সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ শূন্যের কোঠায় নামে ব্যাংকগুলোর। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার; এরপর ঋণ বিতরণ শুরু হলেও তাতে বড় ধরনের কোনও অগ্রগতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, আগস্ট মাসে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা, যা এর আগের মাস জুলাইয়ে ছিল ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ।
গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ঋণ তো বাড়েইনি উল্টো এ খাতের বিতরণ করা ঋণের স্থিতি এর আগের মাস জুনের তুলনায় শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ কমে যায়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পরিচালিত কোটা সংস্কার আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিলে দফায় দফায় ইন্টারনেট বন্ধ, সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও কারফিউ জারি করায় ঋণ বিতরণ কমে যায়। আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটায় ব্যাংকগুলো আবার ঋণ বিতরণ শুরু করে। তবে সেই ঋণগুলোর বেশিরভাগ ছিল ছোট ও মাঝারি শিল্পের ঋণ। অর্থাৎ ছোট অঙ্কের ঋণ বিতরণ হয় বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির আরেকটি পরিসংখ্যান দিয়ে থাকে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টের তুলনায় চলতি বছরের আগস্টে (এক বছরে) বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে সেই প্রবৃদ্ধিও ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
গত বছরের আগস্টে দেশের ব্যাংকগুলোর বেসরকারি খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ১৪ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবীব সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা স্থবিরতা রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকের ঋণ বিতরণের গতি মন্থর।”
ঋণ বিতরণে গতি আনতে ব্যবসায়ীদের ‘কনফিডেন্স’ বাড়াতে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, “ব্যবসায়ীরা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত জুলাই ও অগাস্টে এক হাজার ৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি (ঋণপত্র) খুলেছে বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এলসি খোলা প্রায় ১৩ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালের জুলাই-অগাস্ট মাসে পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলারের।
বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম সূচক হলো মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জুলাই-আগস্ট দুই মাসে স্থবিরতা ছিল। এখনও সেই স্থবিরতা কাটেনি। গার্মেন্ট আমাদের বড় ক্লায়েন্ট।
“সেখানে শিপমেন্ট বন্ধ ছিল, পণ্য পাঠাতে দেরি হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের এ খাতে ঋণ বিতরণ কমে এসেছে। তাছাড়া উৎপাদন খাতেও বিনিয়োগ আসছে না। সবাই অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হওয়ার।”
আমদানি এলসি খোলা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে ডলার সঙ্কটকে দায়ী করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, দেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডলার সঙ্কট চলছে। ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকায় উঠে এসেছে। তাছাড়া অনেক ধরনের পণ্য আমদানিতে এখন এলসি মার্জিন বাড়িয়ে প্রায় শতভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমদানির আগেই পুরো টাকা জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা অনেক ধরনের পণ্য আমদানির প্রবণতা কমে এসেছে।
চলতি বছরের ৮ মে মাসে ক্রলিং পেগ নামে নতুন একটি পদ্ধতি চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে একদিনে ডলারের দাম ৭ টাকা বেড়ে হয় ১১৭ টাকা। নতুন সরকার আসার পর গত ১৪ আগস্ট সেই দাম বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা।
এদিকে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার খরচও বাড়ছে।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত পাঁচ দফা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ গত ২৫ আগস্ট রেপো রেট বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর প্রভাবে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের খরচ বাড়ছে, চাপে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, এক বছর আগে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পর এখন তা বেড়ে কোনও কোনও ব্যাংকে ১৫-১৬ শতাংশ হয়েছে।
মেট্রোপলিটিন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সুদ যদি আরও বাড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। এটাও ঠিক যে, মূল্যস্ফীতির হার এত বেশি থাকলে ঋণের সুদহার তো বাড়াতেই হবে। তাই বলে কেবল ঋণের সুদহার বাড়িয়েই মূল্যস্ফীতি কমাবে এমন কোনও কথা নাই।”