Beta
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

হিজবুল্লাহর হাজার হাজার পেজারে কীভাবে বিস্ফোরক বসাল ইসরায়েল

মঙ্গলবার লেবাননে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
মঙ্গলবার লেবাননে হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
[publishpress_authors_box]

লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহৃত হাজার হাজার পেজারের (যোগাযোগের যন্ত্র) ভেতরে পেতে রাখা বিস্ফোরক বিস্ফোরণে মঙ্গলবার অন্তত ১১ জন নিহত হয়। আর আহত হয়েছে প্রায় তিন হাজার মানুষ, যাদের মধ্যে অন্তত ২০০ জনের জখম গুরুতর।

লেবাননে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মোজতবা আমানিও একটি পেজার বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন।

হিজবুল্লাহ ইরান সমর্থিত একটি সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন। তাই হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইরানের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ রয়েছে।

হিজবুল্লাহর একজন এমপির ছেলে ও দুজন যোদ্ধাসহ আট বছরের একটি মেয়ের মৃত্যুর খবরও জানা গেছে।

‘পেজার’ বা ‘বিপার’ হলো পকেটে বহনযোগ্য একটি ছোট যোগাযোগের যন্ত্র, যার মাধ্যমে শুধু টেক্সট ম্যাসেজ আদান-প্রদান করা যায়, বা সতর্কতা সংকেত দেওয়া যায়। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যালের মাধ্যমে এটি সংক্ষিপ্ত বার্তা (সাধারণত সংখ্যাসূচক বা আলফানিউমেরিক) গ্রহণ করে।

পেজারে বার্তা আদান-প্রদানের ওপর গোপন নজরদারি করা অনেক কঠিন। ইসরায়েল যেন হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের অবস্থান শনাক্ত করতে না পারে, সে জন্যই যোগাযোগের যন্ত্র হিসেবে সংগঠনটি পেজার ব্যবহার করে।

আল-জাজিরার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নসরুল্লাহ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেলফোনের ব্যবহার কঠোরভাবে সীমিত করেছিলেন। কারণ, সেলফোনে ইসরায়েল নজরদারি করতে পারে। নসরুল্লাহর ওই আদেশের পর হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা যোগাযোগের যন্ত্র পেজার ব্যবহার করতেন।

ইসরায়েল দায়ী, বলছে হিজবুল্লাহ

হিজবুল্লাহর অভিযোগ, তাদের হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরণের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে।

হিজবুল্লাহর কর্মকর্তাদের অভিযোগ, চলতি বছরের শুরুর দিকে হিজবুল্লাহ তাইওয়ানের একটি কোম্পানি থেকে ৫ হাজার পেজার কিনেছিল। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ সেগুলো লেবাননে পৌঁছানোর আগেই গোপনে সেগুলোর ভেতরে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়।

লেবাননের নিরাপত্তা সংস্থার সূত্র জানিয়েছে, পেজারগুলো তাইওয়ানভিত্তিক গোল্ড অ্যাপোলো নামের একটি কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে।

তবে কোম্পানিটি এক বিবৃতিতে বলেছে, লেবাননকে দেওয়া পেজারগুলো তারা তৈরি করেনি। সেগুলো তৈরি করেছে বিএসি নামের ইউরোপীয় একটি কোম্পানি। সেটির তাইপেভিত্তিক গোল্ড অ্যাপোলোর ব্র্যান্ড ব্যবহারের অনুমতি ছিল। তবে পেজারগুলোর নির্মাণ কোম্পানিটি ঠিক কোন দেশের, তা জানানো হয়নি।

গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা হসু চিং-কুয়াং বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, “পণ্যটি (পেজার) আমাদের নয়। সেখানে (পণ্য) আমাদের ব্র্যান্ডের নামটি বসানো হয়েছে শুধু।”

হিজবুল্লাহ পেজারগুলো বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে বদলা নেওয়ার কথা বলেছে। তবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এই বিস্ফোরণের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত মেডিকেল সেন্টারের বাইরে পেজার বিস্ফোরণে আহত এক ব্যক্তিকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়।

কীভাবে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

কয়েকটি সূত্রের বরাতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিকল্পনাটি বেশ কয়েক মাস ধরে করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর উৎপাদন পর্যায়েই পেজারগুলোতে পরিবর্তন এনেছিল বা বিস্ফোরক ঢোকানোর ব্যবস্থা করেছিল মোসাদ।

লেবাননের একটি সিনিয়র নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, মোসাদ পেজারগুলোর ভেতরে একটি করে বোর্ড ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এই বোর্ডে মাত্র কয়েক গ্রাম বিস্ফোরক উপাদান ছিল। এর একটি সাংকেতিক ভাষা গ্রহণের ক্ষমতা ছিল। এটি শনাক্ত করা খুব কঠিন। এমনকি কোনও যন্ত্র বা স্ক্যানার দিয়েও শনাক্ত করা যায় না।

সূত্রটি বলেছে, পেজারগুলোতে সাংকেতিক বার্তা পাঠানোর পর প্রায় ৩ হাজার পেজার বিস্ফোরিত হয়েছিল। ওই বার্তার মাধ্যমেই পেজারগুলোর ভেতরের বিস্ফোরক সক্রিয় করা হয়েছিল।

অন্য একটি নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, পেজারগুলোতে প্রায় তিন গ্রাম পর্যন্ত বিস্ফোরক পেতে রাখা হয়েছিল এবং কয়েক মাস ধরে হিজবুল্লাহর চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন কর্মকর্তার বরাতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে গোপনে অভিযান চালাতে ইসরায়েলই পেজারগুলোর ভেতর বিস্ফোরক পেতে রেখেছিল।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, তাইওয়ানের গোল্ড অ্যাপোলো কোম্পানি থেকেই পেজারগুলো কিনেছিল হিজবুল্লাহ। তবে লেবাননে পৌঁছানোর আগেই সেগুলোতে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয় ইসরায়েল। পেজারগুলোর বেশিরভাগই ছিল কোম্পানির এপি৯২৪ মডেলের। তবে গোল্ড অ্যাপোলোর আরও তিনটি মডেলের পেজারও ওই চালানে ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, প্রতিটি পেজারের ব্যাটারির পাশে এক থেকে দুই আউন্স পরিমাণ বিস্ফোরক রেখে দেওয়া হয়েছিল। দূর থেকে যেন তার বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, তা নিশ্চিত করতে সেখানে একটি সুইচও লাগিয়ে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক যুদ্ধাস্ত্র বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, সম্ভবত ডিভাইসগুলোতে ১০ থেকে ২০ গ্রাম করে সামরিক-গ্রেডের উচ্চ বিস্ফোরক একটি নকল ইলেকট্রনিক উপাদানের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছিল।

কী ঘটেছিল

মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এবং অন্যান্য জায়গায় পেজারগুলোতে একটি বার্তা এসেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, বার্তাটি হিজবুল্লাহর নেতার কাছ থেকে এসেছে। আসলে ওই বার্তা বিস্ফোরকগুলোকে সক্রিয় করে তুলেছিল।

বিস্ফোরণের আগে কয়েক সেকেন্ডের জন্য যন্ত্রগুলোতে যেন সংকেত (বিপ) বেজে ওঠে, সে রকম করে তা ঠিক করা হয়েছিল।

হিজবুল্লাহ পুরো লেবাননে তাদের সদস্যদের কাছে পেজারগুলো বিতরণ করেছিল। কিছু সংখ্যক পেজার ইরান ও সিরিয়ায় হিজবুল্লাহর মিত্রদের কাছেও পৌঁছেছিল। যে পেজারগুলো চালু ছিল এবং বার্তা গ্রহণ করছিল, সেগুলোই ইসরায়েলের হামলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আতশবাজি ও গুলির শব্দের মতো ছোট ছোট বিস্ফোরণের আগে মানুষের পকেট থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।

একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, এক ব্যক্তির ট্রাউজার পকেট থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার পর বিস্ফোরণ ঘটেছে। তিনি তখন একটি দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, প্রাথমিক বিস্ফোরণের পর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিস্ফোরণ চলতে থাকে। এসময় অনেক মানুষ আহত হয়ে লেবাননজুড়ে বিভিন্ন হাসপাতালে আসতে শুরু করে।

যে রেডিও নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে হিজবুল্লাহর পেজারগুলো চলতো ইসরায়েল সম্ভবত সেই নেটওয়ার্ক হ্যাক করে পেজারগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটায়।

তথ্য আদান-প্রদানের যন্ত্র পেজার।

পেজার কীভবে কাজ করে

পেজার ব্যবহারকারীদের কাছে কেন্দ্রীয় অপারেটরের মাধ্যমে টেলিফোনে রিলে করা বার্তা পাঠানো হয়। পেজারগুলোতে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো হয়। প্রতিটি পেজারে আলাদা আলাদা করে বার্তা পাঠানো হয়। এগুলোকে বিপারও বলে।

ধারণা করা হয়, পেজারগুলোতে খুবই সাধারণ প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি হার্ডওয়্যারের উপর নির্ভরতার কারণে সেগুলোর ‍ওপর নজরদারি করা কঠিন।

নব্বইয়ের দশকে মোবাইল ফোন জনপ্রিয় হওয়ার আগে পেজার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এটি ছিল যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বিশেষ করে চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদ ও ম্যানেজারদের মতো পেশাদাররা এটি ব্যবহার করতেন। এটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতো, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।

রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো হলে, ডিভাইসটি একটি স্বতন্ত্র সংকেত (বিপ) দিয়ে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করে। এরপর ব্যবহারকারীকে বার্তার প্রতিক্রিয়া জানাতে কাছাকাছি থাকা কোনও পাবলিক বা ল্যান্ড ফোন খুঁজে নিতে হয়।

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পেজারেরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। এর নতুন মডেলগুলোতে ছোট স্ক্রিন রয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের ডিভাইসে সরাসরি ছোট বার্তাগুলো দেখতে পারে।

নব্বইয়ের দশকে, ছোট এই ডিভাইসগুলোর জায়গা দখল করে নেয় মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের নানা সুবিধা দ্রুত পেজারের চাহিদা কমিয়ে দেয় এবং ওই দশকের শেষের দিকে পেজার বা বিপার জনসাধারণের হাত থেকে অনেকটাই অদৃশ্য হয়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দেশে স্বাস্থ্য ও জরুরি সেবা খাতে পেজার এখনও ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি ও নেটওয়ার্ক ছাড়াই কাজ করার ক্ষমতার জন্য এগুলো নির্ভরযোগ্য। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে হিজবুল্লাহর সদস্যরাও পেজার ব্যবহার করে আসছিল।

তথ্যসূত্র : বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত