বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘‘শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙালির থেকে অনেক উঁচুতে ছিলো তার মাথাটি, সহজেই চোখে পড়তো তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তার সমকালীন এবং প্রাক্তন সকল বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ।
জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়; হিটলার মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, আগ্নেয়গিরিতে পরিণত করেছিলো, যার পরিণতি হয়েছিলো ভয়াবহ। তারা জনগণকে উন্মাদ আর মগজহীন প্রাণীতে পরিণত করেছিলো। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভ প্লাবন, শুভ আগ্নেয়গিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙালি মুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।’’
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ছিল মাত্র ২৩ বছরের। এর মধ্যে ১২ বছরের বেশি কারাগারে ছিলেন। তিনি তার রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আদর্শের সঙ্গে সমন্বিত করে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। সব বাধার পাহাড় অতিক্রম করে ইতিহাসের মহাসড়ক ধরে তিনি নিজস্ব পথ তৈরি করে এগিয়ে গেছেন। তার নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তাই উদ্দেশ্যপূর্ণ কূটতর্কে অবতীর্ণ না হয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানা, তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানা বাঙালিমাত্রই অবশ্যকর্তব্য হওয়া উচিত।
স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির দোসর ও বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা ক্ষমতায় বসে। নিষিদ্ধ হয় বঙ্গবন্ধু। তখন বাংলাদেশে ১৫ আগস্ট কোনও শোকদিবস ছিল না। মুষ্টিমেয় কিছু সচেতন ব্যক্তি এই দিনটি এলে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করত। কিন্তু কোথাও কোনও আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।
এরপর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করলেন। শুরু হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালনের চর্চা। দিন যত গড়াতে লাগল, ১৫ আগস্ট নিয়ে মাতামাতি বাড়তে থাকল। এটা এক সময় চরম বাড়াবাড়ির পর্যায়ে উপনীত হয়। এই দিবস পালনের নামে আওয়ামী লীগের নেতাদের মাঝে শো ডাউনের প্রবণতা বাড়তে থাকে। ১৫ আগস্ট উদযাপন উপলক্ষে কয়েকগজ অন্তর অন্তর মাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজানো, কাঙালি ভোজের নামে মহা উৎসব, ব্যাপক হারে চাঁদা আদায়, চাঁদার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে নিয়ে সংঘাত, দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করা, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে মুজিব কর্নার তৈরি করা, যেখানে-সেখানে ভাস্কর্য নির্মাণ, মুজিব বর্ষ পালনের পালনের নামে বছর ধরে সবাইকে জবরদস্তিমূলকভাবে এক ধরনের বঙ্গবন্ধু-চর্চায় বাধ্য করা, গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রতিদিন প্রচার-প্রচারণা-স্তব-স্তূতিতে বাধ্য করা ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এই ট্রাজিক দিনটিকে একটা ‘অত্যাচারের দিবসে’ পরিণত করা হয়। দিনকে দিন দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এই দিবসটিকে আওয়ামী লীগের দিবসে পরিণত করা হয়।
লেবু বেশি কচলালে যেমন তিতা হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়িও তেমনি বিপরীত ফল দেয়। মানুষ শুধু শেখ হাসিনা নন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিও বিরূপ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠে। এরই ফলস্বরূপ তীব্র ছাত্র-গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুরও ‘পতন’ ঘটে। ভেঙ্গে ফেলা হয় বঙ্গবন্ধুর সব ভাস্কর্য। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হয়। আর এই হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসহনীয় মাত্রায় স্তব-স্তূতি ও তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি নতুন প্রজন্মকেও ক্ষেপিয়ে দিয়েছে।
যে বঙ্গবন্ধু দেশের অগণন মানুষের কাছে আবেগ-অনুভূতি, স্বাধীনতার প্রতীক, সেই বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে এখন কারও মনে এতটুকু দ্বিধা হয় না। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের লীগের প্রতি আন্দোলনকারী মানুষের সীমাহীন ক্ষোভ ও রোষের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বাতিল করেছে।
যদিও তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শোক ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য জাতীয় ছুটির কোনও প্রয়োজন নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী তারা নীরবে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। বরং ফ্যাসিবাদী ও সংকীর্ণমনা আওয়ামী লীগের খপ্পর থেকে এবার বঙ্গবন্ধু রেহাই পেয়েছেন। এবার হৃদয়ের পবিত্র আবেগ দিয়ে দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করবে।
আরেকটি কথা। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের দুঃশাসন ও অপকর্মের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে এক করে দেখা যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, তার অবদান নিয়ে, চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে আরও অনেক বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। পাশাপাশি কিছু নির্মোহ একাডেমিক আলোচনাও হওয়া দরকার। ব্যক্তিকে দেখতে হয় সামগ্রিকভাবে, তার দোষক্রুটিসহ। দোষত্রুটিগুলোকে বড় করে না দেখে, সেখান থেকে উত্তরপ্রজন্মকে শিক্ষা লাভ করতে হয়। শুধু পূজা করা বা পূজার ছলে পূজনীয়কে ভুলে থাকা বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়।
অবশ্য, আমাদের সমাজে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবার ভিন্ন ভাবে বুঝবার-উপলব্ধি করবার বোধটাই যেন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ-হারতে-থাকা-বাঙালির কাছে যুক্তি হয়ে উঠছে কারাগার, বাইরেটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বধ্যভূমি, কর্মের প্রতিশব্দ পরাধীনতা এবং জ্ঞানচর্চাকে মনে হচ্ছে উত্তরোত্তর বন্ধ্যা। যেহেতু বৈষয়িক কারণেই ক্লেশ, অতএব কামিনী-কাঞ্চন যেন পরিহার্য। গ্লানির বাইরে থেকে ত্যাগ-শৌর্য-বীর্য আর অসীম সাহসে স্বাধীনতা ও মুক্তির বন্দরে একটি পুরো জাতিকে পৌঁছে দেওয়ার তাড়নাতেই বঙ্গবন্ধুর অনন্যতা ও জনপ্রিয়তা। যিনি তার সমকালীন সামূহিক আত্মধিক্কারকে একটা পৌরুষের পোশাক পরিয়ে, জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং পেরেছিলেন।
তিনি আজীবন স্রোতের বিপরীতে চলেছেন, নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন স্রোতধারা। বিরুদ্ধ পরিবেশ অনুকূলে আনার জন্য তাঁকে কী নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার রাজনীতিসচেতন সবারই। আর এটা জানার পথ সুগম হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশ হওয়ায়। শৈশব থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক নানা ঘটনা, যার বেশিরভাগের সঙ্গে ছিল তার প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরেছেন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। অর্থাৎ এ বইয়ে বিবৃত হয়েছে তার মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়সকালের ঘটনাবলি।
নিজের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: ‘‘আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ।’’
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকপট মানুষ। স্পষ্টবাদিতা ছিল তার অন্যতম গুণ। নিজের সম্পর্কে তার নিজের মূল্যায়ন: ‘‘আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেওয়া হতো, আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনোদিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেই জন্যই আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। …আমি মুখে যা বলি, তা-ই বিশ্বাস করি। আমার পেটে আর মুখে এক কথা। আমি কথা চাবাই না। যা বিশ্বাস করি বলি। সেজন্য বিপদেও পড়তে হয়। এটা আমার স্বভাবের দোষও বলতে পারেন, গুণও বলতে পারেন।’’
এই দোষ-গুণ নিয়েই তো বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ থেকে অসাধারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মানুষকে ব্যবহার, ভালোবাসা, প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়। অত্যাচার, জুলুম, ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।’ এই বিশ্বাস তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন।
যদিও তার শাসনকালটা সুখের হয়নি। এখানেও নানা জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল। ছিল দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-লোভ ক্ষমতার কাড়াকাড়ি। ক্ষমতার দম্ভ কী ছিল? ছিল কী দলীয় সংকীর্ণতা, ছিল কী সব কিছু যথাযথভাবে ম্যানেজ করবার দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব? এসব কিছুই সবার ভালোভাবে জানা দরকার। দরকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মোহ চর্চার।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘শেখ মুজিবের ছবি যদি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়— এই বাংলাদেশে শেখ মুজিবের একটি ছবিও যদি খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলেও যে ছবিটি সবচে বড় সেটি শেখ মুজিবের। এবং অন্য সব ছবি আসবে যাবে তোলা হবে। যেমন— নাপিতের দোকানে যুগে যুগে কতো অভিনেত্রীর ছবি উঠেছে— এক কালে কাননবালার ছবি উঠেছে, আরেক কালে মধুবালার ছবি উঠেছে— এখন অন্যান্য বালাদের ছবি উঠে— এমন কতো ছবি আসবে যাবে। কিন্তু শেখ মুজিবের ছবি স্থির এবং এটা শুধু দেয়ালের ছবি নয়। শেখ মুজিবের ছবি সমস্ত বাংলাদেশেই অংকিত রয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।’’
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট।
ইমেইল: [email protected]