বিশ্ব যাকে চেনে ‘গরিবের ব্যাংকার’ নামে, সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবার নিজ দেশের শাসনভার নিলেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর দেশে যে অশান্তি চলছে, তার মধ্যেই দায়িত্ব নিলেন শান্তিতে এই নোবেলজয়ী।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি অভিজ্ঞতা রয়েছে ড. ইউনূসের। ১৯৯৬ সালের বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
রাজনীতিতে নামতে গিয়েও পিছু হটেছিলেন ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়। নাগরিক শক্তি নামে দল গঠন করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে পরে উপলব্ধি হয়েছিল, রাজনীতি তার জন্য নয়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়।
এরপর আওয়ামী লীগের শাসনকাল দুঃসময় নিয়ে আসে ইউনূসের জন্য। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারাতে হয়, মামলার মুখে পড়তে হয়, সাজাও হয় একটিতে। সেই সঙ্গে তাকে কটাক্ষ করে শেখ হাসিনার বাক্যবাণও চলছিল।
কিন্তু এই আগস্টে এসে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন ইউনূস।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে তাকে মনোনীত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। রাজনীতিকে না বলে আসা ইউনূসও তাতে সাড়া দেন। প্যারিস থেকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারছেন না।
এরপর দ্রুতই নতুন সরকারের দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশে ফিরে রাতেই বঙ্গভবনে আয়োজনে সরকার প্রধান হিসাবে শপথ নেন ড. ইউনূস। ৮৪ বছর বয়সে এসে শুরু হলো তার নতুন যাত্রা।
জোবরা গ্রামের ছেলে
মুহাম্মদ ইউনূসের জন্ম ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে; দুলা মিয়া সওদাগর ও সুফিয়া খাতুনের ঘরে।
তার শিক্ষাজীবনের শুরু স্থানীয় ফকির মহাজন স্কুলে, পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বয়েজ স্কাউটসে যোগ দেওয়ার পর ১৫ বছর বয়সেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয় তার।
১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন ইউনূস। ১৯৬০ সালে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। কিছুদিন অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহানের গবেষণা সহকারী হিসাবে কাজ করার পর ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন।
১৯৬৫ সালে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়িয়েছেনও।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নাগরিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত আদায়ে সক্রিয় ছিলেন ড. ইউনূস। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ফিরে এসে কিছুদিন পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালে অধ্যাপক হওয়ার পর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।
তার স্ত্রী আফরোজী ইউনূস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তার এক ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, আরেক ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
গ্রামীণ ব্যাংক ও নোবেল জয়
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ইউনূসের লড়াই শুরু হয় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে ইউনুস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন, যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।
এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, “১৯৭৬ সালে আমি ২৭ ডলার দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করেছিলাম। আমার ইচ্ছা ছিল গরিবদের সাহায্য করা। এর জন্য দরকার ছিল গরিব এন্টারপ্রেনিউয়ারদের কোনও কোল্যাটারাল বা বন্ধক ছাড়া ছোট পরিমাণে লোন বা ঋণ দেওয়া, যেন তারা তাদের নিজস্ব বিজনেস বা ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
“গ্রামীণ যে উৎসাহ সৃষ্টি করে, তাতে আমি সেটা সম্প্রসারণে উদ্যোগী হই। তাই আমি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গিয়ে বলি গরিবদের জন্য একটা ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আমি বৈধ কর্তৃত্বের অনুমোদন চাই। সরকার রাজি হয়।”
এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক; সরকারের অংশীদারত্বে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম তখন থেকে বিশ্বব্যাপী ইউনূসকে পরিচিত করে তোলে।
দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার উদ্যোগ ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়। গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূস যৌথভাবে পায় এই পুরস্কার।
ইউনূস ১৯৭৮ সাল থেকে এপর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার এবং বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অজর্ন করেন।
এর মধ্যে তিনি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মামনা পদক স্বাধীনতা পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কার পান ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৪ সালে এশিয়ার নোবেল বলে খ্যাত রামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডিল অব ফ্রিডম’ এ ভূষিত হন তিনি।
বাংলাদেশে শুধু পল্লী অঞ্চলে গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ থাকলেও শহরাঞ্চলেও নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন ইউনূস, কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে তা পারেননি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ইউনূসের এই মডেল গ্রহণ করেছে। তিনি নিজেই বলেছেন, “যদিও বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংককে এখনও শহরের গরিবদের সাহায্য দিতে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে, আমি এখন বিশ্বজুড়ে অনুরূপ কিছু প্রজেক্ট চালু করেছি।”
গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ইউনূসের প্রসংসা করলেও বাম ধারার অর্থনীতিবিদরা এর সমালোচক। তারা বলছেন, এর মাধ্যমে দারিদ্র্য নির্মূল সম্ভভপর নয়, কিছুটা উপশম ঘটে শুধু। আর গরিব মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে যায়।
গ্রামীণ ব্যাংকছাড়া, ১৬৮ মামলা
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় দল গঠন করে ইউনূস রাজনীতিতে নামার যে চেষ্টা চালিয়েছিলেন, তাই তাকে শেখ হাসিনার বৈরী করে তোলে বলে অনেকেই মনে করেন।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের দুই বছর পর বয়সের কারণ দেখিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে সরিয়ে দেয় সরকার। তার বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও বিফল হন ইউনূস। শুধু গ্রামীণ ব্যাংকই নয়, এর সহযোগী অন্য প্রতিষ্ঠানেও কর্তৃত্ব হারাতে হয় ইউনূসকে।
তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সরকার আমাকে বাধ্য করেছে পদটি ছেড়ে দিতে। সরকার যুক্তি দেখিয়েছে, ১১ বছর আগেই আমার রিটায়ার করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল। যে আইনের দ্বারা ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে রাজি হবার সময়ে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (যে পদে আমি আগে অধিষ্ঠিত ছিলাম) নিয়োগের কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম সরকারকে। এটা ছিল আমার আরেকটি বড় ভুল।”
গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়া হওয়ার পর একের পর এক মামলাও হতে থাকে ইউনূসের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মান্ডি লন্ডারিং, শ্রম আইন লঙ্ঘন, দুর্নীতির অভিযোগে ১৬৮টি মামলার খবর পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে গ্রামীণ টেলিকম সংক্রান্ত ৬৪টি, গ্রামীণ কল্যাণ ফাউন্ডেশন সংক্রান্ত ৬৯টি, গ্রামীণ কমিউনিকেশন্স সংক্রান্ত ২৫টি, গ্রামীণ ফিসারিজ সংক্রান্ত ৮টি, আয়কর সংক্রান্ত ৮টি ও ফৌজদারি মামলা দুটি।
এরমধ্যে অনেক মামলা প্রত্যাহার হলেও শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের করা মামলায় গত ১ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান হিসাবে ইউনুসকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
তবে ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মনোনীত হওয়ার পর বুধবারই ওই মামলার আপিলের রায়ে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মামলার পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রী ও দলের নেতারা ইউনূসকে কটাক্ষ করে একের পর এক মন্তব্য করে গেছেন গত দেড় দশকে। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে।
সব মিলেয়ে ক্রমাগত হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন বলে কয়েক মাস আগেই বলেছিলেন ইউনূস।
তবে এই সময়ে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে নানা বিবৃতি দিয়েছিল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিবৃতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ইউনূসকে হয়রানি না করতে শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন শতাধিক নোবেলবিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ২৪২ ব্যক্তি।
এসবও চক্ষুশূল হয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের। বিদেশে ইউনূস বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন, এমন কথাও বলেছিলেন শেখ হাসিনা।
এখন শেখ হাসিনাই দেশে বিতাড়িত হয়ে বিদেশে আশ্রয়প্রার্থী; আর ইউনূস আমন্ত্রিত হয়ে সরকারে।
গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার পতনকে বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসাবে দেখছেন ড. ইউনূস।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে তিনি বলেন, “তিনি (শেখ হাসিনা) যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, তত দিন আমাদের দেশ দখলকৃত ছিল। তিনি দখলদার শক্তি, একজন স্বৈরশাসক, জেনারেলের মতো আচরণ করছিলেন, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। আজ বাংলাদেশের সব মানুষ নিজেদের স্বাধীন মনে করছে।”
এখন বাংলাদেশকে নতুন করে গড়তে চান ড. ইউনূস।