নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরের গাছপালা নিয়ে লিখেছিলেন ‘শ্যামলী নিসর্গ’। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত সে বইটি এখনও ঢাকার বৃক্ষচর্চার আকরগ্রন্থ। তিনি শ্যামলী নিসর্গ লিখে রেখে না গেলে সেকালের ঢাকার পথতরুর বৃত্তান্ত আমরা হয়তো জানতে পারতাম না। কিন্তু ঢাকার সেসব পথতরুর এখন কী অবস্থা? আজও কি সেগুলো বেঁচে আছে? দ্বিজেন শর্মার আত্মজ সে বৃক্ষরা এখন ঢাকার কোথায় কীভাবে আছে সে কৌতুহল মেটানো আর একালের পাঠকদের সঙ্গে ঢাকার সেসব গাছপালা ও প্রকৃতির পরিচয় করিয়ে দিতে এই লেখা। কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মৃত্যুঞ্জয় রায় সরেজমিন অনুসন্ধানে তুলে ধরছেন ঢাকার শ্যামলী নিসর্গের সেকাল একাল। ঢাকার প্রাচীন, দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য ও অনন্য পথতরুর বৃত্তান্ত নিয়ে সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বাংলা বারো মাসে বারো পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন ভাদ্র পর্ব।
শরৎকালের প্রথম মাস ভাদ্র। বর্ষার পর মাঠঘাটের কাদা শুকাতে শুরু করে, বানের পানি ও পুকুরের পানিতেও টান ধরে, বৃষ্টিস্নাত গাছেরা ভেজা পাতাগুলো মেলে রোদ পোহানো শুরু করে, নীল আকাশে ভাসতে শুরু করে সাদা সাদা মেঘের ভেলা।
সবুজের বিস্তীর্ণ ধানখেত আর নীল আকাশ মাখামাখি করে রচনা করে এক অপূর্ব দৃশ্যপট। সে দৃশ্যে গ্রামের মাঠে-প্রান্তরে, রাস্তার ধারে উচ্চশির ফলভরা তালগাছগুলো যেন বিজয় কেতন উড়াতে থাকে, পাখার মতো পাতায় পাতায় হাওয়ায় দোল খেতে থাকে বাবুই পাখিদের বাসাগুলো, গগন শিরীষ ছুঁতে চায় শরতের নীল আকাশ।
ঢাকা শহরের বৃক্ষ বৃত্তান্ত: শ্রাবণ পর্ব
ঢাকা শহরে এ দৃশ্য বিরল হলেও ভাদ্রের সে হাওয়ার দোল লাগে পাইনগাছের ঝিরিঝিরি পাতায়, এ দৃশ্য আবার গ্রামে বিরল। ঢাকাসহ সারা দেশেই বিরল চন্দন বৃক্ষ। তবে যে গাছটিকে আমরা রক্তচন্দন বলে অনেকে ভুল করি, ফুলে-ফলে ভরা সেই রঞ্জনা গাছটি বেশ দেখা যায়। আর একটি দুর্লভ গাছ আছে বলধায়, তার নাম অপরূপ চাঁপা। ভাদ্রে এসব গাছের রূপশোভা হয় অন্যরকম।
বজ্রযোগী তালগাছ
এ দেশে ভাদ্র মাস হলো তালের প্রতীক— বৈশাখে তালের শাঁসে যাত্রারম্ভ, ভাদ্রে তালের রসে সে যাত্রার সমাপন। ভাদ্রে তালবড়ার জন্মাষ্টমী, আশ্বিনে দুর্গাপূজার তালনবমী ও গাস্যিপূজায় গ্যাাঁজানো তালের আঁটি কেটে ফোপা খাওয়ার পরই আসলে শেষ হয় তালপর্ব। তালের ফুল থেকে ফোপার এই চক্রটি সম্পন্ন হতে প্রায় ছয় মাস সময় লেগে যায়। প্রাচীনকালে কাগজ আবিষ্কারের আগে তালপাতাই ছিল লেখার বস্তু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ছোটবেলায় আমরা সবাই পড়েছি, ‘‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে’’। তালগাছ যেখানে জন্মে সেখানে থাকা অন্য গাছদের সে ছাড়িয়ে উঠে যায় সবার উপরে। তাল নিয়ে খনার বচনটি মোটেই মিথ্যে নয়:
‘‘এক পুরুষে রোপে তাল
অন্য পুরুষি করে পাল।
তারপর যে সে খাবে
তিন পুরুষে ফল পাবে।’’
একটা তালগাছ বাঁচে একশো বছরেরও বেশি আর লম্বা হয় প্রায় একশো ফুট। লাগানোর পর সে গাছে তাল ধরতে সময় লাগে প্রায় বিশ বছর। অনেকে এ জন্য তালগাছ লাগিয়ে অনেকেই তার ফল খেয়ে যেতে পারে না। একটা তালগাছে পঁচিশ থেকে চল্লিশটা পাতা থাকে। এত বড় পাতা খুব কম গাছের থাকে। একটা গাছে বছরে ছয় থেকে বারোটা কাঁদিতে তিনশোটা পর্যন্ত তাল ধরে।
পুরুষ তালগাছে ফল ধরে না, পুরুষ ফুলের জটা হয়। জটা কেটে রস নামানো হয়। স্ত্রী গাছে ফল ধরে। অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে তালগাছে ফুল ফোটে। দেড় থেকে দু’মাস ধরে পুরুষ পুষ্পমঞ্জরিতে ফুল ফুটতে থাকে, চৈত্র-বৈশাখে তালের রস নামে। চৈত্র-বৈশাখে মাসে কচি তালের শাঁস হয় ও ভাদ্র-আশ্বিন মাসে তাল পাকে, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে তালের আটি থেকে গ্যাঁজ হয় ও ভেতরে ফোপা হয়। এই হলো তালের বর্ষচক্র।
তামিল ভাষায় কবি থিরুকুন্ডনথাই অরুনাচলমের ‘তাল বিলাসম’ নামে একটি প্রাচীন কবিতা আছে। সে কবিতায় তালগাছের ৮০১টি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তালগাছকে বলা হয় ‘কল্পবৃক্ষ’ অর্থাৎ এ গাছের কাছে বেঁচে থাকার জন্য যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়।
এ গাছ থেকে পাওয়া যায় রস, গুড়, চিনি, তালমিশ্রি, তালশাঁস, তাল ফল, তাল ফোঁপা, নারকেলের মতো বীজের শাঁস থেকে তেল ইত্যাদি খাবার। এমনকি তালের আটি থেকে সদ্য গজানো অংকুর বা গ্যাঁজ সিদ্ধ করে খাওয়া যায় যা পুষ্টিকর।
পাকা ফলের আঁশে পাওয়া যায় রেয়নের মতো সুতা যা দিয়ে তৈরি করা যায় বস্ত্র, বাসস্থান নির্মাণের জন্য তালকাঠের চেয়ে শক্ত কাঠ আর কি আছে! তালগাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
যে যুগে কাগজ আবিষ্কার হয়নি, সে যুগে তালপাতা ব্যবহৃত হতো লেখার জন্য। এখনও অনেক জাদুঘরে তালপাতার পুঁথি সংরক্ষিত আছে। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা— মানুষের এই পাঁচটি মৌলিক চাহিদার সবকটিতেই আমাদের সহায়ত হিসেবে থাকে তালগাছ।
তালগাছের বিভিন্ন অংশ থেকে তৈরি কারুপণ্য যেমন— হাতপাখা, টুপি, ব্যাগ, বর্ষাতি, মাথাল, ঝুড়ি উপার্জনের উৎস। আমাদের দেশের তাড়ির মতোই তালের রস আফ্রিকায় মদ ও বিয়ার তৈরির অন্যতম উপকরণ। একটি গাছ থেকে বছরে প্রায় দেড়শো লিটার রস পাওয়া যায়।
তালের ব্যবহার শতশত। তাল শব্দটির ব্যবহার আছে বাংলার বাগধারা, প্রবাদ ও প্রবচনেও। যেমন— তালগাছের আড়াই হাত, তালকানা, তালপুকুর, তালপাতার সেপাই, তালগোল পাকানো ইত্যাদি। তালের রস থেকে তৈরি হয় গুড়, বাদামী চিনি, তালমিশ্রি, তালপাটালি, তাড়ি, বিয়ার, মদ ইত্যাদি। পাকা তালের কমলা রস বা গোলা থেকে তৈরি হয় তালবড়া, তালপিঠা, তালক্ষীর, তালপাটালি, তালবরফি ইত্যাদি।
তালের আটি থেকে হয় গ্যাঁজ বা অংকুর, ফোঁপা, তালসুপারি, তেল ইত্যাদি। গাছের গুড়ি থেকে বানানো হয় তালের ডোঙা, তালকাঠ। পাতা থেকে হয় হাতপাখা, ঘরের ছাউনি, টুপি, পাটি, হাতব্যাগ, বর্ষাতি বা ছাতা, মাথাল, তালপাতার বাঁশি ইত্যাদি।
তালগাছ পরিবেশ সংকটে প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। জলবায়ু পরিবর্তনে একদিকে যেমন খরায় পুড়ছে মাটি, সংকটে পড়েছে মাটির নিচে থাকা পানির স্তর, বাড়ছে শৈত্যপ্রবাহ, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো বজ্রপাতের দুর্যোাগ। সব দুর্যোগ মোকাবেলা করে ঠায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে একমাত্র তালগাছ।
পাখিরা তা জানে, অথচ মানুষ জানে না। বাবুই বাসা বাঁধে তালগাছে, বাদুড় ঝোলে তালগাছে, শকুন ও ঈগল আশ্রয় নেয় তালগাছে। সারাদিন মাঠে চড়ে বেড়ানো ময়ূরও রাতে ঘুমায় তালগাছের মাথায়। টিয়াপাখি ডিম পাড়ে তালগাছের উপরে। এজন্য কোনও কোনও দেশে তালগাছকে মনে করা হয় শক্তির প্রতীক হিসেবে।
কম্বোডিয়ার জাতীয় বৃক্ষ তাল। মহাভারতের যুদ্ধে ভীষ্মের রথের নিশান বা ধ্বজায় খচিত ছিল তালগাছের চিহ্ন। ধারণা করা হয়, তালগাছ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ যার কাছ থেকে আমরা পাই কাঁচা ও পাকা ফল, কাঠ, পাতা, রস, মোম ইত্যাদি।
তালগাছ যেন এক বজ্রযোগী, মানুষ ও প্রাণীকে বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে চলেছে সেই অনাদি কাল থেকে। যেসব এলাকায় লম্বা লম্বা তালগাছ বেশি, সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যু হার কম। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য দুর্যোগের সঙ্গে বজ্রপাতও এক দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ফাঁকা মাঠে কাজ করতে থাকা অনেক কৃষক বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন।
বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর ৩০০ জন বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছেন, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে গড়ে বজ্রপাতে মারা যায় ২০ জন। সাধারণত নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ২০২৪ সালে শুধু মে মাসেই বজ্রপাতে এ দেশে মারা গেছে ২৮০ জন যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ।
যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, বিগত এক দশকে (২০১০-২০১৯) বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে ২৫৭১ জন, এর প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রামের মানুষ ও ৮৪ শতাংশ পুরুষ। চলন বিল ও হাওরে তাই অনেকেই আর কৃষি কাজ করতে যেতে চাইছেন না।
২০১৬ সালে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার সে বছর ১৭ মে বাংলাদেশের জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় বজ্রপাতকে অন্তর্ভুক্ত করে। সরকার বজ্র নিরোধক হিসেবে তালগাছ লাগানোর ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষ করে বিল বা খোলা স্থানের মধ্য দিয়ে যেসব রাস্তা গিয়েছে তার দু’পাশে এবং জমির আইলে তালগাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।
প্রকৃতির একটা আইন রয়েছে। মাটির নিচে থাকা জল খাবে পৃথিবীতে যত গাছপালা আছে তারা। আর মাটির উপরে নদ-নদী, পুকুর, দিঘী, ঝর্ণা ইত্যাদির জল ব্যবহার করবে মানুষ ও প্রাণীরা। আমরা এ আইন অমান্য করেছি, ভাগ বসিয়েছি গাছপালাদের জলে। তাই তালের মতো গাছেরাও এখন জলকষ্টে পড়েছে। যদিও তালগাছ খরা সহ্য করতে পারে, কিন্তু তারও একটা সীমা আছে।
আমাদের অপকর্মে সেই সীমাও পার হতে চলেছে। খনার বচনে ‘‘কুয়ো হয় আমের ভয় / তাল তেঁতুলের কিবা ভয়!’’ অর্থাৎ কুয়াশায় আমের মুকুল নষ্ট হয় কিন্তু তাল ও তেঁতুলের কিছুই হয় না। এটাও তালের প্রতি প্রকৃতির আশীর্বাদ। সে কারণেই হয়তো আজও তাল টিকে আছে বরেন্দ্রভূমির মতো খরাপীড়িত মাটিতেও ও শৈত্যপ্রবাহের দেশে।
ঢাকা শহরে তালগাছ অনেক স্থানেই দেখা যায়। দ্বিজেন শর্মা ১৯৬৫ সালে পিজি হাসপাতাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) এলাকায় ও নটরডেম কলেজের কাছে অনেক তালগাছ দেখেছিলেন। ঠিক সেই গাছ কি না জানি না, তবে এ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নামফলক বেদীর সামনে একটি মর্দা তালগাছ আছে। শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে, রমনা উদ্যানে, গুলিস্তানে শহীদ মতিউর রহমান শিশু পার্কের ভেতরে পুকুরপাড়েও আছে তালগাছ। ঢাকা শহরের আরও অনেক স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে তালগাছ রয়েছে।
পাইন পাতার ঝিরিঝিরি
পাইন গাছ থাকে পাহাড়ে। হিমালয়ের কুমায়ূন অঞ্চলের রাণীক্ষেত-আলমোড়ার উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢালে ঢালে পাইনের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বিশেষ করে পাইন বনে রৌদ্রছায়ার খেলা আর চিরল চিরল ঝাটার মতো পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া হিমালয়ের হিম হিম বাতাস চোখে মুখে এক অনাবিল আনন্দের ঝাপটা এনে দিয়েছিল। ঝিরিঝিরি পাইনপাতায় বাতাস দোলানো শন শন শব্দ— সে যেন প্রকৃতির এক অপার্থিব সঙ্গীত।
এরকম পরিবেশে খানিকক্ষণ কাটালে রবীন্দ্রনাথের মতো আমাদের মনেও আসে কবিতার বিচিত্র শব্দ— নির্মাণ হয় একের পর এক কবিতা। আলমোড়ায় গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই প্রাচীনত্বের গন্ধে মাখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সেখানে পৌঁছে তিনি নাকি ঘণ্টা দুয়েক কথাই বলতে পারেননি। সেই সৌন্দর্যে তিনি ডুবে গিয়েছিলেন, বিমোহিত হয়ে তিনি লিখেছিলেন— ‘‘এই মাটিতে রইল তাহার বিস্মিত প্রণাম’’। আলমোড়ার সেই পার্বত্য সৌন্দর্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল পাহাড়ি উপত্যকার ঘন সবুজ পাইন বন।
পাইন আমাদের দেশের গাছ না। ঢাকা শহরে তিনটি জায়গায় পাইন গাছের দেখা পেয়েছি— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে, রমনা উদ্যানে ও মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে। ঢাকার মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে থাকা সামাজিক বন বিভাগের নার্সারির ভেতরে রয়েছে কয়েকটি পাইন গাছ। দেখলাম, সেসব গাছের ডালে ডালে ধরে আছে শম্বুকাকার বাদামি রঙের ফল যা ‘পাইন কোন’ নামে পরিচিত।
গাছের তলায় কুড়িয়ে পেলাম কয়েকটা পাইন কোন। গম্বুজের চূড়ার মতো অগ্রভাগ, অনেকগুলো বীজ শক্তভাবে গেঁথে আছে ফলের উপর, কাছের মতো শক্ত ও অগ্রপ্রান্ত শক্ত কাঁটার মতো, বীজের বা ফলের উপর কোনও খোসা থাকে না। এজন্য এদের বলা হয় নগ্নবীজী উদ্ভিদ।
সেখানকার মালি মোজাম্মেল ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম গাছের নাম। তিনি ঠিকই বলে দিলেন, ‘‘ওগুলো পাইন গাছ। অবশ্য অনেকেই একে ঝাউগাছ বলে ভুল করেন। পাইন আর ঝাউ আলাদা গাছ। পাইন পাহাড়ি গাছ, ঝাউ সমতলের, উপকূলের গাছ। পাইন আর ঝাউগাছের পাতা ও ফল দেখলেই সহজে সে তফাৎ বোঝা যায়। থুজা আবার আলাদা গাছ।’’ সত্যিই বড় বিচিত্র এই গাছপালার জগত!
পাইন ছোট থেকে মাঝারি আকারের বৃক্ষ— এ গাছ ৪৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তরুণ অবস্থায় গাছ পিরামিড আকারের থাকলেও পরে ডালাপালা ছড়ানো ও এলোমেলো হয়ে যায়। বাকল লালচে কালো, পুরু, জালিকাকারে ফাটলযুক্ত, বাকল চাড় দিলে পাতের মতো কুলে আসে। পাতা সরু সূঁচের মতো ১০-২৫ সেন্টিমিটার লম্বা, শক্ত, সবুজ, প্রতি গোছায় তিনটি পাতা থাকে। বীজ ভোঁতা শীর্ষযুক্ত ও ডানাবিশিষ্ট। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে ফুল আসে, ফুল আসার প্রায় এক বছর পর ফলধারণ হয়। বীজ দ্বারা বংশবৃদ্ধি ঘটে।
পাইনেসি গোত্রে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির গাছ থাকলেও বাংলাদেশে বন্য পরিবেশে আছে খুব কম, এর মধ্যে খাসি পাইন গাছ যার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Pinus kesyia ও গোত্র পাইনেসি। স্থানীয় ভাষায় এ গাছকে বলে সারাল গাছ। খাসি পাইনগাছ দেখা যায় ভারত, চীন, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে। খাসিয়া ও নাগা পাহাড়ে এদের দেখা যায় বলে এ পাইনের নাম রাখা হয়েছে খাসি পাইন।
বাংলাদেশে এ প্রজাতির পাইন গাছ খুব কম দেখা যায়। ১৯৮৮ সালে জে. ডি. হুকার চট্টগ্রাম থেকে এ প্রজাতির গাছ নথিভুক্ত করেন। তবে তারপর থেকে সে অঞ্চলে আর কোনও খাসি পাইন গাছ সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। বন্য পরিবেশ ছাড়া ঢাকা শহরে রয়েছে আরও দুটি প্রজাতির পাইন গাছ।
দ্বিজেন শর্মা ১৯৯৪ সালে শ্যামলী নিসর্গ বইয়ের দ্বিতীয় মুদ্রণের ভূমিকায় ঢাকা শহরে তিনটি নবাগত বৃক্ষ সম্পর্কে লিখেছিলেন। বৃক্ষ তিনটি ছিল বাওবাব, বিচিত্রা মাদার ও পাইন।
তিনি লিখেছিলেন, ‘‘একটি পাইন গাছ, লাতিন নাম Pinus carabiana, অবশ্যই ক্যারাবীয় এলাকার বাসিন্দা, বাড়ে দ্রুত, বেশ শক্ত সমর্থ, দেখলে মনে হয় সে আর উদ্বাস্তু নয়, এদেশে শিকড় গেড়েছে স্থায়ীভাবেই। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে অজস্র, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, সড়ক ভবনের পাশে এবং অন্যত্র চোখে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানে যে পাইন গাছটি (Pinus longifolia) আছে সেটিই ঢাকায় ওই প্রজাতির একমাত্র প্রতিনিধি ছিল, কিন্তু ছড়াতে পারেনি মোটেই, নিশ্চিতই পরিবেশবৈগুণ্যে।’’
ঢাকা শহরের পাইন গাছগুলো সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করা দরকার।
গগন শিরীষ বা রাজশিরীষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তিন নেতার মাজারের ঠিক উল্টো পাশে নবরূপে সজ্জিত ঢাকা তোরণের রূপ দেখে যতটা মুগ্ধ না হয়েছি, ততটা বিস্মিত হয়েছি কামানের পেছনে দাঁড়ানো গগনস্পর্শী গগন শিরীষ গাছটাকে দেখে। এতো দৈব দুর্বিপাক, অনাদর, অবহেলা সত্ত্বেও সেই প্রাচীন মহীরুহটি সেখানে কীভাবে সেনাপতির মতো টিকে থাকল সেটিই বিস্ময়কর।
সংস্কারের আগেও সেখানে গিয়েছি কয়েকবার। আবর্জনা আর জঞ্জালে সয়লাব, বুনো ঝোপঝাড়ের মধ্যে অন্তরালে ছিল শ্যাওলাধরা মলিন ভগ্নপ্রায় সেই ঢাকা তোরণটি। তখনও তাকে সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছিল সেই গগন শিরীষ গাছটি। হয়তো সেই মমতায় সংস্কার বলেই ঢাকা তোরণের ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সঙ্গে রয়ে গেছে সেই গাছও, সেও তো সেই ইতিহাসের সাক্ষী— অন্তত ঢাকা শহরে গগন শিরীষের আগমনের সাক্ষী সে।
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ পড়ে জানতে পেরেছি যে, গাছটির আদি নিবাস মাদাগাস্কার (প্রকৃতপক্ষে আমেরিকা)। সেখান থেকে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে মঁসিয়ে রিচার্ড কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনে এ গাছের বীজ পাঠান। তখন থেকেই ভারতবর্ষে গগন শিরীষের আগমন ও সূচনা। পরে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে স্যার জর্জ কিং ও স্যার ডেভিড প্রেইন এ গাছটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামকরণ করেন মঁসিয়ে রিচার্ডের সম্মানে ‘অ্যালবিজিয়া রিচার্ডিয়ানা’। এতে ভারতবর্ষে এ গাছের আগমনের সেই ঐতিহাসিক সূত্রটি প্রতিষ্ঠা পায়।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ (মতান্তরে ১৯৬৬) খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কাজলা গেইট থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে সারি করে গগন শিরীষ গাছ লাগানো হয়। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক এ গাছগুলো সংগ্রহ করেছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদিরউজ্জামানের নেতৃত্বে গাছগুলো লাগানো হয়। সে রাস্তাটি গগন শিরীষ গাছের শোভায় মনোরম রূপ ধারণ করে। ওই রাস্তাটিই এখন ‘প্যারিস রোড’ নামে সুপরিচিত। প্যারিস রোডে হাঁটার সৌভাগ্য হয়েছে কয়েকবার। বুদ্ধদেব বসুর দ্রৌপদীর শাড়ি কবিতার মতো সে রাস্তার উপর দেখেছি গগন শিরীষ গাছের ডাল পাতা আর রোদের রশ্মিতে গড়ে ওঠা রৌদ্রছায়ার আল্পনা। ভারী সুন্দর সে দৃশ্য। ঢাকা শহরে যদি গগন শিরীষের এ রকম একটা সড়ক থাকত!
অবশ্য, নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা সেরূপ একটি সড়ক ছাত্রজীবনে দেখেছিলেন। সে সময় মেডিক্যাল কলেজের মুখোমুখি সেক্রেটারিয়েট রোডের দু’পাশে সারিবাধা গগন শিরীষের সৌন্দর্য দেখে রোজ তিনি বিমোহিত হতেন। সেই সৌন্দর্য থেকে বর্তমানে ঢাকাবাসী বঞ্চিত।
তিনি বলেছিলেন, ‘‘এ গাছের কোনও বাংলা নাম নেই, তবে এক বইতে তিনি এর নাম পেয়েছেন বিলাতি আমলকী যা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’’ সে সন্দেহ দূর করতে না পেরে তাই তাঁর ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে তিনি গাছটির নাম তার প্রজাতিগত নাম ‘অ্যালবিজিয়ানা রিচার্ডডিয়ানা’ই লিখেছেন।
এ গাছটির নাম কেন গগন শিরীষ হলো সে সম্পর্কে উদ্ভিদদরদী লেখক জায়েদ ফরিদ ২০১৫ সালে এপ্রিলে ফেইসবুকে ‘উদ্ভিদ চত্বর’ গ্রুপে এক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘‘রাজকীয় বলেই এক সময় এ গাছ রাজকড়ই নামে সমধিক পরিচিতি ছিল। কিন্তু প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক যখন এর বিশালতা আর গগনমুখিতা হৃদয়ঙ্গম করে উচ্চারণ করলেন ‘গগন শিরীষ’ তখন থেকেই মুখে মুখে ফিরছে এই নাম। চিত্রজগতের সুভাষ দত্ত কিংবা শব্দ সৈনিক ও কবি বেলাল মোহাম্মদের পারত্রিক দেহকে রাখা হলো শহীদ মিনারে, গাছের নিচে। পত্রিকা প্রচার করলো, গগন শিরীষের নিচে রাখা হয়েছিল তাদের মরদেহ। এভাবে পত্রিকালব্ধ গগন শিরীষ নামটি খনার বচনের মতোই মুখে মুখে ফিরছে।’’ এ গাছের অন্য নাম রোডচম্বল।
গগন শিরীষের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম অ্যালবিজিয়া রিচার্ডিয়ানা (Albizia richardiana) ও গোত্র ফ্যাবেসি, উপগোত্র মাইমোসয়ডি। গগন শিরীষ পাতাঝরা প্রকৃতির বৃহৎ বৃক্ষ। ডালপালা মেলে এই শিরীষ জাতীয় গাছ সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশের দিকে দ্রুত বেড়ে ওঠে, তাই গগন শিরীষ নামটাই যথার্থ মনে হয়— গগন মানে আকাশ।
আবার সব শিরীষের মধ্যে এ গাছ রাজার মতো উঁচু ও বড়, সেজন্য একে ‘রাজ শিরীষ’ বলা হয়। কিন্তু কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে গাছটি রোডচম্বল নামে কীভাবে পরিচিতি পেল তা বোধগম্য না। গগন শিরীষ গাছের বৃদ্ধির একটা বিশেষ ঢং আছে। গাছের গোড়া থেকে প্রধান কাণ্ড কিছু দূর তরতড়িয়ে লম্বা হয়, এরপর তিনটি ডালে ভাগ হয়, এরপর সে তিনটি ডাল কিছু দূর উঠার পর প্রতিটি ডাল আবার তিনটি ডালে ভাগ হয়।
এভাবে গাছের মাথা বিপুল সংখ্যক শাখা-প্রশাখায় ছাতা বা ফুলকপির মতো রূপ ধরে। কাণ্ড ও ডালপালার বাকল মসৃণ, হলদে ধূসর। পাতা দ্বিপক্ষল, পত্রগুলো খুব সরু ও ছোট। প্রতিটি পাতায় ৫০ থেকে ১০০টি পত্রক থাকে। সন্ধ্যে হলেই পাতাগুলো ভাঁজ হয়ে যায়, সকালে আবার খুলে যায়। শীতের শেষে পাতা সব ঝরে যায়, বসন্ত এলে নতুন পাতা গজাতে শুরু করে।
চৈত্র-বৈশাখে কোমল সবুজ কচি পাতা বিশেষ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। বর্ষার শেষে গাছে ফুল ফোটে। মঞ্জরি ও ফুল খুব ছোট, সাদা ও ছাতার মতো গোছা ধরা। ফুল ফুটলেও তা দেখার সুযোগ হয় না গাছের অধিক উচ্চতার কারণে। ফল শিমের মতো চ্যাপ্টা, হালকা বাদামি, পাতলা ও বাতাসে ভেসে দূরে যায়। বীজ থেকে চারা হয়।
ঢাকা শহরে গগন শিরীষ গাছের কোনও অভাব নেই। রমনা, সোহরাওয়ার্দী, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মিরপুর, ধানমন্ডিতে আবাহনী মাঠের কাছে, শেরে বাংলা নগর প্রভৃতি স্থানে গগন শিরীষ গাছ দেখা যায়। বয়স্ক কিছু গগন শিরীষ গাছ আছে রমনা পার্কের ভেতরে, বিশেষ করে শিশু প্রাঙ্গণে।
প্রায় সত্তর-আশি বছর বয়সী একটি গগন শিরীষ গাছ আছে ধানমন্ডি লেকের পাড়ের রাস্তার পাশে। লেকের ওপর থেকে ডিঙ্গি রেস্তোরাঁর মাথার উপর দিয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঠা গাছটিকে ভোরের আলোয় চমৎকার দেখায়।
দুর্লভ চন্দন বৃক্ষ
প্রাচীনকালে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম থেকে রেহাই পেতে কেউ কেউ গায়ে চন্দন লেপন করতেন। শ্বেত চন্দন ঘষার সময় তার সঙ্গে একটু হলুদবাটা ও কর্পূর মিশিয়ে তা গায়ে মাখলে ঘামাচি মরে যায়। বিয়ের সময় গায়ে হলুদের সঙ্গে ঘষা চন্দনও কনের গায়ে লেপা হয়, তাতে লাবণ্য বাড়ে।
শ্বেত চন্দনের কাঠ শক্ত পাথরে সামান্য পানিসহ ঘষলে যে ক্বাথ তৈরি হয় তার রঙ ও সুগন্ধ পূজা-পার্বণ থেকে রূপ লাবণ্য ধরে রাখা, ঔষধ ইত্যাদি নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। মাথা ধরলেও কপালে চন্দন ঘষার সঙ্গে একটু কর্পূর মিশিয়ে লাগালে উপশম হয়। এসব পীড়ন জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দেহে ঘষা চন্দন লেপনের সেসব তথ্য কি কবি কাজী নজরুল ইসলামও জানতেন? না হলে তিনি কি করে তাঁর সিন্ধু হিন্দোল কাব্যের ‘মাধবী-প্রলাপ’ কবিতায় লিখলেন:
‘‘ওকি পাইয়া পীড়ন-জ্বালা
তপ্ত উরসে বালা
শ্বেতচন্দন লালা
করিছে লেপন?’’
মাঝে মাঝে কেউ কেউ ফোন করে জানতে চান, ঢাকা শহরের কোথাও চন্দন গাছ আছে কি? বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমা ‘পুষ্প দ্য রাইজ’ দেখার পর লাল চন্দন বা রক্ত চন্দন গাছ দেখার জন্য অনেকের আগ্রহ বেড়েছে। আবার কেউ কেউ রঞ্জনা গাছের ছবি দিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে তাকে রক্ত চন্দন গাছ বলে দাবি করেন। এই আগ্রহের কোনও সন্তোষজনক জবাব দিতে না পেরে অথবা বিভ্রান্তির ছবি দেখে বিব্রত হই।
শত বছর আগেও ঢাকা শহরে রক্ত চন্দনের গাছ ছিল, সে তথ্য পাই একটি বইয়ে। ১৩১৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত যতীন্দ্রমোহন রায় প্রণীত ‘ঢাকার ইতিহাস’ প্রথম খণ্ড গ্রন্থে লিখিত রয়েছে, ‘‘ঢাকা নগরীর উত্তরাংশে, বর্ত্তমান নিউটাউনের সন্নিকটে, মালীবাগ নামক স্থানে সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মন্দির অবস্থিত। এই কালীমূর্ত্তি বিক্রমপুরাধিপতি চাঁদরায়ের প্রতিষ্ঠিত বলিয়া শ্রুত হওয়া যায়। মন্দিরের প্রাঙ্গণমধ্যে একটি রক্তচন্দনবৃক্ষ স্বীয় গৌরবোন্নত মস্তক উত্তোলনপূর্ব্বক দণ্ডায়মান রহিয়াছে। চন্দনবৃক্ষ মন্দিরের সমীপবর্ত্তী অন্য কোথাও আর দৃষ্ট হয় না।’’ বর্তমানে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের মধ্যে সেরূপ কোনও গাছ আছে কি না, একদিন তা দেখতে যাই। যথারীতি সেখানে সে গাছ বর্তমানে নেই।
পঞ্চদশ শতকে রচিত ‘রাজনিঘন্টু’ গ্রন্থে ছয় রকম চন্দনের উল্লেখ পাওয়া যয়, ‘ভাবপ্রকাশ’ গ্রন্থে পাওয়া যায় চার রকম চন্দনের কথা। এগুলো হলো— স্যানটালেসি গোত্রের শ্বেত চন্দন (Santalum album), ফ্যাবেসি গোত্রের রক্ত চন্দন (Pterocarpus santalinus), কুয়াচন্দন/ রঞ্জনা/ রক্তকমল/ রক্তকম্বল (Adenanthera pavonina) ও পীতচন্দন বা কালীয়ক।
শ্বেত চন্দন গাছের ইংরেজি নাম Sandalwood এবং রক্ত চন্দনের ইংরেজি নাম Red Sandalwood। প্রায় ২২০০ বছর আগে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রয়েছে শ্বেতচন্দনের উল্লেখ। এমনকি রামায়ন-মহাভারতেও চন্দনের নাম পাওয়া যায়। সেই চন্দন গাছ ঢাকা শহরে কোথায়?
খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের নার্সারির ভেতরে আছে একটি শ্বেত চন্দনের গাছ, আর একটি শ্বেত চন্দন গাছ আছে বলধা গার্ডেনের সাইকি অংশে। ঢাকায় রক্ত চন্দন গাছের কোনও সন্ধান মেলেনি। দেশের একমাত্র রক্ত চন্দনের গাছটি আছে মধুপুর জাতীয় উদ্যানে, তার বয়স প্রায় ৪০ বছর। কুয়াচন্দন বা রক্তন গাছের দেখা মেলে ঢাকার অনেক স্থানে। রমনা পার্কে তো বটেই, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতেও রয়েছে এ গাছ। তবে এ গাছের সঙ্গে চন্দনের আসলে কোনও সম্পর্ক নেই।
শ্বেত চন্দন গাছ বহুবর্ষী ছোট বৃক্ষ। গাছ ৪-৯ মিটার লম্বা হয়। পাতা পাতলা, ডালে বিপরীতমুখীভাবে সাজানো থাকে। জন্মস্থান দক্ষিণ ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া। হিন্দু ধর্মে চন্দন এক পবিত্র গাছ। শ্বেত চন্দনের কাঠ সুগন্ধি। গাছের বয়স তিন বছর হলে সে গাছে ফুল ফল ধরা শুরু হয়। ফুল লালচে মেরুণ, পাঁচ পাঁপড়িবিশিষ্ট, ছোট। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকার গোল, পাকা ফল কালো। বীজ থেকে চারা হয়। চন্দনের সার কাঠ থেকে সুগন্ধ বের হয়। সেই সার কাঠ তৈরি হতে অনেক বছর সময় লাগে।
রক্ত চন্দন দ্রুত বর্ধনশীল ছোট বৃক্ষ, গাছ আট মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। তরুণ অবস্থায় রক্ত চন্দনের গাছ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই প্রায় পাঁচ মিটার লম্বা হয়ে যায়। বাকল অমসৃণ ও ফাটা ফাটা। পাতা তিনটি পত্রকবিশিষ্ট যৌগিক প্রকৃতির, ডিম্বাকার। খাটো পুষ্পমঞ্জরিতে থোকায় ফুল ফোটে, ফুলের রঙ হলুদ, ফুলের কেন্দ্রস্থল বা পাঁপড়ির গোড়ার দিকটা লাল। ফল শুটি বা শিমের মতো, ৬-৯ সেন্টিমিটার লম্বা, ফলের ভেতরে এক বা দুটি বীজ থাকে। বীজ থেকে চারা হয়। কাঠ হিসেবে রক্ত চন্দন অত্যন্ত মূল্যবান।
নিসর্গী দ্বিজেন শর্মার ‘শ্যামলী নিসর্গ’ বইয়ে চন্দন গাছের কোনও বর্ণনা নেই। তাই সন্দেহ জাগে, ঢাকা শহরে কি তখন চন্দন গাছ ছিল? জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের ভেতরে বছর দশেক আগে কয়েকটা চন্দন বৃক্ষ দেখেছিলাম। সেখানকার প্রাক্তন বোটানিস্ট সামসুল হক বলেছেন, ‘‘জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে শ্বেত চন্দন গাছ আছে।’’ জানা যায়, এক সময় বলধা গার্ডেনে ছোট একটা চন্দনবিথী ছিল, বড় বড় গাছ ছিল, আজ সেটি উধাও।
রঞ্জনা
জেমস টেইলরের ‘অ্য স্কেচ অফ দ্যা টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স অব ঢাকা’ বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৪০ সালে। সে বইয়ে তিনি ঢাকায় রক্ত চন্দন আছে বলে যে গাছটির কথা উল্লেখ করেছেন সেটিকে আমরা অনেকেই ভুল করে রক্ত চন্দন নামে ডাকি। এখন তো মনে হচ্ছে, আমাদের ভুলের গোড়াটা বোধ হয় ওখানেই।
জেমস টেইলর সাহেব যদি রক্ত চন্দন নামের পাশে বন্ধনীতে তার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামটা লিখে রেখে না যেতেন তাহলে আমরা ধরেই নিতাম যে ঢাকায় কোম্পানি আমলে রক্ত চন্দন গাছ ছিল। তাঁর বইয়ে এ গাছটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে অ্যাডিন্যানথেরা প্যাভোনিনা (Adenanthera pavonina) যা রঞ্জনা গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম। এর প্রজাতিগত নামাংশ অ্যাডিনেনথেরা দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত।
অ্যাডিন মানে গ্রন্থি বা গ্লান্ড এবং অ্যানথেরা অর্থ পুরুষকেশর। এ গাছের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পুরুষকেশর ও পর্ণমোচী গ্রন্থির কারণে এরূপ প্রজাতিগত নাম রাখা হয়েছে। প্যাভোনিনা অর্থ ময়ূর। রঞ্জনা গাছের পাতা দেখতে ময়ূরের পালকের মতো বলে এর প্রজাতিগত নামের শেষাংশ রাখা হয়েছে প্যাভোনিনা।
এ বৃক্ষটির ইংরেজি নাম জেমস টেইলর লিখেছেন ‘বাস্টার্ড ফ্লাওয়ার ফেন্স’। এ গাছ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন যে, গাছটি অনেক বড় হয় ও বাঁচে বহু বছর। এর বীজ ও কাঠ ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে ফুসফুসের রক্ত চলাচল ও চোখের অপথালমিয়া রোগের চিকিৎসায় এর কাঠ ও বীজ ব্যবহার করা হয়।
এ গাছ থেকে রঞ্জক বা রঙ পাওয়া যায় বলে এর নাম রঞ্জনা। ‘ডিকশনারি অব প্লান্টস নেমস অব বাংলাদেশ’ বইয়ে এর বাংলা নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রক্তচন্দন, কুয়াচন্দন, কুনচন্দন ও রক্তকম্বল। ইংরেজি নাম রেড উড বা রেড বিড ট্রি (Red bead tree)। রঞ্জনা পাতাঝরা প্রকৃতির বৃক্ষ। গাছ খুব দ্রুত বাড়ে। ৬-১৫ মিটার লম্বা। ডালপালা ছড়ানো সুন্দর ছাতার মতো গড়ন।
ছায়াতরু হিসেবে মানানসই। পাতা দ্বিপক্ষল, একটি পত্রদণ্ডের দু’পাশে আয়ত-ডিম্বাকার ২-৬ জোড়া পত্রক বিপরীতমুখীভাবে সাজানো থাকে। পাতার উপরের পিঠ ফিকে সবুজ, নিচের পিঠ নীলচে সবুজ। বুড়ো হলে পাতার রঙ হয়ে যায় হলুদ। ডালের শীর্ষে লম্বা শীষের মতো ছড়ায় গাদাগাদি করে প্রচুর ফুল ফোটে, পুষ্পমঞ্জরি দেখতে ইঁদুরের লেজের মতো।
ফুল ক্ষুদ্র, হলদে বা হলদে সাদা। ফুল ফোটে গ্রীষ্মকালে, তবে বছরের অন্য সময়েও কিছু ফুল ফুটতে দেখা যায়। একই সময়ে গাছে কুঁড়ি, ফুল, কাচা ও পাকা ফল দেখা যায়। ফুল সুগন্ধযুক্ত। ফুল দেখতে তাঁরার মতো, পাঁচটি পাঁপড়ি ফল দেখতে শিমের মতো, তবে ফলগুলো বক্রভাবে কুঞ্চিত।
এজন্য এর ফলকে বলে কার্লি বিন। কাঁচা ফল সবুজ, পাকলে ফলের খোসা বাদামি হয়ে যায় ও শুকিয়ে আপনা আপনি ফেটে যায় ও বীজ গাছের তলায় ছড়িয়ে পড়ে। বীজ শক্ত, টকটকে লাল, চকচকে ও গোলাকার চাকতির মতো।
এর কাঠ থেকে লাল রঙ পাওয়া যায়। কাঠ খুব শক্ত। কাঠ দিয়ে নৌকা ও আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। জ্বালানি কাঠ হিসেবেও রঞ্জনা কাঠ ব্যবহার করা হয়। ডায়ারিয়া রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বাকল ও কচি পাতার ক্বাথ ব্যবহার করা হয়।
গাছটি ফ্যাবেসি পরিবারের উদ্ভিদ হওয়ায় এর শিকড় বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে তা মাটিতে যোগ করে। ফলের মাটির পুষ্টি বাড়ে। এছাড়া গাছের পাতা ঝরে তলায় পড়ে পচে তা মাটিতে জৈব সার হিসেবে যুক্ত হয়। গাছের পাতা ঝরলেও খুব অল্প সময়ের জন্য নিষ্পত্র অবস্থায় থাকে।
রঞ্জনা গাছ বিভিন্ন উদ্যানে ও বাগানে, পথের ধারে শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে লাগানো হয়। কোনও কোনও দেশে এর কচিপাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। কাঁচা বীজ বিষাক্ত কিন্তু বীজ ভেজে বা রান্না করে খাওয়া যায়। সিঙ্গাপুরে এরূপ খাবারের চল আছে।
প্রাচীনকাল থেকে রঞ্জনার বীজ প্রেমের প্রতীক। এজন্য চীনে এ গাছের ফলকে বলে ‘মিউচুয়াল লাভ বিন’। সে দেশের মেয়েরা এর রক্তলাল বীজ দিয়ে মালা গেঁথে গলায় ও হাতে পড়ে। ঢাকা শহরে অতীতে রঞ্জনা গাছ দুষ্প্রাপ্য হলেও বর্তমানে অঢেল রয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, রমনা উদ্যান, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান প্রভৃতি স্থানে রঞ্জনা গাছ আছে।
অপরূপ চাঁপা বা কানাঙ্গা
শরতের এক স্নিন্ধ সকালে হাজির হলাম ঢাকার ওয়ারীতে বলধা উদ্যানের সিবিলি অংশে। ক্যামেলিয়া হাউসের পাশে একটি মাত্র কানাঙ্গা গাছের দেখা পেলাম। গাছটি এর আগেও দেখেছি ছোট অবস্থায়। এখন সে গাছ বেশ বড় হয়েছে, এখন সে ছোটখাটো বৃক্ষের রূপ ধরেছে।
কানাঙ্গা গাছের কাণ্ডের গোড়া থেকে খানিকটা উপর পর্যন্ত ডালপালা নেই, কিন্তু এরপর কাণ্ড থেকে ডালপালা বেরিয়ে গাছটিকে ঝোপালো করে ফেলেছে। ঘন সবুজ পাতা, পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে অপরূপ ফুল, ফুলগুলোর কাছে গেলে সেগুলোর ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। সে ঘ্রাণ আর ফুলের রূপে শরতের সকালটা অন্যরকম হয়ে উঠল। তবে সময়টা শরতের কোজাগরী জোছনাপ্লাবিত রাত হলেই ভালো হতো। কেননা, রাতের মতো ফুলের তীব্র ঘ্রাণ দিনে পাওয়া যায় না।
গাছে যখন কুঁড়ি আসে তখন এর কোনও ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। এমনকি ফুল ফোটার পর যখন পাঁপড়িগুলো সবুজ থাকে তখনও ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু কিছু দিন পর পাঁপড়িগুলো যখন হলদে হতে শুরু করে তখনই সেসব ফুল সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়াতে শুরু করে। কুঁড়ি থেকে ফুল ফুটে শুকাতে বা ফল গঠনের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় দু’সপ্তাহ সময় লাগে। এ কদিন ফুলগুলো গাছের ডালেই ঝুলতে থাকে। তবে ফোটার পর থেকে ধীরে ধীরে ফুলগুলো ম্লান হতে শুরু করে। প্রায় সারা বছরই এর ফুল ফোটে।
কানাঙ্গা গাছের বাংলা নাম অপরূপ চাঁপা, ইংরেজি নাম কানাঙ্গা ট্রি (Canangva tree), উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম কানাঙ্গা ওডোরাটা (Cananga odorata) ও গোত্র অ্যনোনেসি (Annonaceae)। অর্থাৎ কানাঙ্গা আতা, শরিফা ও কাঁঠালিচাঁপা গোত্রের গাছ, ফুলের চেহারাতে কাঁঠালিচাঁপা ফুলের কিছুটা মিল আছে, আতা শরিফার আদল আছে। তবে ক্যানাংগার ফুল কাঁঠালিচাঁপা ফুলের চেয়ে অনেক বড়, লম্বা ও সুগন্ধী পাঁপড়ি, বৃতি ও পাঁপড়ির রঙের অনেকটা মিল আছে কাঁঠালিচাঁপা ফুলের সঙ্গে।
উদ্ভিদ জগতে সবুজ রঙের ফুল খুব দুর্লভ। কানাঙ্গা ফুলগুলো যখন ফোটে তখন রঙটা সবুজ থাকে, এরপর ফিকে হতে শুরু করে ও শেষে হলুদ হয়ে যায়। ফুলে সুগন্ধ থাকায় বিদেশে এ ফুল থেকে সুগন্ধী দ্রব্য উৎপাদন করা হয়। এজন্য কানাঙ্গার আর এক ইংরেজি নাম ‘পারফিউম ট্রি’। প্রাকৃতিক সুগন্ধী উৎপাদনকারী শিল্পে কানাঙ্গার কদর রয়েছে অনেক বেশি, এজন্য কানাঙ্গা ফুল তাদের কাছ থেকে খেতাব পেয়েছে ‘সুগন্ধের রাণী’।
কানাঙ্গা একটি দ্রুতবর্ধনশীল চিরসবুজ ছোট বৃক্ষ, গাছ বড়জোড় ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। অনুকূল পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে গাছ বছরে কয়েক মিটার লম্বা হতে পারে। পাতা যৌগিক ও পক্ষল, পত্রফলক মসৃণ ও চকচকে, ডিম্বাকার, পাতার আগা সুঁচালো, কিনারা কিছুটা ঢেউ খেলানো।
লম্বা চিকন বোঁটায় ফুল ফোটে, ফুল নিচের দিকে ঝুলে থাকে, ফুলের ছয়টি পাঁপড়ি সরু ও লম্বা, পাঁপড়ি আঁকাবাঁকা বা ঢেউ খেলানো, সবুজাভ রঙ, পাঁপড়িগুলোর মাঝে একটি ছোট্ট চাকতি থাকে, তা থেকে চারাদিকে রশ্মির মতো ছড়িয়ে থাকে, দেখতে তারার মতো দেখায়।
আবার ফুলকে অক্টোপাসের মতো বললেও ভুল হবে না, তবে অক্টোপাসের মতো আটটি বাহু না, ফুলের আছে অক্টোপাসের বাহুর মতো ছয়টি পাঁপড়ি। পাঁপড়িগুলো সুগন্ধী গ্রন্থিতে ভরপুর, এসব গ্রন্থিতে থাকে সুগন্ধি তেল। ফুল শেষে থোকা ধরে ফল হয়। পাকা কালো ফলগুলো পাখিরা খায়। পাখিরাই এ গাছের বংশবৃদ্ধি ঘটায়।
শাল-সেগুনের বনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতে পারে কানাঙ্গা গাছ, কিন্তু এ দেশের কোনও শাল বা সেগুনের বনে কানাঙ্গা গাছকে কখনও দেখিনি। কয়েক বছর আগে কানাঙ্গাকে দেখেছিলাম ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে।
কানাঙ্গার আদিনিবাস ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউ গিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপেও এ গাছ দেখেছি। কি কারণে জানি না, সেসব গাছের ফুলগুলোকে আমাদের দেশের কানাঙ্গা ফুলের চেয়ে অনেক বড় দেখেছি, আর সুগন্ধও বেশি।
বালিনীজদের কাছে শুনেছি, তারা এ ফুল বাসর রাতে নববিবাহিত যুগলের বিছানার উপর ছড়িয়ে দেয়। গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কাঁঠালিচাঁপা ফুলের মতো ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। এবার ঢাকার বৃক্ষমেলায় লতানে স্বভাবের কয়েকটা কানাঙ্গা দেখেছিলাম যেটা ক্যানাংগার ভিন্ন প্রজাতি বলে মনে হয়, সেসব ফুলের ঘ্রাণ বেশি মনে হলো।
এসব গাছ যারা জাতীয় বৃক্ষমেলা থেকে কিনে নিয়ে নিজেদের বাগানে লাগিয়েছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন সে ফুল ও গাছ সম্পর্কে। বাগানের জন্য কানাঙ্গা এক শোভাময়ী ব্যতিক্রমী ফুলের গাছ। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাও কানাঙ্গা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।
প্রকৃতি রক্ষার তিন উপায়
কত মানুষ জীবনে একটা গাছ না লাগিয়েই মরে যায়। কিন্তু একটা সাধারণ বৃক্ষ যে পরিমাণ অক্সিজেন ছাড়ে তাতে চারজন মানুষের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ হয়। গাছের এই ঋণ আমরা কীভাবে শোধ করব? আমাদের হাতে খোলা আছে তিনটি প্রধান রাস্তা— গাছ লাগানো, গাছ না কাটা ও প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছকে সেভাবে বাড়তে দেওয়া।
আদি সাহিত্য মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনও গাছ না লাগিয়ে প্রাণত্যাগ করেন, তার স্থান পুন্নাম নরকে। এক সহস্র বছর শূকর যোনিতে তার জন্ম অনিবার্য। প্রাচীন বিজ্ঞজনদেরও সে লোকায়ত জ্ঞানটুকু ছিল। তাঁরাও নানাভাবে উপদেশ দিয়ে গেছেন তাঁদের উত্তরসূরীদের, আমাদের। আমরা তা জানি না বা জেনেও মানার চেষ্টা করি না। বিপত্তিটা সেখানে।
আজ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে ফলে জীববৈচিত্র্যে ও মানুষের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসছে তা প্রশমনের অন্যতম প্রধান উপায় হলো বেশি বেশি গাছ লাগিয়ে পৃথিবীকে সবুজে শ্যামলে ভরে দেওয়া।
প্রত্যেকে আসুন বছরে অন্তত একটা গাছের চারা লাগাই, একটা গাছ কাটা প্রতিরোধ করি এবং যেখানে যে গাছ জন্মাচ্ছে সেখানেই তাকে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করি। প্রকৃতির প্রতি হস্তক্ষেপ না করাই প্রকৃতিকে রক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়।
লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক।
ইমেইল: [email protected]