বিগত সরকারের সময় জাতীয় আয় ও প্রবৃদ্ধির যেসব সম্ভাব্য হিসাব বা প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেগুলোর বস্তুগত ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল ছিল বলে জানিয়েছেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি এও বলেন, যেসব সরকারি কর্মকর্তা এতদিন এসব হিসাব করেছেন, তারা অসহায় বোধ করতেন বলে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার পরিকল্পনা কমিশনের নাজিয়া-সালমা সম্মেলন কক্ষে সরকারের ২৪ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে উত্তরে এসব তথ্য জানান দেবপ্রিয়।
বৈঠকে সরকারের তথ্য তৈরি, পরিবেশন ও প্রাক্কলন সংশ্লিষ্ট- বিবিএস, বিআইডিএস, এনবিআর, বিডা, বেজা, বিসিক, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির আহ্বানে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের পর সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ের সময় কমিটির সদস্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও সানেমের অধ্যাপক সেলিম রায়হান উপস্থিত ছিলেন।
‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ গত ২৮ আগস্ট গঠনের কথা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। এই কমিটিকে ৯০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
তাদের ধারাবাহিক বৈঠকের একটি মঙ্গলবারও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রিপোর্টে কী কী উঠে এসেছে, তা জানতে চান সাংবাদিকরা। তবে দেবপ্রিয় বলেন, “আমি আপনাদের প্রথম দিন বলেছি না… রিপোর্টে কী থাকছে, বা রিপোর্টে আমরা কীভাবে কী পেলাম, এইটা বলার সময় এখনও আসেনি। আমাদেরও তো মিলিয়ে-টিলিয়ে দেখতে হবে।”
এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, “মোটাদাগে কী প্রব্লেম আইডেন্টিফাই করছেন?”
এ প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, “(বৈঠকে) আমরা মোটাদাগে আইডেন্টিফাই করেছি যে সমস্ত প্রাক্কলনগুলো করা হয়, সে প্রাক্কলনগুলোর বস্তুগত ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। অনেক সময় যারা প্রাক্কলন তৈরি করেছেন, তারা অসহায় বোধ করেছেন, ওই প্রাক্কলন দিতে বাধ্য হয়েছেন।
“(বৈঠকে) এই কথাটা অনেক বড়ভাবে এসেছে। … ওনাদের অসহায়ত্বটা আজকে ওনারা বলেছেন।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) ২৪টি প্রতিষ্ঠান বৈঠকে অংশ নিয়েছে, যাদের সঙ্গে খুব খোলামেলাভাবে আলোচনা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিকালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে মূলত জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির হিসাব কীভাবে হয়েছিল এবং মূল্যস্ফীতির হিসাব কীভাবে হয়—এই দুটো বিষয়কে ‘স্যাম্পল’ হিসেবে নিয়ে গভীরে গিয়ে দেখা হবে বলেও জানান দেবপ্রিয়।
এ সময় অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ‘কোনও সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান উদ্দেশ্য নয়’ জানিয়ে দেবপ্রিয় বলেন, “কোনও সরকার কাজে হস্তক্ষেপ করেছে কি না- এমন বিষয় নিয়ে নয়, বরং আমরা দেখতে চাই এই প্রক্রিয়াটা কীভাবে করা হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া যদি আগে খারাপ থাকে পরবর্তীতে প্রক্রিয়া আরও খারাপ হয়ে গেল কি না, এটা দেখব।
“আমরা দেখছি এখানে ঘটনা বা সমস্যার মাত্রাটা কী বা তার চরিত্রটা- এটা আমরা দেখব।”
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির কাজের পরিধি ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, “আমরা সংস্কার কর্মসূচি দিচ্ছি না। এই মুহূর্তে স্বচ্ছভাবে দেখতে চাই যে ঘটনাটা কী, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। গ্রাউন্ড জিরো বের করতেছি আমরা।”
কাদের নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, “সরকারের ভেতর থেকে যারা তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টি করেন, পরিবেশন করেন, মূল্যায়ন করেন- সেই সমস্ত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করা হয়েছে।”
এ সময় তিনি বৈঠকে বিবিএসসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আলোচনার ধরন উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, “উনাদের কাছে এমন কিছু আছে কি না, যা এতোদিন উনারা প্রকাশ করতে পারেন নাই। আগামী দিনে সঠিকভাবে তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার জন্য কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে, বা কী পরামর্শ থাকতে পারে- সেগুলো সম্বন্ধে আমরা শুনেছি।”
বৈঠকে আগের সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের যে চুক্তি হয়েছে, অভ্যন্তরীণ থেকে অথবা জ্বালানি ক্রয়ের ব্যাপারে হোক অথবা বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে মূল চুক্তিগুলোর দেখার সুযোগ কীভাবে হবে- সেগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, “এখন শ্বেতপত্র লেখার দিকেও আমরা এগুচ্ছি। আমাদের পরিকল্পনার কাজ শেষ হয়ে গেছে, আমরা এখন লেখার দিকে আগাচ্ছি। এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অংশীজনের সাথে আলোচনা করব।
“শ্বেতপত্র লেখার আগে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় তথ্যের জোগান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।”
“শ্বেতপত্র তৈরির আগে আগামী একমাস ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে এবং এসব তথ্যের ভিত্তিতেই শ্বেতপত্র তৈরি করা হবে।”
নাগরিকদের বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে মতামত দিতে যে উম্মুক্ত আহ্বান জানানো হয়েছিল, তাতে অত্যন্ত ভালো সাড়া পাওয়া গেছে বলে জানান দেবপ্রিয়।
তিনি বলেন, এসব বৈঠক থেকে পাওয়া তথ্যগুলো কমিটি নিজেদের ভেতরে পর্যালোচনা করে দেখবে এবং খুব দ্রুত ঢাকার বাইরে একাধিক স্থানে টাউন হল মিটিং করা হবে, যাতে ঢাকার বাইরেও অংশীজনের যে মতামত পাওয়া যায়।
এ সময় এক প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় বলেন, “একজন একটা কিছু বললেই যে সত্য হবে তারও তো কোনও কথা নাই। আমরা ওগুলোকে মিলিয়ে-টিলিয়ে দেখছি।”