিভার্সিটি খুব অস্থির ছিল। কিন্তু তখন তো গোটা দেশেরই এই অবস্থা। তাই এটা এমন কিছু মনে হতো না। সবাই কোনও না কোনও ক্যান্টিনকেন্দ্রিক জীবন যাপন করতো। যারা অনেক রাজনীতিঘনিষ্ট তারা যেতেন মধুতে, যারা সাহিত্যঘেরা তারা শরীফে পা দোলাতো, যারা কোনওটাই না তারা টিএসসি-তে যেত বেশি। এই রকম একটা মোটা দাগের সমীকরণ করলাম আর কি। আমরা শরীফ মিয়া’র ক্যন্টিনের দলের লোক, ছফা ভাইকে ওখানেই দেখতাম। তাকে কেন্দ্র করে আড্ডা হতো মানে তিনি গুরুকিসিমের মানুষ। তবে অনেক সহজ সাধারণ মানুষ, সাদা মনের মানুষ। আমার বন্ধু শামীম (শামসুল ইসলাম খান, অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যাপনা করতো) একবার স্টুডেন্টদের টিভি ডিবেটে অংশ নিল। সেই ডিবেটে ওর একটি উক্তির জন্য ছফা ভাই তাকে ডেকে নিয়ে চা খাওয়ান। মানুষটাকে বোঝা যায়?

৩.
১৯৭৩ সালের দিকে আমার বন্ধু কবি দাউদ হায়দার এক কবিতা লেখে, যেটাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো তীব্র প্রতিবাদ করে। কবিতা ছাপার পর অত পাত্তা দেয়নি, কিন্তু যারা এতদিন চুপচাপ ছিল তারা সুযোগ পেয়ে জেগে ওঠে। সেইদিক থেকে তাদের নবজীবনে ওই কবিতার ভূমিকা ছিল। বেশ মিটিং, মিছিল হয়। দাউদকে জেলে নেওয়া হয় তবে সেটা ‘নিরাপত্তা’ ব্যবস্থা হিসেবে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী নিজেও পাবনার মানুষ ছিলেন, দাউদের পরিবারের মতোই।  

ক্যাম্পাসে ‘উগ্রবাদ বিরোধী’ কিছু মিটিং মিছিলের পরিকল্পনা করা হয়। যদিও ছফা ভাই দাউদের কবিতার ভক্ত ছিলেন না কিন্তু এইসব কর্মকাণ্ডে অন্যতম নেতৃত্ব দেন তিনি। আগে এতো ঝগড়া ছিল না তাই সংগঠন করা সহজ ছিল। এদিকে সরকার কিছুটা চিন্তিত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

৪.
ক্যাম্পাসে ‘উগ্রবাদ বিরোধী’ কিছু মিটিং মিছিলের পরিকল্পনা করা হয়। যদিও ছফা ভাই দাউদের কবিতার ভক্ত ছিলেন না কিন্তু এইসব কর্মকাণ্ডে অন্যতম নেতৃত্ব দেন তিনি। আগে এতো ঝগড়া ছিল না তাই সংগঠন করা সহজ ছিল। এদিকে সরকার কিছুটা চিন্তিত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ব্যাপারটা বেশি দূর গড়াবার আগেই দাউদ দেশ ত্যাগ করে, তারপর দেশে রাজনৈতিক কারণে এমার্জেন্সি হয়, তারপর আর কি। তবে সামনে থেকে এই ‘উগ্রবাদের’ বিরোধিতা করেন ছফা ভাই ও আরও কয়েকজন। রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে এটা হয়। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে কোনও দলের কেউ হতে হয়নি কিছু করতে।

৫.
ছফা ভাই কি নিজে কোনও দল করতেন? করতে দেখিনি। বিভিন্ন দলের মানুষের সাথেই তার খাতির ছিল। তিনি কোনও দলের কেউ ছিলেন না। বামপন্থীদের সাথে সম্পর্ক ছিল কিন্তু দলীয় সম্পৃক্ততা ছিল না। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি কোন দল করি? আমি বললাম কোনওটাই না। তিনি চুপ করে ছিলেন। তবে তিনি বামপন্থার অনুসারী ছিলেন, অনেক পড়তেন তবে সাহিত্যই বেশি। তিনি ও আমি একই সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম, তবে আগে ও পরে। বাংলাদেশ লেখক শিবির। তবে কিছু একটা ঝামেলা হয় কোনও বামদলের অতি প্রভাব নিয়ে। তারপর তিনি আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি।

ছফা ভাইয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন ও গুণ তার নিঃস্বার্থ জীবন। তিনি রাজনৈতিক সাহিত্য চর্চা করতেন কিন্তু সব কিসিমের সাহিত্যিকদের সহায়তা করতেন। লেখকদের সুযোগ করে দেবার ব্যাপারে তার জুড়ি নাই। বহু লেখককে সামনে আসতে, প্রতিষ্ঠা পেতে তার ভূমিকা আছে। হ‍ুমায়ূন আহমেদ তার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলা যায়। আরও অনেক নাম আছে।

৬.
ছফা ভাইয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন ও গুণ তার নিঃস্বার্থ জীবন। তিনি রাজনৈতিক সাহিত্য চর্চা করতেন কিন্তু সব কিসিমের সাহিত্যিকদের সহায়তা করতেন। লেখকদের সুযোগ করে দেবার ব্যাপারে তার জুড়ি নাই। বহু লেখককে সামনে আসতে, প্রতিষ্ঠা পেতে তার ভূমিকা আছে। হ‍ুমায়ূন আহমেদ তার শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার বলা যায়। আরও অনেক নাম আছে। দুই হাত খুলে কয়জন মানুষ এইভাবে অন্যদের দিকে সহায়তার হাত বাড়ায় আজকাল?

৭.
আজকাল মাঝে মাঝে ছফা ভাই ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভাইকে নিয়ে কে কত বড় সেই ঝগড়া হয় দেখলাম। কোন কারণে বুঝি না। এটাও এক ধরনের দলীয়করণ। তিনি ইলিয়াস ভাইয়ের লেখার ভক্ত ছিলেন। ছফা ভাই আমাকে নিজেই বলেছিলেন ‘খোয়াবনামার’ ইংরেজি অনুবাদ করতে। কিন্তু আমি করিনি, কারণ এটার পিছনে যে সময় ও শ্রম দেবার দরকার তার সুযোগ আমার ছিল না। তার মনের যে উদারতা ছিল সেটা বোধহয় এখন একটু কম সমাজে।

আজকাল মাঝে মাঝে ছফা ভাই ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভাইকে নিয়ে কে কত বড় সেই ঝগড়া হয় দেখলাম। কোন কারণে বুঝি না। এটাও এক ধরনের দলীয়করণ। তিনি ইলিয়াস ভাইয়ের লেখার ভক্ত ছিলেন। ছফা ভাই আমাকে নিজেই বলেছিলেন ‘খোয়াবনামার’ ইংরেজি অনুবাদ করতে।

৮.
তার সাথে শেষ দেখা হয় নগর হসপিটালে। দেখতে গিয়েছিলাম অসুস্থ মানুষটাকে। আড্ডা দিলেন অনেকক্ষণ। একজন নার্সের কথা মনে পড়ে। বাচ্চা মেয়ে, ছফা ভাইকে দেখাশোনা করছে। মেয়েটার সাথে যে হৃদ্যতা দেখেছিলাম তা খুব কম মানুষের সাথে দেখেছি তার। ঠিক যেন বাবা-কন্যা। এটাই ছফা ভাই— স্নেহ, ভালোবাসার জনৈক একজন, যার জীবনে হয়তো অনেক অর্জন আছে, কিন্তু ওই হৃদয়ের পাত্রে জল একটু কম ছিল। একাই থাকলেন। যার প্রেমে পড়েছিলেন, সে প্রেমেরও ভ্রূণে মৃত্যু হয়, সংসার-পরিবার ছিল না, ভদ্র সুশীল বোহেমিয়ান জীবন। হাসপাতালে মনে হয়েছিল, কিছুদিনের জন্য হলেও ছফা ভাই স্নেহ ভালোবাসার ছায়াতলে বসতে পেরেছেন। ভালো মানুষ, ভালো থাকবেন।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
ইমেইল: afsan.c@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত