বিদায়। শব্দটা খুব কঠিন ও যন্ত্রণার। সাকিব আল হাসানের কাছে এই শব্দের অন্য মানে থাকতে পারে। ‘বিদায়’ মানে তার কাছে এখন অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও আশঙ্কার মিশ্রণে গড়া জটিল এক সময়। তার বিদায়টা আনুষ্ঠানিক রূপ পাবে কিনা কে জানে।
টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছেন সাকিব। দেশের মাটিতে মিরপুর টেস্ট খেলে লাল বলের ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ইচ্ছা তার। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাকিব-নাটকের যবনিকা টানার চূড়ান্ত ঘোষণা আসে মিরপুর টেস্টের দল ঘোষণার মাধ্যমে। সাকিবকে দলে রেখে ঘোষণা করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের স্কোয়াড।
তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা গুমোট পরিস্থিতি মিলিয়ে যায় স্বস্তির হাওয়ায়। কিন্তু ‘শেষ হইয়াও যে হইল না শেষ’।
সবুজ সংকেত পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার বিমান ধরলেও দুবাই এসে আটকে গেছেন সাকিব। যে নিরাপত্তা-শঙ্কার কথা অবসরের ঘোষণার পর থেকে বলে আসছিলেন সাকিব, ওই কারণেই এই অলরাউন্ডারের দেশে ফিরতে ‘মানা’।
ঘটনাপ্রবাহে সাকিবের বিদায়ী টেস্ট যে দিকে এগুচ্ছে তা যেন সিনেমার প্লট। সাসপেন্স, থ্রিলারে ভরপুর।
টেস্ট থেকে অবসর
২৬ সেপ্টেম্বর। কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্ট শুরুর আগে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন সাকিব। আগামী ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টের পর সাদা পোশাক তুলে রাখবেন সাকিব। আর গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই খেলে ফেলেছেন ক্যারিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।
সাকিব সেদিন বলেছিলেন, “ফারুক ভাইয়ের (বিসিবি সভাপতি) সঙ্গে ও নির্বাচকদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যদি সুযোগ থাকে, আমি যদি দেশে যাই, খেলতে পারি, তাহলে মিরপুর টেস্ট হবে আমার জন্য শেষ। সেই কথাটা বোর্ডের সবার সঙ্গে বলা হয়েছে। তারা চেষ্টা করছেন এটাকে কিভাবে সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায়।”
সঙ্গে যোগ করেন, “আমি যেন গিয়ে খেলতে পারি এবং নিরাপদ অনুভব করি। যখন দেশের বাইরে আসার দরকার হবে, দেশের বাইরে আসতেও যেন আমার কোনও সমস্যা না হয়। তারা (বিসিবি) হয়তো আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবে, যেটার ভিত্তিতে আমি দেশে গিয়ে খুব ভালোভাবে খেলে অন্তত টেস্ট ফরম্যাটটা ছাড়তে পারব।”
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই সাকিবের দেশের হয়ে খেলার বিষয়টি ছিল তুমুল আলোচনায়। এর মাঝে হত্যা মামলায় সাকিবের নাম ওঠায় বাংলাদেশে তার ফেরার বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়।
মুখ ফিরিয়ে নেয় বিসিবি
২৬ সেপ্টেম্বরের দিনটিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিবময় বললে ভুল হবে না। সারাদিনই আলোচনায় ছিলেন সাকিব। তার অবসরের ঘোষণা নিয়ে যত না কথা, তার বেশি আলোচনা হয়েছে সাকিবের দেশে ফেরা-না ফেরা নিয়ে। যে আশঙ্কা ক্রিকেট অনুসারীদের মধ্যে তৈরি হয়, সেটি বাস্তবে ধরা দেয় বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদের বক্তব্যে।
ওই ২৬ সেপ্টেম্বরই বিসিবির বোর্ড সভা শেষে ফারুক বলেন, “সাকিবের নিরাপত্তা আমাদের বা বিসিবির হাতে না। নিরাপত্তা সরকার থেকে আসতে হবে। তার নিজের (সাকিব) সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বোর্ড থেকে এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না। ব্যক্তিগত একজনকে নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই আমাদের (বিসিবি)।”
সরকার থেকে যা জানানো হয়
দুইদিন পর অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর সাকিবের ব্যাপারে বক্তব্য আসে সরকার থেকে। অন্তবর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “খেলোয়াড় সাকিবের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আছে। তবে, সাকিব আল হাসানের বিপক্ষে জনমনে তৈরি হওয়া ক্রোধের বিপরীতে নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা চাওয়া অবান্তর।”
তিনি আরও বলেন, “সাকিব আল হাসানের পরিচয় দুটি, এটি মনে রাখতে হবে। তিনি একজন খেলোয়াড়। সে হিসেবে তার যতটা নিরাপত্তা দেওয়া দরকার সেটা দেওয়া হবে। অন্যদিকে তিনি একজন রাজনীতিবিদও। আওয়ামী লীগের হয়ে রাজনীতি করেছেন। মানুষের মধ্যে তো এই দুই পরিচয় নিয়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।”
আসিফ মাহমুদ এটাও বলেছিলেন, “আমার মনে হয়, ওনাকে (সাকিব) ওনার জায়গাটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন, রাজনৈতিক জায়গা থেক।”
কঠোর থেকে নমনীয় অবস্থান
ক্রীড়া উপদেষ্টার বক্তব্যের পর দেশের মাটিতে সাকিবের শেষ টেস্ট খেলার স্বপ্ন অনেকটা ফিকে হয়ে যায়। ৪ অক্টোবর আরব আমিরাতে দেখা যায় ক্রীড়া উপদেষ্টার নরম সুর, “তিনি (সাকিব) এমন একজন খেলোয়াড়, যার দেশের জন্য অনেক অবদান রয়েছে। তিনি যেহেতু বাংলাদেশে নিজের শেষ টেস্ট খেলতে চান, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই সেই সুযোগ তিনি পাক।”
দেশে এলে সাকিবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি ক্রীড়া উপদেষ্টার, “আমাদের একজন খেলোয়াড়কে অবশ্যই আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবো। কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলে, সেটা ভিন্ন বিষয়। সেই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারি না, কারণ সেটা আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমরা সাকিব আল হাসানের নিরাপত্তার কথা এরইমধ্যে বলেছি, সেটা আমরা নিশ্চিত করব।”
সরকারের পর বিসিবি থেকেও আসে স্বস্তির খবর। ৭ অক্টোবর বোর্ড মিটিং শেষে বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ আশার কথা শোনান, “হ্যাঁ, সাকিবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। সাকিবের খুব ভালো সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশ থেকে অবসর নেওয়ার।”
নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে দলে সাকিব
২৯ সেপ্টেম্বর ক্রীড়া উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, সাকিবের তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। সেই ‘নির্দেশনা’ অনুযায়ী ৯ অক্টোবর ছাত্র আন্দোলনে নিজের ভূমিকা নিয়ে মুখ খোলেন সাকিব। ছাত্র আন্দোলনে নীরব থাকা নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাসে দুঃখপ্রকাশ করেন তিনি। সেই সঙ্গে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া নিয়েও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দীর্ঘ এক পোস্টের শুরুতে আন্দোলনে নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি। নিজের নীরব ভূমিকার দায় মাথায় পেতে নিয়ে সাকিব বলেন, “এই সংকটকালীন সময়ে আমার সরব উপস্থিতি না থাকায় আপনারা যারা ব্যথিত হয়েছেন বা কষ্ট পেয়েছেন তাদের অনুভূতির জায়গাটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এভাবে মনঃক্ষুণ্ন হতাম।”
দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাদা পোশাকে শেষ ম্যাচ খেলার আকুতি জানিয়ে সাকিব লিখেছেন, “আমি আপনাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বিদায় নিতে চাই। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর হাতে হাত রাখতে চাই, যাদের হাতের তালি আমার ভালো খেলতে বাধ্য করেছে। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর চোখে চোখ রাখতে চাই, আমার ভালো খেলায় যাদের চোখ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছে। আবার আমার খারাপ খেলায় যাদের চোখ ছলছল করেছে।”
সাকিবের এই পোস্টের পর ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানান, সাকিবের দেশে ফিরতে কোনও বাধা দেখছেন না তিনি। গত ১৩ অক্টোবর ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেন, “দেশে আসা কিংবা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা তো থাকার কথা না। আমি যতটুকু জানি। আর আইনের বিষয়টা আইন মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা করতে পারবে।”
বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সব আশঙ্কার মেঘ কেটে যায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টের দল ঘোষণায়। সাকিবকে নিয়েই দল জানায় বিসিবি। ভারতের শেষ টেস্ট নিয়ে যে ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন সাকিব, সেটি সত্যি হওয়ায় অপেক্ষায় তখন।
শেষে এসে চরম নাটকীয়তা
কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে আনার পর শেষাঙ্কের এক টুইস্টে সবই পণ্ড হওয়ার পথে। দেশেই যে আসতে পারছেন না এই অলরাউন্ডার! নিরাপত্তার স্বার্থে তাকে দেশে আসতে বারণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাতে সাকিবের দেশে আসার কথা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুবাইয়ে এসে আটকে গেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের তিন প্রতিনিধি ও বিসিবি প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী এবং পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছে সাকিবের। সেখানেই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিরাপত্তার কারণেই সাকিবকে আপাতত দেশে না ফেরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছে বিসিবির একটি সূত্র।
ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, বর্তমান অবস্থায় শঙ্কিত বিসিবিও। স্টেডিয়ামের চারদিক প্রকম্পিত হচ্ছে সাকিব বিরোধী স্লোগানে। তারা ‘ফ্যাসিস্ট সাকিবকে’ হুঁশিয়ার করছে ‘নো এন্ট্রি’ বলে। তিনি দেশে পা রাখলেই যে বিপদ বাড়তে পারে, সেটা অনুমান করা যায়।