সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সবকিছুর ওপরে; তাই রাস্তা, জলাশয় বা রেল লাইনের ওপর মন্দির, দরগা বা অন্য কোনও ধর্মীয় স্থাপনা থাকলে তা সরাতেই হবে বলে মন্তব্য করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।
আদালতের আরও বক্তব্য, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। তাই জবরদখল করে থাকা কোনও পরিকাঠামো সরাতে ‘বুলডোজার অ্যাকশন’ নেওয়া হলে তা জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবার উপরই সমানভাবে প্রয়োগ করা উচিৎ। ধর্ম দেখে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।
ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকারের ‘বুলডোজার অ্যাকশন’ নিয়ে এক মামলার শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালতের এই বক্তব্য আসে।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথ এই ‘বুলডোজার অ্যাকশন’ চালু করেন। যার বিরুদ্ধেই কোনও গুরুতর অভিযোগ আসত, তার বা তাদের বাড়ি পরদিনই প্রশাসন গিয়ে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসত। ধর্ষণ বা যৌন অপরাধের ক্ষেত্রেও একই ‘দাওয়াই’ ছিল যোগীরাজ্যে। ফলে আদিত্যনাথের নামই হয়ে যায় ‘বুলডোজার বাবা’।
২০১৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই যোগী আদিত্যনাথ বুলডোজারকে সুশাসনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। তারপর বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে থাকেন ‘দাগি আসামিদের’ বাসস্থান, যেগুলো অধিকাংশই বেআইনিভাবে তৈরি।
আইন নিজের হাতে এভাবে তুলে নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমলেও এক শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে তিনি পেতে থাকেন অকুণ্ঠ সমর্থন। ২০২২ সালে যোগী আদিত্যনাথ ফের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং এই বুলডোজার অভিযান অব্যাহত রাখেন।
উত্তর প্রদেশের কুখ্যাত ‘ডন’ বলে পরিচিত মুখতার আনসারি, আতিক মোহাম্মদদের পুলিশি এনকাউন্টারে হত্যা করার আগে তাদের বাড়িও বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, বুলডোজার অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া স্থাপনার ৯০ শতাংশের মালিক বা বসবাসকারীরা ছিলেন মুসলমান।
উত্তরপ্রদেশ থেকে এই বুলডোজার অভিযান ক্রমশ ভারতের বাকি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিজেপিশাসিত গুজরাট, মধ্য প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, আসাম ও রাজস্থানেও চলছে ‘বুলডোজার জাস্টিস’।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, বুলডোজার অভিযানের নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর লাগাতার আক্রমণ চালাচ্ছে গেরুয়া শিবির।
সেই অভিযোগ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আদালতে বুলডোজারের পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করেন কয়েকজন ব্যক্তি।
মঙ্গলবার বুলডোজার অভিযানবিরোধী সেই মামলারই শুনানি হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চে।
মামলায় ভারতের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশ সরকারের হয়ে লড়েন। আদালত তাকে প্রশ্ন করেন, কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলে কি তার বাড়ি বা জমিতে বুলডোজার অ্যাকশন নেওয়া যায়?
জবাবে সলিসিটর জেনারেল বলেন, “না, তা কখনোই নয়। ধর্ষণ কিংবা সন্ত্রাসবাদের মতো অপরাধের ক্ষেত্রেও তা করা যায় না। বুলডোজার অ্যাকশন নেওয়ার ক্ষেত্রে রাতারাতি নোটিস টাঙিয়ে দেওয়াও অনুচিৎ। পুরসভা কর্তৃপক্ষের কাছে বুলডোজার অ্যাকশন নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত আইনি অধিকার রয়েছে। ফলে এই তিন রাজ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে বুলডোজার অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে এবং কী কারণে নেওয়া হয়েছে সেই যুক্তিগুলো আদালতের পর্যালোচনা করে দেখা উচিৎ।”
সলিসিটর বলেন, “বিষয়গুলো পৌর আইনের ওপর নির্ভরশীল।”
আদালত বলে, “পৌর কর্পোরেশন এবং পঞ্চায়েতগুলোর জন্য আলাদা আইন রয়েছে।”
আদালতের পরামর্শ, “একটি অনলাইন পোর্টালও থাকা উচিৎ যাতে লোকে সচেতন হয়, কোনও কিছু একবার ডিজিটাইজ করলে তার রেকর্ড থাকে।”
এরপর সলিসিটর জেনারেল বলেন, তার আশঙ্কা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর আঘাত আনা হচ্ছে অনুমান করে কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিচ্ছে।
তখন আদালত বলে, “আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং আমাদের দিকনির্দেশনা ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের জন্য হবে। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে জবরদখল নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। কোনও ফুটপাথ, রাস্তা, জলাশয় কিংবা রেললাইন এলাকায় বেআইনি পরিকাঠামো থাকলে তা অবশ্যই সরিয়ে ফলতে হবে। গুরুদুয়ারা হোক, মন্দির কিংবা দরগা, তা রাস্তার মাঝখানে থাকলে মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে সরিয়ে নিতে হবে।”
বিচারপতি গাভাই বলেন, “বেআইনি পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে একটি সাধারণ আইন থাকবে, যা জাত-পাত-ধর্ম নির্বিশেষে প্রয়োগ হবে।”
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার জাতিসংঘের র্যাপোর্টিয়ারের পক্ষে আদালতে উপস্থিত হন এবং আবাসনের প্রাপ্যতা নিয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন।
কিন্তু সলিসিটর জেনারেল এতে আপত্তি জানিয়ে বলেন, “আমি জানি তারা কার জন্য, আমরা এটাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করতে চাই না। আমাদের সাংবিধানিক আদালত যথেষ্ট শক্তিশালী এবং আমাদের সরকার অ-প্রতিপক্ষকে সহায়তা করছে। আমাদের এখানে আসার জন্য কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রয়োজন নেই।”
মেহতা বলেছিলেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বুলডোজার অভিযানের সংখ্যা অনেক কম ছিল।
জাবাবে আদালত বলে, “সংখ্যাটি এক-দুজন নয়, সাড়ে ৪ লাখ।”
আদালত বলেছে, এটা স্পষ্ট করে দেওয়া হবে যে, কোনও অপরাধে অভিযুক্ত হওয়া সম্পত্তি ধ্বংসের ভিত্তি হতে পারে না এবং এটি কেবল নাগরিক নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেই করা যেতে পারে।
মামলার চুড়ান্ত রায়দান স্থগিত রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট।
এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বরের শুনানিতেও পৌর কর্তৃপক্ষের বুলডোজার অভিযান নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট।
সেসময় আদালত বলে, “কেউ অভিযুক্ত বা দোষী হলেই তার বাড়ি ভাঙা যায় না। এমন কোনও আইন এ দেশে নেই। বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা উচিৎ। ভাঙলে সেই পদ্ধতিতে ভাঙতে হবে। একান্ত প্রয়োজন হলে কোর্টের আগাম অনুমতি নিতে হবে।”
সেদিন সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা দাবি করেছিলেন, “সরকারি অভিযান নিয়ে মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন ধারণা ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে যে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
মুসলিমদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে, আদালতে এমন অভিযোগের বিরোধিতা করে মেহতা বলেন, “হিন্দুদের ঘরবাড়িও ধ্বংস করা হচ্ছে।”
জবাবে আদালত বলেছিল, “বাইরে কী ধারণা ছড়ানো হচ্ছে তা নিয়ে আদালত প্রভাবিত হবে না। ধর্মীয় পরিচয়ও আদালত দেখবে না। তবে সরকারি কর্মকর্তা তো বিচারপতির ভূমিকা পালন করতে পারেন না। সেটা করা হচ্ছে বলেই এই আদালত বিচলিত।”
এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর দেশের কোনো জায়গায় বুলডোজার দিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস করা স্থগিত করে আদালত। মঙ্গলবার সেই স্থগিতাদেশের মেয়াদ মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
তথ্যসূত্র : এনডিটিভি