‘খেলা হবে’ বলে কাকে ডাকলেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী? কোন স্বপ্ন পূরণের কথা বললেন তিনি? তা নিয়ে আলোচনা এখন সোশাল মিডিয়ায়।
জুলাই আন্দোলনে নিহতদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের পর মঙ্গলবার ফেইসবুকে একটি পোস্ট দেন তিনি; সেখানেই ‘খেলা হবে’ বলার পাশাপাশি নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
মাসুদ লিখেছেন- “ট্রাইব্যুনাল ইজ রেডি। এবার আসো খেলা হবে! খুনি হাসিনার বানানো আইনে আর তারই বানানো ট্রাইব্যুনালে হাসিনা আর তার দোসরদের বিচার হবে ইনশাআল্লাহ।
“এই দিনটির দেখার জন্য মহান রবের দরবারে অজস্রবার চোখের পানি ফেলেছি। এখন স্বপ্ন পূরণে এই তো- আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা …”
মাসুদের বাবা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ২০২৩ সালে কারাগারে মারা যান তিনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। তাতে সাঈদীর পাশাপাশি জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমেরও আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছিল। দুজনই কারাগারে মারা যান। এছাড়া ফাঁসিতে ঝুলতে হয় মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদসহ জামায়াতের অপরাপর শীর্ষনেতাদের।
এক যুগ পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন এই আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচারও সেই ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগও জমা পড়েছে।
সেদিকে ইঙ্গিত করেই ফেইসবুকে পোস্টটি দেন মাসুদ সাঈদী। যেখানে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের প্রজ্ঞাপনটিও যুক্ত করে দেন তিনি।
ফেইসবুকে তার সেই পোস্টে আট ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার জন প্রতিক্রিয়া জানায়, শেয়ার করে ৮০২ জন। পোস্টের নিচে মন্তব্য জমা হয় প্রায় ২ হাজারটি।
মন্তব্যের ঘরে অধিকাংশই লিখেছেন- ‘আলহামদুলিল্লাহ’। দুই-একজন আবার ‘খেলা হবে’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। একজন লিখেছেন- ‘খেলা হবে’ এই শব্দটি ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভাষা’।
নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের কথামালায় ছড়িয়ে পড়া ‘খেলা হবে’ পরে দেশ ছাড়িয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গনেও শোর তুলেছিল। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে প্রায়ই ‘খেলা হবে’ কথাটি আসত, তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় হাসি-ঠাট্টাও চলত সমানতালে।
সেই কথাটি এখন নতুন করে আনা মাসুদ সাঈদী নিজেও জামায়াতে ইসলামীতে যুক্ত। সাঈদী যেখানে সংসদ সদস্য ছিলেন, সেই পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলা পরিষদে ২০১৪ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সেবার উপজেলা নির্বাচনে তিনি হারিয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আব্দুল খালেক গাজীকে।
সাঈদী দণ্ডিত হওয়ার পর পিরোজপুর-১ আসনে ২০১৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়েছিলেন তার আরেক ছেলে শামীম সাঈদী।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ওই বছর মাসুদ সাঈদীকে একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। পরে হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পান।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ২০১০ সালে গ্রেপ্তার করা হয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার একটি মামলায়। পরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি করা হয় তাকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ধর্মান্তর করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালে দেওয়া রায়ে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
পরের বছর ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ সেই সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। সেই দণ্ড ভোগের মধ্যে অসুস্থ হয়ে ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনি মারা যান।
সেই বিচারের সময় যিনি ছিলেন সাঈদীর আইনজীবী, সেই তাজুল ইসলামকে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর করেছে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
তিনি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার থেকে এই ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারে আইন উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘জুলাই গণহত্যা’র বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
একাত্তরের গণহত্যার বিচারে শেখ হাসিনার আমলে গঠিত এই আদালতে জুলাইয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় নিহতের ঘটনাগুলোর বিচার নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠেছিল।
তবে সরকার সেই পথে এগিয়ে যাওয়ার ধাপে প্রথমে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন দল পুনর্গঠন করে। এরপর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সোমবার গঠন করে।
ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
ট্রাইব্যুনালের দুই বিচারপতিই সম্প্রতি হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক হিসাবে নিয়োগ পান। এর কয়েকদিন বাদেই ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব দেওয়া হলো তাদের।
মঙ্গলবার তিন বিচারকই ট্রাইব্যুনালে যান। ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও অন্যান্য কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান।
প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল জানিয়েছেন, বুধবার ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে বিচারপতিদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এরপর বৃহস্পতিবার বিচারপতিরা এজলাসে বসবেন। সেদিনই প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে কয়েকটি আবেদন করা হবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের সরকারি অভিযানে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কয়েকশ মানুষ নিহত হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের খসড়া হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৭ শতাধিক। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেড় সহস্রাধিক নিহতের হিসাব করেছে।
এসব হতাহতের ঘটনাগুলোতে গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা হয়েছে। অধিকাংশ মামলায় ক্ষমতা ছেড়ে দেশছাড়া হওয়া শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ পরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান গত মাসেই জানিয়েছিলেন, তারা তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।
জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনে কোন কোন স্থানে গণহত্যা হয়েছে, সেই স্থানগুলো দেখা; কারা আহত-নিহত হয়েছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করা; কারা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করার কাজটি করছে তদন্ত সংস্থা।
তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বিভাগকে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।