হৃদয়ের যত্ন হোক সার্বজনীন- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে রবিবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছরই গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালনের কারণ, হৃদরোগে মৃত্যু ক্রমাগত বাড়ছে, থামার নাম নেই।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও প্রতি বছর হৃদরোগে মৃত্যু দেখতে হচ্ছে। এই সংখ্যা নেহাতই কম নয়; বছরে প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার।
বাংলাদেশের মানুষ ঠিক কী কী কারণে মৃত্যুবরণ করে, এ নিয়ে ২০২২ সালে জরিপ শুরু করেছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। জরিপ শেষে এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তারা দেখায়, মোট ১৫টি কারণে দেশের মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার মধ্যে শীর্ষে আছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে মোট মৃত্যুর প্রায় ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয় হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে। সেসঙ্গে অন্যান্য ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর ২১ শতাংশের বেশি হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই।
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, ওবেসিটি বা স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, ধূমপান ও মানসিক চাপকেই দায়ী করছেন। তবে সম্প্রতি বায়ুদূষণের ওপরও দায় দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু আগে একটা বয়সের পর দেখা গেলেও এখন আর বয়সের কোনও সীমা নেই। এমনকি শিশুরাও এখন হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এবং এই সংখ্যা ক্রমশই বাড়তির দিকে।
হার্ট অ্যাটাক কেন হয়
চিকিৎসকরা বলছেন, হার্ট বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ার স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের প্রয়োজন। যখন হার্টে এই রক্ত সরবরাহকারী নালী বন্ধ হয়ে যায় এবং হার্টে রক্ত পৌঁছতে না পারার কারণে হার্টের মাংসপেশিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, তখনই হয় হার্ট অ্যাটাক। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসন।
এই যে দেশে মৃত্যুর ২১ শতাংশের বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘটছে, এই পরিসংখ্যানকে ‘অস্বস্তিকর এবং উদ্বেগজনক’ হিসেবে দেখছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের রোগতত্ত্ব গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক দুটোই রয়েছে। এই দুটোতেই গত কয়েক বছর ধরে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। কোনও বয়স নেই, কোনও শ্রেণি নেই। বয়স, শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এখন এর শিকার।”
জীবনচর্যার পাশাপাশি অনেকগুলো কারণ এর জন্য দায়ী জানিয়ে ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, “স্ট্রেস বা মানসিক চাপ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এখন। সেই সঙ্গে ধূমপান। বায়ুদূষণও সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে।
“বায়ুদূষণ এমন এক বিষয়, সবাই এর কবলে পড়ছে। যে কারণে আগের চেয়ে যেকোনো বয়সের মানুষ বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মৃত্যুও হচ্ছে বেশি।”
হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর তালিকায় শিশুদের যুক্ত হওয়া ‘আশঙ্কাজনক’ জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, “স্কুল-কলেজে মাঠের অভাবে খেলতে না পারা, কায়িক পরিশ্রম না করা, ফাস্ট ফুড এর জন্য দায়ী। সব ধরনের ফাস্ট ফুডে লবণ বেশি থাকে। সঙ্গে রয়েছে শাক-সবজি না খাওয়া। অস্বাস্থ্যকর খাবার ও জীবনচর্যার কারণে শিশুরা স্থূল হয়ে পড়ছে।”
উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে সম্পর্কে ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, “সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা। কোথায় কোন পদক্ষেপ নিয়ে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা যায়, সেগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেওয়া। নয়তো আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।”
গোল্ডেন টাইম কী
হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরের দেড়-দুই ঘণ্টা সময়কে গোল্ডেন টাইম বলেন চিকিৎসকরা। এই সময়ে রোগীকে সেরে তোলা সম্ভব বলে মত তাদের। যদিও তা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও শয্যাসংখ্যার অভাবের দরুণ। তাছাড়া এ বিষয়ে অসচেতন রোগীরাও।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক হারিসুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব রয়েছে, অপ্রতুল রয়েছে শয্যাসংখ্যাও। রোগীরাও সচেতন নয়।
“অথচ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের জন্য প্রথম দেড় থেকে দুই ঘণ্টা হচ্ছে গোল্ডেন টাইম। এই সময়ের মধ্যে যদি চিকিৎসকের কাছে এনে সেবা নেওয়া যায়, তাহলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।”
দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে নারী-পুরুষের হার কেমন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আগে দুজন পুরুষের বিপরীতে একজন নারী রোগী ছিল। এখন সেটা সমান সমান হয়ে গেছে।”
নারী রোগী বাড়ার কারণ হিসেবে পরিবেশ, ধূমপান, দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও মানসিক চাপকে দায়ী করলেন অধ্যাপক হারিসুল হক।