দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আয়কর বৃদ্ধি, জনগণের কাঁধে ঋণের বোঝাসহ নানা বিষয় নিয়ে আফ্রিকার দেশ কেনিয়া অনেকদিন ধরেই উত্তপ্ত। সম্প্রতি সেই পরিস্থিতিতে ঘি ঢালার মতো করে যুক্ত হয়েছে দেশটির রাজধানী নাইরোবির একটি বিমানবন্দর ভারতের আদানি গ্রুপের অধিগ্রহণের খবর।
এ খবর চাউর হওয়ার পরপরই দেশটিতে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে বিমানবন্দরটির কর্মীরা। তাদের এই ক্ষোভের সঙ্গে অন্য সব বিষয়ে জন অসন্তোষও যুক্ত হয়েছে।
সব মিলিয়ে দেশটিতে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই বিক্ষোভ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের মতো ভারতের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কংগ্রেস নেতারা।
কেনিয়ার এখনকার ঘটনার শুরু মূলত সরকারের একটি বিবৃতিতে কেন্দ্র করে।
গত মাসে কেনিয়ার সরকার জানায়, জোমো কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (জেকেআইএ) বছরে ৭৫ লাখ যাত্রী ঠিকভাবে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু যাত্রী ক্রমশ বাড়ছে। তাই পরিকাঠামোর উন্নতি করা দরকার জরুরি ভিত্তিতে।
জেকেআইএর আধুনিকায়নে ২০০ কোটি ডলার দরকার। বর্তমান আর্থিক অবস্থায় এই অর্থ দেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন।
ওই বিবৃতিতেই বিমানবন্দরটি নিয়ে আদানি গ্রুপের প্রস্তাবের বিষয়টি সামনে আনে কেনিয়ার সরকার। সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপ কিছুদিন আগে জেকেআইএ অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল কেনিয়া সরকারকে।
ভারতের সংবাদপত্র টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, বিমানবন্দরটি অধিগ্রহণের জন্য আদানি গ্রুপ এরইমধ্যে সেখানে একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি খুলেছে।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর বিক্ষোভ করে দেশটির বিমান উড্ডয়ন পরিচালনাকারী কর্মীদের সংঠন ‘কেনিয়া এভিয়েশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’।
গত ১৯ আগস্ট শুরু হয় ইউনিয়নের ওই বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীদের আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এরপর দ্রব্যমূল্যসহ নানা বিষয়ে অসন্তোষ থেকে আরও জুন থেকে আরও মানুষ যোগ দেয় বিমানবন্দরের কর্মীদের কর্মসূচিতে। রাতারাতি রাজধানীর বাইরে কয়েকটি বড় শহরেও ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, কেনিয়ার সরকারের সঙ্গে আদানি গ্রুপের চুক্তি হলে দেশটির অনেকে চাকরি হারাবে। আর সেসব জায়গায় কাজ করবে অ-কেনীয়রা। তারা এ সংক্রান্ত চুক্তির প্রস্তাবটিকে বাতিলের আহ্বান জানাচ্ছে।
কেনিয়া এভিয়েশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মস এনডিয়েমা বলেন, “আদানির সঙ্গে চুক্তি পুরোপুরি বাতিল করতে হবে। কেনিয়া এয়ারপোর্টস অথরিটির (কেএএ) পুরো বোর্ডকে ইস্তফা দিতে হবে।”
তবে কেনিয়ার সরকার বলছে, তারা বিমানবন্দরটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়নি। দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরটি নিয়ে কোনও চুক্তি এখনও হয়নি। প্রস্তাবিত পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে বিমানবন্দরের উন্নয়নের কাজের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এমন অবস্থায় মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা জয়রাম রমেশ। এনিয়ে তিনি সোশাল মিডিয়ায় পোস্টও দিয়েছেন।
রমেশ লেখেন, “কেনিয়ায় আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘটনা ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানির বন্ধুত্বের বিষয়টি বৈশ্বিকভাবে সবাই জানেন। এই বিক্ষোভ সহজেই ভারত এবং ভারত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে।”
কংগ্রেস বলছে, ঐতিহাসিকভাবে ভারতের ‘সফট পাওয়ার’ তার পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম শক্তি।
এই প্রসঙ্গ টেনে রমেশ বলেন, আজ আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর যোগসাজশ এই শক্তিকে খর্ব করতে এবং বিশ্বমঞ্চে ভারতের জন্য অভূতপূর্ব পরিবর্তনে ভূমিকা রেখে চলছে।
বর্তমানে কেনিয়ায় ২০ হাজার ভারতীয় নাগরিক এবং ৮০ হাজারের বেশি ভারতীয় বংশোদ্ভুত বাস করে।
আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার কেনিয়ায় বসবাসরত ভারতীয়দের নিরাপদে থাকার নির্দেশ দিয়েছে নাইরোবিতে অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশন।
আদানি এয়ারপোর্ট কোম্পানি ভারতের বেশ কয়েকটি বিমানবন্দর পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে মুম্বাই, তিরুবনন্তপুরম, জয়পুর ও গুয়াহাটি বিমানবন্দর।
কংগ্রেস নেতা রমেশ আদানি গ্রুপ ইস্যুতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণও টেনেছেন তার বক্তব্যে।
রমেশ বলেন, “বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আদানির প্রকল্পগুলো ঘিরে অনুরূপ বিতর্ক হয়েছে, যা আমাদের (ভারতের) জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। দেশের জন্য খারাপ ফলাফল বয়ে আনছে।”
রমেশ আরও দাবি করেন, ঝাড়খণ্ডে আদানি পাওয়ারের কয়লা প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিটি আগস্টে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনের মধ্যে ‘একটি ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ হয়ে ওঠে।
দ্য স্ক্রল বলছে, বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ রপ্তানি দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে ২০১৭ সাল থেকে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করছে।
আদানি গ্রুপ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয় ২০১৫ সালের আগস্টে, তার কিছুদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করেন।
আদানি গ্রুপ ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে চুক্তিতে মোদী সরাসরি জড়িত কি না, তা নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছে ভারতের বিরোধী দলগুলো।
গত বছর বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চুক্তিটি সংশোধনের আবেদন জানিয়ে আদানি গ্রুপকে চিঠি দিয়েছিল।
এই আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের কয়েকদিন পর ভারত সরকার বিদ্যুৎ রপ্তানির নির্দেশিকা সংশোধন করে আদানি পাওয়ারকে ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে’ বাংলাদেশের কাছে চুক্তিবদ্ধ বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি দেয়।
কংগ্রেস নেতা রমেশ বলেন, “শ্রীলঙ্কার মান্নার জেলায় অবস্থিত আদানির প্রকল্পগুলোও ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের ‘একটি কারণ’ ছিল।”
২০২২ সালের জুনে শ্রীলঙ্কার শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছিলেন, আদানি গ্রুপকে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প দিতে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে চাপ দিয়েছিলেন মোদী। অবশ্য ওই কর্মকর্তা পরে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করেন এবং শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষও অভিযোগ অস্বীকার করে।
দ্য হিন্দু ও কেনিয়ার একাধিক সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুসারে, আদানি গ্রুপ কেনিয়ার বিমানবন্দরটি ৩০ বছর মেয়াদে পরিচালনা করতে চেয়েছিল। এই বছরের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি ৭৫ কোটি ডলারের ওই প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, ট্যাক্সিওয়ে সংস্কার ও দুটি দ্রুতগতির ট্যাক্সিওয়ে নির্মাণের বিষয় ছিল।
প্রস্তাবে এসব প্রকল্পের কাজ ২০২৯ সালের মধ্যে শেষ করার কথা বলা হয়। প্রস্তাব অনুসারে ৩০ বছর পরিচালনার পর আদানি গ্রুপ বিমানবন্দরটি কেনিয়ার কাছে বুঝিয়ে দেবে।
বিমানবন্দর সংক্রান্ত আরও কিছু কাজের জন্য বাড়তি ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারের প্রকল্পও প্রস্তাব দিয়েছিল আদানি গ্রুপ।
স্ক্রল জানিয়েছে, আদানি গ্রুপ বিমানবন্দরের সঙ্গে নাইরোবিতে বাণিজ্যিক কেন্দ্র ও হোটেল নির্মাণেরও প্রস্তাব দিয়েছে। তবে এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি।