চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ পরিবারের ১৩ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের আলোচিত ব্যক্তি পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত।
সোমবার ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পৃথক আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেয়।
এস আলম পরিবারের আরও যাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তারা হলো- সাইফুল আলমের ছেলে আশরাফুল আলম ও আহসানুল আলম, ভাই মোরশেদুল আলম, সহিদুল আলম, রাশেদুল আলম, আবদুস সামাদ, ওসমান গণি ও মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হাসান, আবদুস সামাদের স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, ওসমান গণির স্ত্রী ফারজানা বেগম। এছাড়া মিশকাত আহমেদ নামে আরেকজনের দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
এদিন দুদকের উপপরিচালক মো. নূর ই আলম তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম শুনানি করেন।
এস আলম পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদনে বলা হয়, হাই কোর্ট বিভাগের সুয়োমোটো রুলের নির্দেশনার আলোকে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গত বছরের ৪ আগস্ট একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘এস আলমের আলাদিনের চেরাগ’ শিরোনামে প্রকাশিত সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস ও অন্যান্য দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগটি অনুসন্ধানাধীন রয়েছে।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, সাইফুল আলম ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেকোনো সময় দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে অবস্থান নেবেন। অনুসন্ধানকালে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা না গেলে অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৩ জন ব্যক্তির বিদেশযাত্রা আটকানো প্রয়োজন।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরপরই ব্যাংক খাতে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয় এস আলম গ্রুপ নিয়ে। জোরজবরদস্তি করে পর্ষদের দখল নেওয়া ইসলামী ব্যাংকসহ শরীয়াহভিত্তিক অন্য ব্যাংক থেকে এস আলমসহ এ গ্রুপের প্রতিনিধিদের সরানো হয়।
এক সময়ের দেশের শীর্ষ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে ২০১৭ সালে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় সদ্য বিদায় নেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। এরপর সাড়ে সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেন, জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি- প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ নিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি এস আলম গ্রুপের কর্ণধার এস আলমসহ তার পরিবারের কাউকে।
নাফিজ সরাফাতের দেশত্যাগে
চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদন করেন দুদকের উপপরিচালক মো. মাসুদুর রহমান। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর শুনানি করেন।
তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আবেদনে বলা হয়, চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার বর্ণিত পদের অপব্যবহার করে ও রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে ও কানাডাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া অজ্ঞাত স্থান থেকে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে তিনি স্বপক্ষে বক্তব্য প্রচার করছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের বর্তমান বাস্তবতায় চৌধুরী নাফিজ সারাফাত দেশত্যাগ করতে পারেন। তাই সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিদেশ গমন রহিত করা আবশ্যক।
নাফিজ পুঁজিবাজারের সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কর্ণধার। কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডেরও চেয়ারম্যান তিনি।
ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংকের মালিকানা নাফিজের হাতে আসার পর ২০১৯ সালে এটি নাম বদলে পদ্মা ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে গত জানুয়ারি মাসে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পত থেকে পদত্যাগ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাকেও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
স্ত্রীসহ সাবেক ভূমিমন্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার স্ত্রী রুকমীলা জামানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত সোমবার দুদকের আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে আদেশ দেয়।
দুদকের উপপরিচালক রাম প্রসাদ মন্ডল তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম শুনানি করেন।
আবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে জানা যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করে তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৫০টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২২৮টি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯টিসহ অন্যান্য দেশেও বাড়ি,অ্যাপার্টমেন্টসহ অন্যান্য সম্পদ অর্জন করেছেন।
এছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরী অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে বাংলাদেশেও সম্পদের অধিকারী হয়েছেন বলে রেকর্ডপত্রের আলোকে প্রাথমিকভাবে জানা যায়।
বিশ্বস্ত সূত্রের প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও রুকমীলা জামান দেশত্যাগ করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশে গমন রহিত করা আবশ্যক।