‘খুফিয়া’ সিনেমাকে কেন্দ্র করে সোশাল মিডিয়ায় আসা বানোয়াট সংবাদ ফটোকার্ডের জের ধরে অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন তোপের মুখে পড়েছেন, যিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পক্ষে দারুণভাবে সরব।এবার তারই পাশে দাঁড়ালেন আরেক অভিনেত্রী এলিনা শাম্মি।
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি নিজেও সোচ্চার ছিলেন। আন্দোলন ঘিরে তার কর্মকাণ্ডের স্ক্রিনশট দেখতে পাওয়া গেছে বহুল আলোচিত বিগত সরকার সমর্থিত তারকাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ ‘আলো আসবেই’-তে। সে প্রসঙ্গটিও টেনেছেন তিনি বাঁধনের সূত্রে।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সাবেক কর্মকর্তা অমর ভূষণের লেখা বই ‘এস্কেপ টু নোহোয়্যার’ থেকে ‘খুফিয়া’ বানানো হয়েছে, যেটি ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়।
অভিনেত্রী বাঁধন এ সিনেমায় বাংলাদেশি এজেন্ট হিনা রহমানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পাশাপাশি এ সিনেমার কেন্দ্রিয় চরিত্রে অভিনয়কারী ভারতীয় নায়িকা টাবুর সঙ্গে সমকামিতার দৃশ্যেও তাকে দেখা গিয়েছে।
সিনেমা মুক্তির প্রায় এক বছরের মাথায় সোশাল মিডিয়ায় ‘দ্য ডেইলি স্টারে’র একটি ভুয়া ফটোকার্ড ভাইরাল হয়েছে। সেখানে লেখা রয়েছে- ‘ভারতী সিনেমায় সমকামী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বাঁধনের গ্রেপ্তার দাবি ইসলামী ঐক্যজোটের।’
সোশাল মিডিয়ায় মুহূর্তের মধ্যে এর পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয় নানা বিতর্ক। সেই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টার এ ফটোকার্ডটিকে ভুয়া বলে নিশ্চিত করে আরেকটি ফটোকার্ড প্রকাশ করে। তাতে তাদের সংশ্লিষ্ট ভেরিফায়েড স্যোসাল মিডিয়া পেইজ ও ওয়েবসাইট যাচাই করতে অনুরোধ করা হয়।
অভিনেত্রী শাম্মি তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেন,
“বাহ! কি অদ্ভুত! যারা ছিলো দেশের বিপক্ষে, যারা ছিলো গণহত্যার পক্ষে তারা বহালতবিয়তে নিজেদের চেহারা প্রদর্শন করছে, অবাধ বিচরণ করছে, একেবারেই লজ্জাহীনের মত। ‘আলো আসবেই’ গ্রুপের মহারথীরা এখন নানান অজুহাতে নিজেদেরকে দুগ্ধপোষ্য শিশু সাব্যস্ত করতে চাইছে, ‘তারা কিছুই জানতো না’ ‘তারা দলের চাপে পড়ে ওখানে ছিলো’, ‘তারা মনে মনে ছাত্রদের পক্ষে ছিলো’, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন পর্যন্ত তারা জাতীর কাছে একবার স্যরি বলেনি, তাদের কোন শাস্তি হয়নি, তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়নি কিন্ত যাদের স্ক্রিনশট নিয়ে ওই আলো আসবে গ্রুপে দেয়া হয়েছিলো, বাংলাদেশের ইতিহাসে যদি ৫ ই আগষ্ট না আসতো তাহলে তাদের পরিনতি কী হত, কেউ কি ভেবে দেখবেন?”
অভিনেত্রী, উপস্থাপক ও লেখক আলিনা সিদ্দিক ২০১৪ সালে শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘৭১ এর মা জননী’ সিনেমার মাধ্যমে এলিনা শাম্মি বাংলা চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০২৩ সালে শাকিব খান অভিনীত প্রিয়তমা এবং শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত মুজিব: একটি জাতির রূপকার (২০২৩) চলচ্চিত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পরিচিতি লাভ করেন।
বাঁধনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি তার লেখায় যোগ করেন,
“যারা ছাত্রদের সাথে সাথ রেখে, নিজেদের জীবন বাজি রেখে, উলটা তাদেরই বিচার করার প্ল্যান করছেন? অভিনেত্রী বাঁধনকে নিয়ে যারা এই মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তারা একজন বিপ্লবীর প্রতি সাধারন মানুষকে উস্কে দিচ্ছে যেটা কখনোই কাম্য নয়। এইসব মিথ্যা প্রচারণা অবিলম্বে বন্ধ হোক।”
যদিও এ প্রসঙ্গে কথা বলতে বাঁধন সকাল সন্ধ্যার কাছে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
খুফিয়া এবং বাঁধন
দেশের যে কোনও সংকটে কিংবা দুর্যোগেই বরাবরই সরব ছিলেন অভিনেত্রী বাঁধন। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়, তখন হত্যাকাণ্ডের সমালোচনায় ঝুঁকি নিয়েই অন্যান্য সহশিল্পীদের সঙ্গে রাজপথে নামেন তিনি।
২০০৬ সালে লাক্স তারকা বাঁধনের উত্থান ছোটপর্দার মধ্য দিয়ে হলেও অভিনেত্রী হিসেবে তার নতুন জন্ম হয় ২০২১ সালে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ পরিচালিত রেহানা মরিয়ম নূর- চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে।
৭৪তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের ‘আন সার্টেন রিগার্ড’ বিভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে রেহানা মরিয়ম নূর- এ প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বাঁধন পৌঁছে যান নতুন উচ্চতায়।
তিনি ‘সেরা অভিনেত্রী’ বিভাগে ১৪তম এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডস (এপিএসএ) এবং নিউ ট্যালেন্ট বিভাগে হংকং এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল পুরস্কার জিতেন।
দেশের বড়পর্দায়ও ছবিটি দর্শক সাদরে গ্রহণ করে। ছবিটির সাফল্যের পরপরই বলিউড থেকে ডাক আসে তার। বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত ‘খুফিয়া’ চলচ্চিত্রে হিনা রহমান চরিত্রটিকে রূপদানের বাঁধনের আগে ডাক পেয়েছিলেন বাংলাদেশের আরও দুই জনপ্রিয় অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম ও মেহজাবিন চৌধুরী। কিন্তু ওই ‘চরিত্রটি রাজনৈতিক এবং বাংলাদেশকে হেয় করে’ উল্লেখ করে তারা দু’জনই অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
তবে, সবার অলক্ষ্যে চরিত্রটিতে অভিনয়ের জন্য সায় দেন অভিনেত্রী বাঁধন। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর ছবিটির শুটিংয়ে অংশ নেন বাঁধন। চলচ্চিত্রটি তার ঠিক দু’বছর পর ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি মুক্তির পরই প্রশংসা ও সমালোচনায় ভাসতে থাকেন বাঁধন।
ফ্ল্যাশব্যাক: প্রশংসা ও সমালোচনায় বাঁধনের খুফিয়া
ভারতের অন্যতম বিনোদন বিশ্লেষক ওয়েবসাইট ‘ফিল্ম কম্প্যানিয়ন’ ২০২৩ সালে বলিউডের বছরসেরা নারীকেন্দ্রিক চরিত্রে অভিনয় করা পাঁচ অভিনেত্রীর তালিকায় স্থান দেয় বাঁধনের নাম।
রিভিউগুলোতেও প্রশংসা ও সমালোচনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া আসে। হিন্দুস্থান টাইমস এর একটি রিভিউতে লেখা হয়, “বাংলাদেশি তথ্যদাতার ভূমিকায় বাঁধন দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তাকে দেখা দর্শকের জন্য বাড়তি পাওয়া, যদিও তার আবেদনময়ী চরিত্রটি সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষাপট থেকে অনেকটা দূরে।”
এনডিটিভির রিভিউতে ‘খুফিয়া’কে ৫-এর মধ্যে সাড়ে ৩ রেটিং দেওয়া হয়েছে। এতে বাঁধনের চরিত্রটি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “ভারতের স্পাই এজেন্সির জন্য কাজ করা বাংলাদেশি এজেন্ট হিনা রহমানকে ছবির তিন প্রধান নারী চরিত্রের মধ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তবে সেও অন্য দুজনের মতো মুগ্ধকর এবং রহস্যময়ী। তার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি ছবিটিকে একটি প্রেম ও প্রতিশোধের গল্পে পরিণত করে।”
তবে, চলচ্চিত্রটির তীব্র সমালোচনা করেছেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় উপস্থাপক ও টিভি ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার। তিনি লিখেছেন, “প্রথম অভিযোগটি এই ছবিতে যেটা সবচেয়ে আপত্তিকর সেটা হলো অপ্রয়োজনীয়ভাবে মনিটরে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটা শট ব্যবহার করা হয়েছে। এরকম একটা চলচ্চিত্রে তার ছবি ব্যবহারের আগে অনুমতি নিতে হয় কি? আমার পরামর্শ এই অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আর এই ছবির গল্প দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ একটা বেঈমানে ভরা দেশ।”
‘খুফিয়া’ চলচ্চিত্রটিতে বাঁধন কিংবা টাবু ছাড়াও অভিনয় করেছেন আশিষ বিদ্যার্থী, অতুল কুলকার্নি, নবীনিন্দ্রা বহেল, শরাফ ফিগার প্রমুখ।