লেবাননে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহৃত পেজার (যোগাযোগের যন্ত্র) বিস্ফোরণে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে অন্তত ৯ জন নিহত ও ৩ হাজারের বেশি আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
দেশটির এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা দাবি করেছেন, পেজার বিস্ফোরণের পেছনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত রয়েছে। তাইওয়ানে নির্মিত ৫ হাজার পেজারে গোপনে মোসাদই বিস্ফোরক বসিয়েছিল বলেও তিনি দাবি করেন।
বিবিসিকে এক বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, লেবাননে পেজারগুলোর বিস্ফোরণের মাত্রা দেখে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকটি পেজারে সামরিক গ্রেডের প্রায় ১০ গ্রাম করে বিস্ফোরক ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মোবাইল ও স্যাটেলাইট ফোনের এই যুগে হিজবুল্লাহর মতো সংগঠন কেন পেজারের মতো সেকেলে প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তবে এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জানতে হবে পেজার মূলত কি ও কিভাবে কাজ করে।
পেজার কি
‘পেজার’ বা ‘বীপার’ একটি ছোট আয়তনের বহনযোগ্য যোগাযোগ যন্ত্র। এর বেতার তরঙ্গ প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষুদেবার্তা আদান-প্রদান করা যায়। মোবাইল ফোনের আগে পেজার বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিশেষত চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবস্থাপকদের ক্ষেত্রে পেজার একটি অপরিহার্য যোগাযোগ সরঞ্জাম হিসেবে পরিচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে এখনও বিশ লাখের বেশি মানুষ পেজার ব্যবহার করে।
কীভাবে কাজ করে পেজার
পেজারের কার্যপদ্ধতি বেশ সহজ ও কার্যকর। বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর পর পেজারটি একটি স্বতন্ত্র শব্দ উৎপন্ন করে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করে। এই সঙ্কেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীকে বার্তার উত্তর দিতে নিকটস্থ কোনও পাবলিক ফোন বা ল্যান্ডলাইন ফোন খুঁজতে হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের আবিষ্কারক আলফ্রেড গ্রস ১৯৪৯ সালে প্রথম পেজারের পেটেন্ট করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে মটোরোলা কোম্পানি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পেজার’ শব্দটি নিবন্ধন করে।
মটোরোলা ১৯৬৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে ‘পেজবয় ১’ নামে পেজার বাজারে আনে। শুরুর দিকে এই পেজারে টেলিফোন দিয়ে অডিওবার্তা পাঠানো যেত। অবশ্য আশির দশকে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে পেজারে লিখিত বার্তাও পাঠানো সম্ভব হয়।
প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পেজারেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। নতুন মডেলগুলোতে একটি ছোট পর্দা যুক্ত হয়। এর ফলে ব্যবহারকারীরা সরাসরি ক্ষুদেবার্তা পড়তে পারত।
এএফপির এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের পেজার নির্মাতা কোম্পানি স্পোককে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাপী ৬১ মিলিয়ন পেজার ব্যবহার করা হতো।
নব্বইয়ের দশকে প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের ফলে মোবাইল ফোন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মোবাইল ফোনের বিভিন্ন সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য যেমন ফোন কল করার পাশাপাশি বার্তা আদান-প্রদানের সুযোগ পেজারের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। ফলে পেজারের চাহিদা দ্রুত কমতে থাকে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই জনসাধারণের কাছ থেকে এটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
হিজবুল্লাহ কেন পেজার চালায়
সাম্প্রতিককালে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর উপর একাধিকবার সাইবার হামলা চালানো হয়। এই ঘটনার পরই মূলত জানা যায়, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পেজার ব্যবহার করে সংগঠনটির সদস্যরা।
হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা ইসরায়েলি গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পেজার ব্যবহার করত। এর নিজস্ব ফ্রিকোয়েন্সি থাকায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের তুলনায় এটি অনেক বেশি নিরাপদ। মোবাইল নেটওয়ার্কগুলিতে নিয়মিত বিঘ্ন, সংযোগ সমস্যা বা অনুপ্রবেশের ঝুঁকি থাকে। এটি গোপন যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের কয়েক মাস আগে মোসাদ হিজবুল্লাহর আমদানি করা ৫ হাজারে পেজারে বিস্ফোরক বসিয়েছিল।
লেবাননের এক নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে, পেজারগুলো তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানির। কিন্তু কোম্পানিটি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা এই যন্ত্রগুলো উৎপাদন করে না। তাদের মতে পেজারগুলো বিএসি নামক একটি কোম্পানি তৈরি করেছে। আর তাদের কাছে গোল্ড অ্যাপোলো ব্র্যান্ড ব্যবহারের লাইসেন্স রয়েছে। তবে তারা বিএসি সম্পর্কে বিস্তারিত কোনও তথ্য দেয়নি।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, পেজারসডিরেক্ট।