ঘরবাড়ি তো পরিচ্ছন্ন রাখতেই হবে। কিন্তু এসব নিয়ে খুব বেশি খুঁতখুঁতে হলে নিজের রোজকার জীবনেই ঝুটঝামেলা বাড়তে থাকে।
ধরা যাক, কর্মক্ষেত্রে জরুরি সভার আগে রিপোর্ট বানানোর কাজ ছিল আপনার। এরমধ্যে হঠাৎ সোফার দিকে নজর যেতেই হাতের কাজ ফেলে সোফা পরিস্কারে লেগে গেলেন আপনি। সোফা হয়তো সাফ হলো, কিন্তু আপনার এই শুচিবাই আচরণের পরিণামে ওদিকে অফিসে বেঁধে গেলো কুরুক্ষেত্র।
সুস্থ ও সুন্দর থাকার জন্য নিজে ও ঘরবাড়ি সাফসুতরো রাখা জরুরি হলেও এ নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খুঁত খুঁতে হওয়া যাবে না। কারণ এমন আচরণকে রোগের পর্যায়ে ধরা যায়। অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি রোগে আক্রান্তরা পরিচ্ছন্নতা নিয়ে রীতিমতো বাড়াবাড়ি করে ফেলেন।
এমন রোগে আক্রান্তরা কাউন্টারটপস, সিংক, বাসন ধোয়া থাকার পরও বারবার ঘষে ঘষে আবার ধুয়ে রাখেন। কেউ একটু পরপর হাত ধুতে থাকেন। অনেকে সংক্রমণের অতিরঞ্জিত ভয় থেকে শিশু সন্তানকে শীতের রাতেও গোসল করিয়ে দেন।
মানসিক চাপ থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে রাখতেই কারও কারও পরিচ্ছন্নতার বাতিক দেখা যায়; এমন ধারণা অনেকের।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওসিডি রোগ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
তবে ওসিডি রোগে ভুক্তভোগীরা আসলে নিজের অজান্তেই সবকিছু সাফসুতরো করতে উঠেপড়ে লাগেন। এর পেছনে থাকতে পারে মানসিক অস্থিরতা অথবা বায়োলজিকাল কোনো কারণ।
দিল্লি-এনসিআর শহরের আর্টেমিস হসপিটালের প্রধান সাইকিয়াট্রিস্ট রাহুল চন্ধোক বলেন, “বাতিকগ্রস্তের মতো সাফসুতরো করতে লেগে পড়াকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- বায়োলজিকাল, মানসিক এবং পরিবেশগত।”
জিন, ভিটামিন এবং থাইরয়েড সমস্যাগুলো বায়োলজিকাল ধরনের অংশ। কেউ কেউ একটু জেদি ও ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়; তারা মানসিক প্রকারের অংশ।
“আর পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক কারণের পেছনে কর্মক্ষেত্র, বাড়ি এবং সম্পর্ক প্রভাব ফেলে থাকে।”
ভারতের দেরাদুন শহরের থ্রাইভিং মাইন্ডস প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, প্রধান এবং কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট অঙ্কিতা প্রিয়দর্শীনি বলেন, “যারা পরিচ্ছন্নতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন তাদের আসলে মানসিক অস্থিরতার সমস্যা রয়েছে যা নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।”
ব্যক্তিগত জীবনে বড় কোনো ট্রমা বা আঘাত থেকেও এমন মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার কেউ হতো এমন পরিবেশে বা পরিবারে বড় হয়েছে যেখানে ঝাড়ামোছা, ধোয়া, পরিস্কার করায় খুব বেশি জোর দেওয়া হতো; ছোটবেলার সেই অভ্যাস বড় হয়েও ছাড়তে পারছেন না অনেকে।
অনেকের আবার অসুস্থ হয়ে পড়ার ভয় কাজ করে। এই ভয় থেকেই সারাক্ষণ তারা সবকিছু ধোয়ামোছা করতেই থাকেন।
কোভিড মহামারীর সময় এমন শংকায় ভুগেছেন অনেকে।
চিকিৎসক প্রিয়দর্শীনি বলেন, “নতুন বাড়িতে ওঠার পর, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর, প্রিয়জনকে হারানোর পর অনেকের মধ্যে মানসিক বদল থেকে ধোয়ামোছার বাতিক দেখা দিতে পারে।”
ওসিডি আক্রান্তরা কি অসামাজিক হয়?
স্বাভাবিকের চেয়ে পরিচ্ছন্নতায় অতিরঞ্জিত রকমের ঝোঁক আছে যাদের তারা কাজ, সামাজিকতা এবং জীবনের সবকিছুতেই সমস্যাজনক হয়ে উঠতে পারে।
একজন মেডিকেল অফিসার এবং ক্লিনিকাল সাইকোলজি ও সাইকোথেরাপি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট প্রীতি সিং বলেন, “এরকম মানসিকতার মানুষ সবকিছুর বিনিময়ে পরিস্কার থাকতে চায় সব সময়।”
সতর্ক করে চিকিৎসক চন্ধোক বলেন, “এভাবে সব সময় ধোয়ামোছায় ব্যস্ত থাকলে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায় এবং অনেক জরুরি দায়িত্ব পালন করা হয় না।
“এসব মন-মানসিকতাকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। কারও হয়তো সারাক্ষণই কিছু একটা ধোয়ামোছার কথা মনের মধ্যে চলতেই থাকে।”
এই রোগ শারীরিক ভাবেও ধীরে ধীরে অসুস্থ করে তোলে। ধোয়ামোছার জন্য নানা রকম কেমিকেল পণ্য ঘন ঘন ব্যবহারের কারণে কারও কারও ত্বকে চুলকানি দেখা দিতে পারে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
ওসিডি থেকে মুক্তির উপায় কী?
নিজের আচরণে ধোয়ামোছা নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভাবনা স্বীকার করে নিলে এই রোগ থেকে মুক্তি সহজ হয়ে ওঠে।
এরপর অবশ্যই কোনো মানসিক চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
চিকিৎসক চন্ধোক বলেন, “এই রোগের চিকিৎসা আছে। জীবনে এই বাতিক প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।”
(সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে )