Beta
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা

অভাবের সংসারগুলোতে এখন চিকিৎসার চাপ

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকেই সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকেই সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহত।
[publishpress_authors_box]

ঢাকায় বিভিন্ন অনলাইনের প্রতিষ্ঠানের হয়ে ডেলিভারির কাজ করেন ২৪ বছরের ইমরান। বাড়ি কুমিল্লায়। ঢাকার বনশ্রীর এফ ব্লকে এক মেসে থাকেন। ডেলিভারির পাশাপাশি পড়াশোনাও করেন তিনি।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধদের একজন ইমরান।

১৯ জুলাই মতিঝিল এলাকায় ডেলিভারির সময় ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান তিনি। একপর্যায়ে তার পায়ে গুলি লাগে। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে এখন তিনি মেসেই আছেন। পুরোপুরি সুস্থ এখনও হননি। প্রতিদিন পায়ে ড্রেসিং করতে হয়। সঙ্গে চলছে ওষুধ।

পায়ে গুলি লাগার দিন ইমরান যে অনলাইন প্রতিষ্ঠানের হয়ে মতিঝিলে ডেলিভারি নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক কাজী নওশীন লায়লা। বেবি ফুড নিয়ে তার কাজ।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চলতি মাসের শুরু থেকেই আমাদের ডেলিভারি কিছুটা কমে যায়। ইমরান তখন বাড়ি চলে যায়। মা-বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব তার কাঁধেই। এ কারণে বেশিদিন কোনও কাজ না করে বাড়িতে বসে থাকার জো ছিল না তার।

“একদিন তাই ফোন করে ঢাকার পরিস্থিতি জানতে চাইলেন ইমরান। রাস্তাঘাটে সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে ডেলিভারি করা যাচ্ছে কি না, এ প্রশ্ন করলেন। বললেন, ‘আপা, না খেয়ে তো মারা যাব। খুব বেকায়দায় আছি। ৮ দিন ধরে বাড়িতে বসে আছি। দুবেলা করে ১৬ বেলার ভাত এরই মধ্যে খেয়ে ফেলেছি। ঘরে আমার জন্য ১৬ বেলার ভাত কমে গেল। কাজ না করলে আম্মা-আব্বা কী খাবে? কাজ দিতে পারবেন?’”

নওশীন লায়লা বলেন, “ইমরানের কথা শুনে আমি তাকে ঢাকায় আসতে বলি। ভেবেছিলাম, বেবি ফুড তো জরুরি খাবার। পরিবহনে সমস্যা হবে না।”              

নওশীনের অনুমতি পেয়ে ঢাকায় এসে ১৯ জুলাই দুটি শিশু খাদ্যের ডেলিভারি নিয়ে বের হন ইমরান। মতিঝিলে পৌঁছার পর নওশীনকে তিনি ফোন করে জানান, মতিঝিলের পরিস্থিতি ভালো নয়। নওশীন তখন তাকে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসতে বলেন। এক ঘণ্টা পর ইমরান আবার তাকে ফোন করে জানান, তার পায়ে গুলি লেগেছে।          

নওশীন বলেন, “স্থানীয়রা গুলিবিদ্ধ ইমরানকে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে নিয়ে যায়। একটা গুলি তার পায়ের পেছন দিক দিয়ে ঢুকে সামনে দিয়ে বের হয়ে যায়। যে ছেলে বাড়ির ১৬ বেলার ভাত খরচ হয়ে গেছে বলে ঢাকায় এলো, সেই ছেলে আর তার পরিবারের এখন কী হবে, তা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে মো. আকাশের। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

ঢাকায় ইমরান যেদিন গুলিবিদ্ধ হন, একই দিন দুপুরে মিরপুরে মো. রিয়াজের পায়েও গুলি লাগে। সেদিন নিজের মোবাইল রিচার্জ, বিকাশসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান খুলে বসেছিলেন তিনি। দুপুর ৩টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাবেন, এমন সময় গুলিবিদ্ধ হন ২২ বছরের রিয়াজ।

মা-বাবাকে নিয়ে অনেক বছর ধরে মিরপুর ১০ নম্বরে থাকেন তিনি। কয়েক বছর হচ্ছে সংসারের হাল ধরেছেন রিয়াজ।    

তার বাবা কামাল হোসেন বলেন, “আমি অসুস্থ কয়েক বছর ধইরা। দুই হাত কাঁপে। কোনও কাজ করতে পারি না। তাই আমার পোলাডা বয়স হবার আগেই সংসারের হাল ধরছে। আমাদের দায়িত্ব নিছে।”

ঘটনার দিন বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন রিয়াজের মা। কিন্তু এলাকার পরিচিত দুজনকে জরুরি ভিত্তিতে বিকাশ করার কথা বলায় বের হতে হয় রিয়াজকে।

তিনি বলেন, “জরুরি দুইটা বিকাশ করতে হইব। এজন্য বিকাশ দিয়াই বাসায় চইলা আসমু, এমনটা ভাবছিলাম। রাতে ভালোমন্দ কিছু রান্না করার কথাও মারে কইয়া যাই। কিন্তু বাসায় ঢুকার আগে মিরপুর ১০ নম্বরে আল হেলাল হাসপাতালের উল্টা দিকে হঠাৎ পায়ে গুলি লাগে।”

স্থানীয়রাই রিয়াজকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাদের একজন রিয়াজের বাবাকে ফোন করে ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দেয়।           

সেদিন থেকে রিয়াজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলি তার পায়ের ভেতরে ঢুকে বের হয়ে গেছে। তাকে কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, সে বিষয়ে চিকিৎসকরা কিছু জানাননি।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছে রিয়াজের দিন। জানালেন, দেশের অবস্থা এমনিতেই ভালো ছিল না। তার ওপর বিকাশ, ফ্লেক্সিলোড আগের চেয়ে কমে গিয়েছিল আন্দোলনের পুরো সময়ে। হাসপাতাল থেকে কবে ছাড়া পাবেন, জানেন না। পুরোপুরি সুস্থ হতে না পারলে সংসার চলবে কীভাবে, তা ভেবে কূল পাচ্ছেন না তিনি।   

এই অনিশ্চয়তা কেবল ইমরান বা রিয়াজের নয়। সহিংসতায় আহত আরও অনেকেরই এই দশা। এই খেটে খাওয়া মানুষদের দিকে চেয়ে ছিল অনেকগুলো মুখ।   

সংসার কীভাবে চলবে-জানতে চাওয়া হলে সকাল সন্ধ্যাকে রিয়াজের বাবা কামাল হোসেন বলেন, “আমি তো অসহায় এখন। জমানো টাকা দিয়া ছেলেডার জন্য দোকান দিছিলাম। সেই টাকা তার এই চিকিৎসায় শেষ। এখন চলব কীভাবে, জানি না। কেবল আল্লাহ ভরসা। আল্লাহরে কওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

“কেউ আমাদের বলবে না, দুই বস্তা চাল দেব বা একটা কাজ দেব। কেউ তো বললো না, তোমার ছেলে গুলি খাইছে, তুমি তো অভাবি। তোমার পাশে দাঁড়াইলাম। আমাদের জীবনডা পাখির মতো। ডালে বসে আছি। মনে চাইল গুলি করছে। আমরা পড়ে গেছি। আমাদের আর বলার কিছু নাই।”

মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হন মো. রিয়াজ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিয়াজের পাশের বেডে আছেন আমিন উদ্দিন। ৪৯ বছরের এই ব্যক্তি পেশায় রিকশাচালক।

রাজধানীর উত্তরার এই বাসিন্দাও ১৯ জুলাই শুক্রবার গুলিবিদ্ধ হন। তিনি বলেন, “শুক্রবার নামাজের পর থেকেই তো গণ্ডগোল। কিন্তু গণ্ডগোলে ঘরে আর কত বইসা থাকা যায়। ঘরে আবার গর্ভবতী মাইয়া। আর কারও জন্য কিছু না হোক, তার জন্য তো খাওন দরকার।

“এই কারণে সেদিন গলির ভেতরে রিকশা নিয়া বাইর হইছিলাম। হঠাৎ গুলি আইসা লাগে। রিকশার যাত্রী তখন আমারে প্রথমে উত্তরার এক হাসপাতালে নিয়া যায়। সেখানে কিছু চিকিৎসা দিয়া এই হাসপাতালে নিয়া আসে।

“ঘরে কিছু টাকা রাখছিলাম গর্ভবতী মাইয়াডার জন্য। সেইগুলা দিয়া এদ্দিন চিকিৎসা হইছে। ঘরে আর কিছু নাই। আমার মাইয়াডার কী হইব, পরিবারের কী হইব, সেইটাই এখন ভাবতাছি।”

আমিন উদ্দিনের পাশের বেডে শুয়ে আছেন ১৭ বছরের মো. আকাশ। ওয়েল্ডিংয়ের দোকানে কাজ করেন তিনি। মা-বাবা আর দুই বোনকে নিয়ে থাকেন শেখেরটেক দুই নম্বরে। বাড়ি খুলনায়। ১৮ জুলাই তার গায়ে একাধিক গুলি লাগে।

অস্ত্রোপচার করে গত শুক্রবার কয়েকটি বুলেট বের করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বুলেট ভেতরে আরও রয়েছে। সেগুলো বের করতে হবে।

গুলি কীভাবে লাগল-এর জবাবে আকাশ বলেন, “সেদিন এক বাসায় গ্রিলের কাজ করতে যাই। সেখানে গিয়া দেখি, কাজ করার মেশিন ভুইলা দোকানেই রাইখা আসছি। তখন সেই বাসা থেকে বাইর হইয়া দোকানে আসতে গিয়া গোলাগুলির শব্দ পাই। ভয় পাইয়া দিলাম দৌড়। তখনই গুলিটা আইসা লাগল পিছন দিকে।

“এরপর সেখান থেকে এক মুরুব্বি আমারে এই হাসপাতালে নিয়া আইছে। তারপর থেকেই এখানে।”

আকাশের পাশে বসে ছিলেন তার বাবা নিয়ামত আলী। ছেলের গুলি লাগার খবর পান ঘটনার পরদিন সকালে। বলেন, “কাজের চাপ বেশি থাকলে ছেলে আমার মাঝেমইদ্যে দোকানেই থাকে। তাই রাতে সে ঘরে না ফেরায় দুশ্চিন্তা করি নাই। আমরা গরিব মানুষ। ট্যাকা-পয়সা নাই। ঘরে বাজার নাই। ছেলের চিকিৎসা খরচ জোগামু ক্যামনে, জানি না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত