বকেয়া বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাজধানী ঢাকার মিরপুরের ইউনিফর্ম টেক্সটাইল লিমিটেড গার্মেন্টসের শ্রমিকরা।
পুলিশ জানিয়েছে, সোমবার সকাল ৯টার পরপর ওই পোশাক কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় এসে বিক্ষোভ শুরু করেন। আগামীকাল মঙ্গলবার বেতন পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা রাস্তা ছাড়েন।
সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরের ৯৯ শতাংশ কারখানায় উৎপাদন চলছে।
এদিকে পোশাক শিল্পের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলো।
মিরপুরে বিক্ষোভ
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন কচুক্ষেত এলাকায় ইউনিফর্ম টেক্সটাইল লিমিটেড গার্মেন্টস কারখানার তিন থেকে চারশ শ্রমিক প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ করে রাখে। ফলে মিরপুর-১৪ থেকে কচুক্ষেত পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।
শ্রমিকরা দাবি করেন, ৫ আগস্টের পর দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের তিন মাসের বেতন আটক আছে। এই বকেয়া বেতন পরিশোধ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
তাদের আন্দোলন শুরুর পর আশপাশের গার্মেন্টসগুলো ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় অন্য কারখানার শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন।
ভাষানটেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মোহাম্মদ ফয়সাল জানান, ইউনিফর্ম নামে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট-মিরপুর-১৪ এলাকার রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
তিনি জানান, এ সময় মিরপুর-১৪ থেকে কচুক্ষেত পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এরপরই আশপাশে আরও ছয় থেকে সাতটি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।
পরে ইউনিফর্ম কারখানা কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বকেয়া বেতন দেওয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা সাড়ে ১০টার দিকে অবরোধ তুলে নেন বলে জানান ওসি ফয়সাল।
৫ কারখানা বন্ধ
সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, সাভার ও আশুলিয়ার ৪০৭টি কারখানার মধ্যে বন্ধ আছে তিনটি। এর মধ্যে দুটি কারখানা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা অনুযায়ী বন্ধ আছে।
গাজীপুরের ৮৭১টি কারখানার মধ্যে বন্ধ আছে দুটি। নারায়ণগঞ্জে সব কারখানা চলছে স্বাভাবিক গতিতেই।
১৮ দফা বাস্তবায়নে মালিকদের ইতিবাচক ভূমিকা প্রত্যাশা
৫ আগস্টের পর থেকে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা নিরসনে বিগত সরকারের আমলে ঘোষিত এ খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের বিদ্যমান হাজিরা বোনাসসহ ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে মালিকপক্ষ সম্মত হয়। সচিবালয়ে সরকারের চার উপদেষ্টা, বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের উপস্থিতিতে এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়।
মালিকপক্ষ দাবি মেনে নিলেও কিছু কারখানায় সেগেুলো বাস্তবায়নে কিছুটা গড়িমসি আছে বলে অভিযোগ করেছেন শ্রমিক নেতা মন্টু ঘোষ।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি মন্টু ঘোষ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “১৮ দফার বেশ কিছু দাবি আছে, যা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তেই বাস্তবায়ন করা যায়। এই দাবিগুলো অনেক কারখানাই মেনে নিয়েছে এবং বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু কিছু কারখানায় এখনও এটা বাস্তবায়নে কিছুটা গড়িমসি দেখা যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “মজুরি কাঠামো পুনর্মূল্যায়নসহ কিছু দাবি আছে যেগুলো একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে বাস্তবায়ন হতে হবে। সেসব প্রক্রিয়া পরিচালনায় দ্রুততার পরিচয় রাখতে হবে মালিকপক্ষ এবং সরকারকে।”
তবে শ্রমিকদের ১৮ দফা বাস্তবায়নে মালিকপক্ষ তৎপর বলে দাবি করেছেন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নে কাজ হচ্ছে। আমাদের তরফ থেকে আমরা সর্বোচ্চ করছি। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে আমরা একটি কঠিন অর্থনৈতিক সময় পার করছি। এসময় আমাদের এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। তাহলে আমরা আমাদের শিল্প রক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।”
শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি
১. মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনপূর্বক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ।
২. যেসব কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি তা দ্রুত বাস্তবায়ন।
৩. শ্রম আইন সংশোধন।
৪. কোনও শ্রমিকের চাকরি ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে/চাকরিচ্যুত হলে একটি বেসিকের সমান অর্থ প্রদান করতে হবে। এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্যান্য ধারাসমূহ সংশোধন করতে হবে।
৫. সব বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ।
৬. হাজিরা বোনাস (২২৫ টাকা), টিফিন বিল (৫০ টাকা), নাইট বিল (১০০ টাকা) সব কারখানায় সমান হারে বাড়াতে হবে।
৭. সব কারখানায় প্রভিডেন্ট ফান্ড ব্যবস্থা চালু করা।
৮. বেতনের বিপরীতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ন্যূনতম ১০ শতাংশ করা।
৯. শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু করা।
১০. বিজিএমইএ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করা যাবে না। বায়োমেট্রিক তালিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। (বায়োমেট্রিক হলো আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে কারখানায় প্রবেশাধিকার। আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণ না করলে কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন না কর্মীরা।)
১১. সব হয়রানিমূলক ও রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করা।
১২. ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
১৩. কলকারখানায় বৈষম্যবিহীন নিয়োগ প্রদান (নারী-পুরুষ সমান হারে নিয়োগ)।
১৪. জুলাই বিপ্লবে ‘শহীদ’ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা।
১৫. রানা প্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে তদন্তান্তে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৬. শ্রম আইন অনুযায়ী সব কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা।
১৭. অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা।
১৮. নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ করা।