স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন রোবেদ আমিন, কিন্তু অফিসে বসতে পারছেন না তিনি। কারণ তাকে ঠেকাতে সক্রিয় বিএনপি সমর্থক চিকিৎসা কর্মকর্তারা।
তাদের বিক্ষোভ-প্রতিবাদে শুধু মহাপরিচালকই নন, আরও অনেক কর্মকর্তাই অফিসে যেতে পারছেন না। কেউ কেউ গেলেও কিছুক্ষণ অফিসে থেকেই চলে আসছেন।
“রেগুলার অফিসে যেতে পারছি না। মাঝে মাঝে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সেরে অল্প সময় থেকে চলে আসি। প্রতিদিন বিক্ষোভ হচ্ছে, এটা নিতে পারছি না,” হতাশ কণ্ঠে সকাল সন্ধ্যাকে বললেন এক কর্মকর্তা।
পরিস্থিতি যে এমন, তার স্বীকারোক্তি মিলেছে স্বাস্থ্য সচিব এম এ আকমল হোসেনের কথায়ও। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দপ্তরে রদবদল হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের কর্মক্ষেত্রে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে আন্দোলনের মধ্যে মধ্য জুলাই থেকে এক রকম স্থবির ছিল দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তা অচল হয়ে পড়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউসূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস গড়ালেও পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় না এলেও এই দল সমর্থক চিকিৎসকরা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদ বাগিয়ে নিয়ে আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে।
তাদের তৎপরতার কারণে অধিদপ্তর অচল হয়ে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অতি শিগগির যদি এই অচলাবস্থা না কাটে, তাহলে দেশ গভীর স্বাস্থ্য সংকটে পড়বে।
যা হচ্ছে অধিদপ্তরে
সরকার পতনের পরপর অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে অনুপস্থিত থাকলেও গত ৮ আগস্ট নতুন সরকার গঠনের পর অফিসমুখো হন তারা।
কিন্তু গত ১১ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের সামনে তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয় বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে। দুদিন পর মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার খুরশীদ আলমের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে অধিদপ্তরের সামনেই অবস্থান ধর্মঘট শুরু করে তারা। মূলত সেদিন থেকেই মহাপরিচালক অধিদপ্তরে আসা বন্ধ করে দেন।
স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে ১৫ আগস্ট অন্য কর্মচারীরাও যোগ দেন আন্দোলনে। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মকর্তাদের সরাতে হবে বিভিন্ন পদ থেকে। সেদিন থেকেই অধিদপ্তর অচল হয়ে পড়ে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৭ আগস্ট মহাপরিচালক খুরশীদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে। পরদিন অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কিন্তু বিক্ষোভের কারণে তিনি এখনও অধিদপ্তরে ঢুকতে পারেননি। তার কক্ষে ঢুকে সিসি ক্যামেরা ভেঙে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যার ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। অধ্যাপক রোবেদ আমিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বসে বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ সারছেন।
২২ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীরকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা নিপসমেও যোগদান করতে পারেননি। তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ‘বৈষম্যবিরোধী নিপসম জনতা’র পক্ষ থেকে ব্যানারও টানানো হয়। পরে সেব্রিনা ফ্লোরাকে ফের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ওএসডি করে ফেরত আনা হয়।
আহমেদুল কবীরকেও জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে বদলি করেছে সরকার।
রোবেদ আমিনের দায়িত্ব পাওয়ার পরদিন ১৯ আগস্ট স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সামনেই তার বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। উপদেষ্টার উপস্থিতিতেই কথা কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি চলে। নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির মধ্যে উপদেষ্টা কথা বলতে চাইলেও বিক্ষোভকারীরা কারও কোনও কথা শোনেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের সভাপতি ডা. ফারুক হোসেন সেদিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, তাদের কেন্দ্রীয় নেতারা বৈঠক করে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সে অনুযায়ী কাজ করবেন তারা।
পরদিন তিনি বলেন, “কোনও দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর, যারা ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত করেছে, তাদের অধিদপ্তরে চাই না, বর্তমান ডিজিকে পদে রেখে আমরা কাজ করতে পারব না।”
ডিজি পদে কাকে চাচ্ছেন-জানতে চাইলে ডা. ফারুক বলেছিলেন, “সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে ড্যাব সিদ্ধান্ত নেবে।”
তবে ৭ সেপ্টেম্বরে ড্যাব জানিয়েছে, তারা বর্তমান ডিজি রোবেদ আমিনের অপসারণ চান।
ড্যাবের মহাসচিব মো. আবদুস সালাম বলেন, স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ‘নীতিভ্রষ্ট’ ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্যাব শাখার সভাপতি ডা. ফারুক জানান, এখন অধিদপ্তরের ভেতরে কিছু কাজ হচ্ছে, তবে আগের মতো না। অধিদপ্তর মোটামুটি কাজহীন অবস্থায় রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের ভেতরে অবস্থান করে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী রোবেদ আমিনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। মহাপরিচালকের পাশাপাশি অতিরিক্ত মহাপরিচালক আহমেদুল কবীরের বিচার চেয়েও স্লোগান দিচ্ছে তারা।
অফিসে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে এক কর্মসূচির উপ ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেভাবে হ্যারাস করা হচ্ছে, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনে যেভাবে অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ মানুষদের অপমান করা হয়েছে, সেখানে তো আমরা কিছুই না।”
ড্যাব চাইছে কী
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অপসারণ চেয়েছে ড্যাব।
মহাপরিচালক পদে কাকে চাইছেন- সেই প্রশ্নে ড্যাব সভাপতি ডা. হারুণ আল রশীদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রোবেদ আমিন ছাড়া কি দেশে আর কোনও লোক নেই? ‘লটস অব মানুষ’ রয়েছে, যারা ক্যাপাবল। আমরা তাকে গ্রহণ করব।”
খুরশীদ আলমকে বদলে রোবেদ আমিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, এখন রোবেদন আমিনকে সরিয়ে আর কাউকে দিলে ড্যাব মানবে, সেই নিশ্চয়তা কি আছে?
এই প্রশ্নে ডা. হারুণ বলেন, “মিনিস্ট্রি আমাদের চাইতে অনেক ভালো জানেন।”
তাহলে সমস্যাটি কেবল রোবেদ আমিনকেন্দ্রিক- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে যারা ছিল, সেরকম কাউকে আনতে হবে। আন্দোলনের সময়ে যারা ওখানে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে) ছিল, তাদেরকেই যদি ফের ক্ষমতায়িত করা হয়, তাহলে তো সর্ষের মধ্যেই ভূত থেকে গেল। তাই বিপক্ষের কাউকে আনতে হবে, যিনি আন্দোলন সমর্থন করেছেন, নয়তো ছাত্র আন্দোলন বিফলে যাবে।”
আন্দোলনের বিপক্ষে থাকলেও যে এই পদের জন্য উপযুক্ত কি না, সেটা দেখবেন না- প্রশ্নে ড্যাব সভাপতি ফের বলেন, “এই আন্দোলনের পক্ষে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ ছিল, তাদের মধ্যে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই উপযুক্ত রয়েছেন, মন্ত্রণালয় এটা জানে এবং তারাই ঠিক করবে এটা।”
সমাধান না হলে বড় সংকটের আশঙ্কা
চিকিৎসকদের পেশাভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) থাকলেও চিকিৎসক মূলত দুটি সংগঠনে বিভক্ত।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) আধিপত্যে কোণঠাসা ছিল ড্যাব। গত দেড় দশকে স্বাস্থ্য প্রশাসনের প্রতিটি পদ স্বাচিপ দখল করে রেখেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এখন ড্যাব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া।
এই দলবাজিতে হতাশ সাধারণ চিকিৎসকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কেবল স্বাচিপ-ড্যাব না, চিকিৎসকরা যেন সরকারি চাকরিতে থেকে রাজনীতি না করতে পারেন, সেই আইন করুক সরকার। যার ইচ্ছে সে রাজনীতি করবেন, কিন্তু তিনি তখন সরকারি চাকরিতে থাকতে পারবেন না।”
“চিকিৎসকরা যেন দলীয় ক্যাডারে পরিণত না হয়, তাদের পরিচয় হোক সরকারি ক্যাডার,” বলেন তিনি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাচিপের কেউ এখন কথা বলতে চাইছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান অচলাবস্থার পেছনে দলীয় রাজনীতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে কারণ হিসাবে দেখালেন বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই মাহবুব।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যারাই দলীয় রাজনীতি করেছে, যারা যখন যে সরকারের আস্থাভাজন থাকেন, তখন আর তার যোগ্যতা বিবেচনা করা হয় না, দলীয় আনুগত্য দেখা হয়।
“যার কারণে নতুন সরকারের সময়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। যারা এতদিন বঞ্চিত মনে করেছে নিজেদের, তারা তো এখন নিজেদের সে জায়গায় দেখতে চাচ্ছে।”
এই অচলাবস্থার দ্রুত অবসান না ঘটলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে এটা স্বাস্থ্যখাত। এখানে কোনও কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের কোনও সুযোগ নেই, একটা সেকেন্ডের জন্যও না। দ্রুত এর সমাধান করা উচিৎ সরকারের।”
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব বলেন, “শীর্ষ পদগুলোতে কারও গায়ে রাজনৈতিক দলের ট্যাগ রয়েছে, এমন মানুষকে সেখানে রাখা ঠিক না।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অচলাবস্থার বিষয়ে কথা বলতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি ধরেননি।