ট্রাকচালক মামুনের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। দিনরাত পরিশ্রম করে যা উপার্জন করেন, তা দিয়েই চলে মা, বাবা, স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে সংসার।
প্রতিদিন দুপুরবেলায় ট্রাক গ্যারেজে রেখে বাড়ি যান মামুন। মুখে খাবার পুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের আবার ট্রাক নিয়ে বের হন তিনি। ১৯ জুলাই দুপুরেও তার এই রুটিনের ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে সেদিন বাকি দিনগুলোর মতো মামুনের আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
গ্যারেজে ট্রাক রেখে দুপুর ২টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যান মামুন। কে যেন তার বাম হাতে রামদার কোপ বসায়। প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে গিয়ে পেছন থেকে তার ডান হাতে গুলি করে পুলিশ।
ভৈরবে আহত মামুন এখন পড়ে আছেন ঢাকার আগারগাঁওয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) এক বেডে। তার ডান হাত কেটে ফেলা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন গত ১৫ জুলাই সংঘাতে গড়ানোর পর ১৯ ও ২০ জুলাই ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল গোটা দেশেই। চার দিনেই দেড় শতাধিক মানুষ মারা যায়।
সংঘর্ষের মধ্যে কেন বের হলেন- জানতে চাইলে মামুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি তো ভাবি নাই আমাকে গুলি করবে। আমাকে কেন গুলি করবে? আমি তো আন্দোলনে যাই নাই। ট্রাক রাইখা বাসায় যাইতেছিলাম।”
গুলিবিদ্ধ মামুনকে ভৈরবের কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কোনোটিতেই তিনি চিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ করেন মামুনের স্ত্রী মৌসুমী।
তিনি বলেন, “ভৈরবের দুইটা হাসপাতালে গেছি এই মানুষটারে নিয়া, কিন্তু তারা রোগী ধরলই না। এরপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়া এখানে পাঠানো হয়।”
সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষের হাত হারিয়ে এভাবে হাসপাতালে অসহায়ের মতো পড়ে থাকা যেন কোনোভাবেই মানতে পারছেন না মৌসুমী।
তিনি বলেন, “আমরা মজুর মানুষ। সকালে মানুষটা বাইর হইয়া কর্ম করলে টাকা আসে। নয়তো আসে না। সে এখন হাত হারাইয়া কেমনে গাড়ি চালাইবো? কেমনে আমরা বাঁচমু?”
হাসপাতালে কতদিন থাকতে হতে পারে- জানতে চাওয়া হলে মৌসুমী বলেন, “শনিবার ড্রেসিং করব। তারপর স্যাররা (চিকিৎসকরা) দেইখা জানাইবো।”
“কিন্তু কী আর জানাইবো? হাতটাতো কাইটাই ফেলছে। সেইটাতো আর জোড়া লাগাইবো না। আমরা তো পথে বইসা গেলাম,” মৌসুমীর আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে হাসপাতালের পরিবেশ।
মামুনের পাশের বেডে শুয়ে ছিলেন রাজু নামের এক রিকশাচালক। তার বাম পায়ের পুরোটা ব্যান্ডেজে বাঁধা। গাজীপুরের এই বাসিন্দা ২০ জুলাই দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে ডামাডোলের মধ্যেও নিজের শহরে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন। কারণ ঘরে চাল ছিল না। চাল নিয়ে না গেলে সন্তান রাতে অভুক্ত থাকবে।
রাজু বলেন, “ছোট মেয়েটা ভাত ছাড়া আর কিছু মুখে তোলে না বলেই এই গণ্ডগোলের ভেতরেও রিকশা নিয়া বাইর হই। ভাবছিলাম, কিছু চাইল আর পাইলে একটু গুঁড়া মাছ নিয়া বাড়িতে আইমু। রাইতে তাতেই খাওয়া হইয়া যাইব।
“কিন্তু বাড়িতে আর যাওয়া হয় নাই। সেই ভাতও আর খাওয়া হয় নাই। আমি এখন এইখানে। বাড়ি থেকে বাইর হইছিলাম দুই পা নিয়া। এখন বাড়ি যামু এক পা নিয়া।”
সংষর্ষ চলাকালে আহত কীভাবে হলেন- জানতে চাইলে রাজু বলেন, “সেদিন হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। কোনদিক দিয়া যে গুলিটা আমার গায়ে লাগল, বুঝতেই পারলাম না। দেখলাম, কয়েকজন আমারে ধরাধরি কইরা মেডিকেলে নিয়া যাইতেছে। এতদূরই জানি। এর বেশি কিছু জানি না।”
পাশ থেকে রাজুর স্ত্রী স্বপ্না বলেন, “আমারে কে কইল রাজু ভাইর গুলি লাগছে। সাথে সাথে আমি তারে ফোন দিলাম। লোকটা কেবল কইলো, ‘আমি শেষ’। এরপর আমি দৌড় পাইড়া মেডিকেলে গিয়া দেখি, মানুষটার পুরা শরীর রক্তে ভাইসা যাইতেছে। তারপর এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুইরা এখানে আইছি।”
গাজীপুর থেকে রাজুকে প্রথমে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু পায়ের শিরা বা রগ ছিড়ে যাওয়ায় সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ভুল করে পঙ্গু হাসপাতালে না গিয়ে রাজু ও তার স্ত্রী চলে যান পাশের জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে। রাজুর পায়ের অবস্থা দেখে চিকিৎসকরা সেখানেই তার চিকিৎসা শুরু করেন। ডান পা থেকে শিরা কেটে বাম পায়ে লাগানো হয়। এরপরও পায়ের উন্নতি না হওয়ায় সেখান থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়।
দুচোখ হাত দিয়ে ঢেকে রাজু বলেন, “আমরা কোনও দল করি না। আমরা সাধারণ মানুষ। দিন আনি, দিন খাই। দুইটা ভাত হইলেই আমরা খুশি।
“ডাক্তাররা বলছে, গুলি লেগে রক্তনালী ছিঁড়ে বাইর হইয়া গেছে। যার কারণে পা পইচা গেছে। এখন এইটা কাইটা ফেলতে হইব। এখন পর্যন্ত তিন ব্যাগ রক্ত লাগছে।”
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন রাজু। চিকিৎসা খরচ মেটাবেন কীভাবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
তিনি বলেন, “গরিব মানুষ আমি। আমার মাইয়াডা টিভি দেখত। সেই টিভিটা বেইচা চিকিৎসা করলাম এদ্দিন পর্যন্ত। এখন তো ঘরে আর বেচার মতো কিছু নাই। কী দিয়া চিকিৎসা করামু-সেইটাই এখন চিন্তা। আর চিকিৎসা করাইলেই বা কী? পা-তো কাইটাই ফেলতে হইব। তাইলে আমি রিক্সা চালামু কী দিয়া?”
“মাইয়াডার জন্য আমার আর ভাত নেওয়া হইলো না,” বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন রাজু।
পঙ্গু হাসপাতালের যে কক্ষে মামুন আর রাজুকে রাখা হয়েছে, সেখানে আরও বেশ কয়েকটি নতুন বেড সম্প্রতি বসানো হয়েছে। জানা গেল, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে সহিংসতায় আহতদের রাখা হবে সেখানে।
কয়েকদিনের সহিংসতায় দুইশ জন নিহত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার আহত হয়েছে। তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এক হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যই আহত হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
কেবল পঙ্গু হাসপাতাল নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালেও আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এসব হাসপাতাল থেকে অনেক রোগীকে প্রাথমিক এবং জরুরি চিকিৎসা দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও গুরুতর আহতরা এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকদের ভাষ্য, জীবন বাঁচাতে অনেকের হাত বা পা কেটে ফেলতে হচ্ছে। কারও কারও দেহে আরও জটিল অস্ত্রোপচারের দরকার রয়েছে। এরপর ঠিক কতজন সহিংসতায় অঙ্গ হারালেন, তার হিসাব জানা যাবে।
এই হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় জানিয়েছে, ১৮-২৪ জুলাই পর্যন্ত সেখানে জরুরি বিভাগে ভর্তি হন ১ হাজার ৬৯৩ জন রোগী। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ছিলেন ২৪৫ জন। এই ২৪৫ জনের মধ্যে ২১৪ জনই ভর্তি হন ১৯-২১ জুলাইয়ের মধ্যে।
পঙ্গু হাসপাতালের ইয়েলো-১ ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই হাসপাতালে এখন পর্যন্ত দুজনের মৃত্যু হয়েছে। একজনের মৃত্যু হাসপাতালে আনার আগেই হয়েছিল। আর একজনের দুটি পা-ই মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ ছিল। তাকে এখানকার আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি।
“এখন পর্যন্ত এখানে পা কেটে ফেলতে হয়েছে ৬ জনের। হাতও কাটতে হয়েছে কয়েকজনের।”
হাত-পা কেন কেটে ফেলতে হচ্ছে- জানতে চাইলে ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “বেশিরভাগই বুলেট ইনজুরি। বুলেটের কারণে রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে। আর যেখান থেকে এটা ছিঁড়েছে, তার নিচে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে হাড় ও মাংসে পচন ধরে। কিডনি বিকল হয়ে যায়। তাই জীবন বাঁচাতে গুলিবিদ্ধদের হাত-পা কাটতে হচ্ছে।”
গুলিতে আহতদের মধ্যে আরও কতজনের এমন পরিণতি হতে পারে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “প্রত্যেককে দেখা হচ্ছে। যারা হাসপাতালে রয়েছেন, তাদের প্রতিদিন ফলোআপ করা হচ্ছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর শরীরের অবস্থা দেখার পর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বেশিরভাগ গুলিবিদ্ধ রোগীর জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তবে আরও রোগীর অস্ত্রোপচার করা লাগবে।”
আহতদের দেখতে শনিবার পঙ্গু হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আহতদের চিকিৎসাভার নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
তিনি সেখানে বলেন, “আহতদের চিকিৎসার জন্য যা যা লাগবে করে দেব এবং করে দিচ্ছি। যাদের অঙ্গহানী হয়েছে, তাদের কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনের ব্যবস্থা নেবে সরকার। যাতে তারা আবার সুস্থ মানুষের মত চলাফেরা করতে পারে। নিজেদের কাজ করতে পারে।”