ফিলিস্তিনের গাজা থেকে ছয় জিম্মির লাশ উদ্ধারের পর ইসরায়েলিদের রক্তে যেন আগুন লেগেছে। গোটা ইসরায়েল যেন তাদের গতিপথ পরিবর্তনের প্রয়োজন অনুভব করছে। আর তা ব্যাপক চাপ হয়ে উঠেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার সময় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ১০৯ জনকে মুক্তি দেয় হামাস। ইসরায়েল উদ্ধার করে ১০ জনকে।
বাকিদের মধ্যে ৩০ জনের বেশি মারা গেছে। হামাসের হাতে এখনও প্রায় ১০১ জন জিম্মি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে তার মধ্যেও ৩৫ জনের বেশি মৃত বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এর মধ্যেই ছয়জনের লাশ গত শনিবার দক্ষিণ গাজার রাফা এলাকায় একটি সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধার করে ইসরায়েলি সেনারা।
এর পরিদন রবিবার রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে লাখ লাখ ইসরায়েলি রাস্তায় নেমে আসে। নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে তারা জিম্মিদের মুক্তির জন্য অবিলম্বে চুক্তির দাবি তোলে।
বিক্ষোভস্থল থেকে জিম্মি মুক্তির চুক্তির দাবিতে সোমবার থেকে দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেয় ইসরায়েলের প্রধান শ্রমিক সংগঠন হিস্তাদ্রুত।
জিম্মিদের মুক্তির জন্য চুক্তি করতে সরকারের ব্যর্থতার জেরে তুমুল বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।
তবে প্রবল বিক্ষোভ এবং শ্রমিক ইউনিয়নের ধর্মঘটের মধ্যে সামনের সপ্তাহগুলোতে কী ঘটবে, তা অনিশ্চিত।
এ ধরনের গণবিক্ষোভ এবং ধর্মঘটে এর আগে ইসরায়েলে সরকার পতনের নজির যেমন রয়েেছ, তেমনি নেতানিয়াহুর অতীতে এমন সংকটের মধ্যেও টিকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এমনকি এবারও নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভার কট্টর-ডান জাতীয়তাবাদী সদস্যরা আদালতের আদেশের মাধ্যমে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট বন্ধ করার জন্য কাজ করছেন, যা অন্তত স্বল্প মেয়াদে হলেও সফল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এবারের পরিস্থিতিটি গত কয়েকমাস ধরে অস্থিরতার ফল হিসাবে এসেছে। তাই এর পরিণতি কী হতে পারে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ বিক্ষোভকারীদের মধ্যে এবার সংঘাত-সহিংসতার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।
রবিবার গভীর রাত পর্যন্ত তেল আবিবের ব্যস্ততম আট লেইনের আয়লন মহাসড়কে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ ছিল তারই একটি প্রকাশ।
এসময় এক তরুণ বিক্ষোভকারীর হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে ‘জিম্মিমুক্তি চুক্তি আর নয়ত বিদ্রোহ’ এমন স্লোগানও দেখা গেছে।
এবার বিক্ষোভে তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মতো। দুজন কিশোরী জানায়, তারা আগে কখনও বিক্ষোভ করেনি। কিন্তু শনিবার ৬ জিম্মির মৃ্ত্যুর খবরে ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে।
সিএনএনের প্রতিবেদক যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিল, তারা কী মনে করে, এই বিক্ষোভ নেতানিয়াহুর মন পরিবর্তন করতে পারবে। উত্তরে তারা উভয়েই বলেছিল, এ বিষয়ে তাদের সন্দেহ রয়েছে।
সব ইসরায়েলিরই এখন এই একটাই প্রশ্ন। অনেকের মতেই বিক্ষোভ ও ধর্মঘট সরকারের পায়ের নিচের মাটি সরিয়ে দিচ্ছে।
এমনকি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তও প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর কৌশলের নিন্দা করেছেন। এতে সরকারের মধ্যে আগের ফাটলগুলোও বেরিয়ে আসছে।
গত বছর সরকারের বিতর্কিত বিচারিক সংস্কারের বিরোধিতা করায় নেতানিয়াহু তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। তবে কিছুদিন পরই আবার তাকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন।
পার্থক্য হল এখন গ্যালান্ত ও ইসরায়েল একসঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লড়ছে— দক্ষিণে হামাস; উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহ; পশ্চিম তীরে কথিত সন্ত্রাসী হুমকি; এক মাস আগে তেহরানে হামাস নেতাকে হত্যার জন্য ইরানের প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি।
বহুমুখী বহিঃশত্রুর পাশাপাশি নিজের ঘরেও নেতানিয়াহু স্বস্তিতে নেই। তার অভূতপূর্ব জোট সরকারের মন্ত্রিসভাটিও চরম-ডান জাতীয়তাবাদী নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতমার বেন গাভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচের কব্জায়।
এই দুজন সারাক্ষণই নেতানিয়াহুকে হামাসের প্রতি নমনীয়তা দেখালে জোট সরকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকিতে রাখেন। তবে নেতানিয়াহুর সরকার না থাকলে তারাও কোনও পাত্তা পাবে না।
সরকারে তাদের সময় সীমিত হতে পারে জেনে তারাও তাদের নিজস্ব ভিত্তি তৈরি করে, এমন নীতি বাস্তবায়নের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। যেমন, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ। নেতানিয়াহু ক্ষমতা হারালে তাদের পায়ের নিচেও মাটি থাকবে না। এ কারণেই তারা বিক্ষোভ-ধর্মঘট বন্ধে এগিয়ে এসেছে।
তবে রবিবার বিক্ষোভের সময় পুলিশ যখন জনতার ওপর লাঠিচার্জ করে তখন অনেকে তাদের চিৎকার করে বলেছিল, “আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে নই, শুধু আপনাদের বস বেন গাভিরের বিরুদ্ধে।”
বিক্ষোভ-ধর্মঘট দমনে বেন গাভির আদালতের আদেশের মাধ্যমে পুলিশকে বলপ্রয়োগের অধিকার দিয়েছেন। এখন বিক্ষোভকারীরা তা মোকাবেলায় কতটা সাহসী হয়, তার ওপই নির্ভর করছে নেতানিয়াহু সরকারের টিকে থাকা।
সরকারি চাপের মুখে দেশের সম্ভাব্য শক্তিশালী ইউনিয়নগুলো কতটা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
সোমবার সকালে ধর্মঘটের কারণে ইসরায়েলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বেন গুরিওন স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে পরে অবশ্য বিমান চলাচল শুরু হয়। গত বছর বিতর্কিত বিচারিক সংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্মঘটের সময়ও বিমান বন্দরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে এখনও অনেক কিছুতে ভারসাম্য আছে। রবিবার নেতানিয়াহু তার সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তায় ছয় জিম্মির মৃত্যুর জন্য হামাসকে দোষারোপ করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি জিম্মি মুক্তির আলোচনায় স্থবিরতার জন্য তার দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন।
কিন্তু হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি মূলত তার বাড়তি শর্ত আরোপের কারণেই থমকে গেছে। হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল, কিন্তু নেতানিয়াহু সেই প্রস্তাবে বাড়তি শর্ত আরোপ করে।
অবশ্য, তার অতুলনীয় রাজনৈতিক কুটকৌশল তাকে আগেও বড় গণ আন্দোলনের মুখে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। তাই খুব কম লোকই বাজি ধরবেন যে, শিগগিরই নেতানিয়াহুর পতন হবে। তবে, প্রশ্ন হল, ক্ষমতা কতদিন ধরে রাখতে পারবেন তিনি?
সিএনএন বলছে, রবিবারের মতো আরও দিন, জাতিকে হৃদয়ে যন্ত্রণা, হতাশা এবং ক্ষোভের জ্বরে মুড়িয়ে নেতানিয়াহুকে চ্যালেঞ্জ জানাবে, যেমনটা আগে কখনও হয়নি।
তিনি এবার কেবল তার স্বাভাবিক শত্রু তথা দেশের উদারবাদী বামপন্থীদের বিরুদ্ধেই নন, হামাস নেতার সঙ্গেও মরনপণ লড়াইয়ে জড়িয়েছেন। হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য অকল্পনীয় নৃশংসতার আশ্রয় নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন।
সবমিলিয়ে জিম্মিদের মুক্তির সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসার পাশাপাশি নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অন্ধকার হয়ে আসছে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন