ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই বিদ্যমান আইনকে পাশ কাটিয়ে নতুন সেন্সর বোর্ড গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যা নিয়ে শিল্পী, কলা-কুশলী, নির্মাতাসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা সমালোচনায় সরব হয়েছেন।
সমালোচনাকারীরা বলছেন, যে আইনের আওতায় নতুন সেন্সর বোর্ড গঠন হয়েছে, সেটি ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগই বাতিল করেছিল।
তখন এক প্রজ্ঞাপনে নতুন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩’ চালু করা হয়েছিল। সেই আইনে বোর্ডের নাম ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড’।
কিন্তু নতুন আইন করার পর আওয়ামী লীগ সরকারই গত ১২ মে আগের আইন অনুযায়ীই সেন্সর বোর্ড গঠন করেছিল।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত রবিবার তথ্য মন্ত্রণালয় সেই সেন্সর বোর্ড বাতিল করে আবার আগের মতোই নতুন একটি সেন্সর বোর্ডই গঠন করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে যেমন তথ্য মন্ত্রণালয় আইন পরিবর্তনের বিষয়টিতে নজর দেয়নি; নতুন সরকার আসার পরও তাতে নজর পড়েনি।
সমালোচনা-ক্ষোভ, পদ ছাড়লেন আশফাক নিপুণ
সেন্সর প্রথার বিরোধিতাকারীদের সেন্সর বোর্ডে দেখতে পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই। আবার পুনর্গঠিত বোর্ডের নির্মাতা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া সদস্যের চলচ্চিত্র নির্মাণের পুরোপুরি অভিজ্ঞতা না থাকা নিয়েও শুরু হয়েছে সমালোচনা।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল পুরনো সেন্সরপ্রথা বাতিল করে রেটিং পদ্ধতি চালু করবে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
জনসংস্কৃতি গবেষক ও সাহিত্যিক সুমন রহমান ফেইসবুকে লিখেছেন, “ফিল্ম সেন্সর বোর্ডই যেখানে উঠায়া দেয়ার কথা, সেখানে এটার একটা আবোল-তাবোল নতুন কমিটি করার কী মানে? এরা কি তুলনামূলক দয়ালু সেন্সর করবে? সেন্সর বোর্ড নয়, রেটিং বোর্ড গঠন করেন। ফিল্মে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চাই না আর।”
সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান ফেইসবুকে লিখেছেন, “সেন্সর বোর্ড ও জুরি বোর্ড- দুইটার একটাতেও ঠিকঠাক লোক বসানো হয়নি। ক্লাস শেষে স্যার চলে গেলে আমরা গিয়ে স্যাবের চেয়ারে বসে ভাব নিতাম। স্কুলের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল।”
এফডিসি ঘরানার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতা বদিউল আলম খোকন প্রজ্ঞাপনের ছবি প্রকাশ করে লিখেছেন, “(প্রজ্ঞাপনে) আট থেকে চৌদ্দ নাম্বার পর্যন্ত এরা কারা? এরা সবাই আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাপ্রাপ্ত শর্টফিল্ম ফোরামের ব্যক্তিবর্গ। শর্ট ফিল্ম আর ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতারা যদি চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়ে তিন থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচের এবং আড়াই ঘণ্টা সময়ের চলচ্চিত্রের সেন্সর করা মানে সালাদিয়া হোটেলের বাবুর্চিকে দিয়ে হোটেল সোনারগাঁও আর শেরাটনের খাবারের মান যাচাই-বাছাই করার মতই অবস্থা আর কি। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।”
এসব সমালোচনার মধ্যে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ‘মহানগর’ নির্মাতা আশফাক নিপুণ। রোববার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজ থেকে এক পোস্টের মাধ্যমে নিপুণ জানান, তাকে দেওয়া সদস্যপদটি তিনি বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, “আমি আজীবন চলচ্চিত্রে বা শিল্পে সেন্সর বোর্ড প্রথার বিরুদ্ধে। আমি খুবই সম্মানিত বোধ করেছি মন্ত্রণালয় আমাকে বোর্ডের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেছিলেন। কিন্তু একটা মিস-কমিউনিকেশন হয়ে গেছে। আমি এই বোর্ডের অফিশিয়াল সদস্যপদ গ্রহণ করিনি। বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে এই ব্যাপারে আমার কথা হয়ে গেছে।”
নিপুণ আরও লিখেন, “সেন্সর বোর্ডের বাতিলের পক্ষে আমার অবস্থান সর্বদা চলমান থাকবে । নবগঠিত সেন্সর বোর্ডের বাকি সদস্যরা যারা আমার কলিগ, তাদের সেন্সর বোর্ড বাতিল করে দ্রুত সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড বা গ্রেডিং সিস্টেম চালুর পক্ষে আমার শুভকামনা রইল।”
নিপুণ জানান, তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে তাকে বলা হয়েছে আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই সেন্সর বোর্ড রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে সার্টিফিকেশন বোর্ডে।
সার্টিফিকেশন বোর্ড কী?
২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর এক গেজেটে ১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’ রহিত করে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩’ প্রণয়ন করে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।
বোর্ডের কার্যাবলী সম্পর্কে সাার্টিফিকেশন আইনে বলা হয়েছে, “এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, বোর্ডের কার্যাবলী হবে- চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেশন প্রদানের লক্ষ্যে আবেদন গ্রহণ। চলচ্চিত্রের শ্রেণিবিন্যাস ও মূল্যায়ন প্রতীকসহ সার্টিফিকেশন প্রদান। চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেশন সাময়িক স্থগিত বা বাতিলকরণ। চলচ্চিত্রের প্রচার সামগ্রীর অনুমোদন প্রদান। যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেশন প্রদান। চলচ্চিত্র আমদানি ও রপ্তানির অনুমোদন ও সার্টিফিকেশন প্রদান। সরকার কর্তৃক, সময় সময়, অর্পিত অন্য কোনো কার্য সম্পাদন।”
বোর্ড পুনর্গঠনে আইনের ব্যত্যয় কীভাবে?
মূলত গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়েই ১৯৬৩ ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্ম অ্যাক্ট’ বাতিল হয়ে যায়। তবু, সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের আগ পর্যন্ত চলমান সেন্সরবোর্ড দায়িত্ব পালন করার কথাও লেখা আছে গেজেটে।
গেজেটে প্রকাশিত বোর্ড গঠনের আইনে বলা হয়েছে, “একজন চেয়ারম্যান এবং অনধিক ১৪ জন সদস্য নিয়ে বোর্ড গঠিত হবে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন। বোর্ডের মেয়াদ হবে এক বছর। তবে পরবর্তী বোর্ড কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিদ্যমান বোর্ড কার্যক্রম চলমান রাখবে। বোর্ডের কার্যপদ্ধতি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।”
বিধি অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২৮ মার্চ গঠিত সেন্সরবোর্ডর মেয়াদের মধ্যেই বা শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের কথা ছিল। কিন্তু আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠন না করে একের পর এক সেন্সরবোর্ড পুনর্গঠন করছে তথ্য মন্ত্রণালয়।
আইনটি প্রথম পাশ কাটানো হয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। চলতি বছরের ১২ মে মাসে সরকার কর্তৃক বিলুপ্ত ১৯৬৩ ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্ম অ্যাক্ট’- এর আওতায় পুনরায় সেন্সর বোর্ড গঠন করা হয়। একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে অন্তর্বতীকালীন সরকারও।
চলচ্চিত্র সংগঠক, গবেষক ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন তার ফেইসবুক পোস্টে প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেন, “তাহলে কি চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩ বাতিল করে পুনরায় ফিল্ম সেন্সর আইন পুনর্বহাল করা হয়েছে? কিন্তু তাও তো হতে পারে না আইনত। কারণ, সেটা করলেও করতে হবে জাতীয় সংসদে। আর এখন তো সংসদ নেই। সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। তাহলে? কীভাবে কী হচ্ছে?”
এ প্রসঙ্গে জানতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব কাউসার আহমেদকে বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।