সাটডোবাটোর ক্রীড়া স্থাপনাগুলো থেকে অল্প দূরত্বে অবস্থান আনফা কমপ্লেক্সের। ললিতপুরের অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (আনফা) একাডেমি, হোস্টেল লাগোয়া ফুটবল মাঠ। এখানেই প্রতিদিন সাত সকালে ছুটে যেতে হয় ঢাকা থেকে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের। সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্দাদের প্রাত্যহিক অনুশীলনের জন্য আনফা কমপ্লেক্স মাঠটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে আয়োজক নেপাল।
হিমালয় কন্যা নেপালের নৈসর্গিক দৃশ্য এমনিতেই অসাধারণ। এর ওপর কাঠমান্ডুর যানজটমুক্ত নিরিবিলি ঝা চকচকে রাস্তা। ঢাকার কোলাহলময় পরিবেশ থেকে বদলে যাওয়া নতুন কন্ডিশনে অনুশীলনে একরকম অভ্যস্তই হয়ে উঠেছেন নারী ফুটবলাররা।
এই নেপালেই সর্বশেষ ২০২২ সালে প্রথমবার সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সেই বাংলাদেশ দলে ছিল ট্রফি জয়ের তীব্র আকাঙ্খা। ছিল হিমালয় ছোঁয়ার স্পৃহা।
এবারও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই নেপালে এসেছে। কিন্তু এবারের দলে কোথায় যেন একটা ছন্দহীনতার ব্যাপার আছে। যে ছন্দের অভাবের কারণ একটা নয়, একাধিক।
টিমের সঙ্গে নেই বাফুফের কোনও কর্মকর্তা
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের দেশের বাইরে যে কোনও ট্যুর মানেই অবধারিতভাবে উঠে আসে আমিরুল ইসলাম বাবুর নাম। এমনও হয়েছে পুরুষ ফুটবল দলের ম্যানেজার হিসেবে দেশের বাইরে ছিলেন মোহামেডানের এই ফুটবল কর্মকর্তা। কিন্তু বয়সভিত্তিক নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হতেই সেই দলের সঙ্গে যোগ দিতে সরাসরি চলে এসেছিলেন ভুটানে। যে কেউ ভাবতেই পারেন এ তো মেয়েদের জন্য ফুটবল অন্তপ্রাণ এক কর্মকর্তা!
অথচ সেই বাবুকেই চেনা গেল এবারের নারী সাফে। বাংলাদেশ দলের চেয়ে যে নিজের চেয়ার ধরে রাখাটাই বড় মনে করলেন। ২৬ অক্টোবরের নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী হয়েছেন তিনি। যে কারণে এবার দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। তার বদলে এবার ম্যানেজারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সহকারী কোচ মাহমুদা আক্তার অনন্যাকে। অথচ ৭ দলের ম্যানেজার্স মিটিংয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশ দলের সহকারী মিডিয়া ম্যানেজার খালিদ মাহমুদ নওমিকে!
বাংলাদেশ দলের টিম হোটেলে যে কোনও সমস্যা হলে অথবা কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে বাবু যেভাবে পুরো বিষয় দেখভাল করতে পারতেন, সেটা নিশ্চয় অনন্যাকে দিয়ে সম্ভব হবে না। শুধু ম্যানেজার পদটি যেন খালি না থাকে, সে জন্যই অনন্যাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাঠের মধ্যে যদি খেলা চলাকালীন সময়ে রেফারি বা ম্যাচ কমিশনারের সঙ্গে দলের ন্যায্য দাবি আদায় নিয়ে কোনও আলোচনা করার প্রয়োজন হয় এর ব্যাপারে অনন্যার চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই অভিজ্ঞতার কারণে বাবু এগিয়ে থাকতেন। কিন্তু সেই সুবিধাটা এবার নিতে পারবে না বাংলাদেশ।
গত সাফের আসরে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ডেলিগেট হিসেবে ছিলেন বাফুফের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম নুরু, দলনেতা হাজী টিপু সুলতান, বরিশালের ফুটবল সংগঠক সৈয়দ রেজাউল করিম রিয়াজ। কিন্তু এবার যাদের কাউকেই দেখা যায়নি নারী দলের সঙ্গে কাঠমান্ডুতে।
পল স্মলির খবরদারি নেই!
নারী ফুটবল দলের উন্নতিতে অবদান রয়েছে পল স্মলির। বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর অনুশীলনে, ম্যাচ চলাকালীন সময়ে এবং টিম হোটেলে মেয়েদের সব সময় একটা শৃঙ্খলার ঘেরাটোপের মধ্যে রাখতেন। এমনকি তাকে ভয়ও পেত সানজিদা, মারিয়ারা। কিন্তু এবার পল স্মলি নেই, যেন অনেকটাই ‘স্বাধীন’ এই মেয়েরা।
ছোটন ছিলেন বাবার মত
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল ও গোলাম রব্বানী ছোটন যেন সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছিল দিনকে দিন। ২০১০ সাল থেকে টানা ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন নারী ফুটবলের কোচ। ছোটনের হাত ধরেই বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল জিতেছে একাধিক আন্তর্জাতিক ট্রফি। শুধু তাই নয়, ছোটন যেন এই মেয়েদের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন। পরিবার আপনজন ছেড়ে আসা মেয়েদের বাবার ভূমিকা নেন তিনি।
কিন্তু গত বছর বাফুফের চাকরি ছেড়ে ছোটন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দলের কোচ হিসেবে যোগ দেন। ছোটনের অভাবটা অনুভব করছেন ফুটবলাররা। কাঠমান্ডুর আনফা কমপ্লেক্স মাঠে অনুশীলনের পর ডিফেন্ডার শামসুন্নাহার সিনিয়র তো বলেই দিলেন, “আমরা এবার ছোটন স্যারকে ভীষণ মিস করছি।” শুধু শামসুন্নাহারই নন, পুরো বাংলাদেশ দলই ডাগ আউটে মিস করবেন ছোটনকে।
ভিনদেশি কোচে ভাষাগত সমস্যা
দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের অধীনে অনুশীলন করে অভ্যস্ত মেয়েরা বর্তমানে বৃটিশ কোচ পিটার বাটলারের কাছে অনুশীলন করছেন। কিন্তু ভাষাগত সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। যে কারণে দলের সঙ্গে থাকা ভিডিও অ্যানালিস্ট মেহেদিকে বারবার বুঝিয়ে দিতে হচ্ছে পিটার কি বলতে চাইছেন।
দলের সবাই কি শতভাগ ফিট?
এবারের দলের সব ফুটবলারকে শতভাগ ফিট বলে মনে হয়নি গত কয়েক দিনের অনুশীলন দেখে। এর ওপর কাঠমান্ডুর ঠান্ডায় কাবু হয়ে গেছে ফুটবলাররা। বেশিরভাগ ফুটবলারদেরই ঠান্ডা ও সর্দি লেগেছে। কাশি হচ্ছে অনেকের। অনুশীলনে এমনও দেখা গেছে সব ফুটবলার এক সঙ্গে কাশতে শুরু করেছেন। ঠান্ডায় ঠিক মতো গলা দিয়ে স্বরও বের হচ্ছে না কৃষ্ণাদের।
উইনিং কম্বিনেশন নেই
একটা চ্যাম্পিয়ন দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উইনিং কম্বিনেশন না ভাঙা। কিন্তু গতবারের চ্যাম্পিয়ন দলের ৯ ফুটবলার নেই এবারের দলে। স্বাভাবিকভাবেই টিম কম্বিনেশন হয়ে গেছে এলোমেলো। দলের ফুটবলারদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবও থাকতে পারে।
আঁখি নেই রক্ষণে
বাংলাদেশ দলের রক্ষণভাগের অন্যতম ভরসা আঁখি খাতুন ফুটবল ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন চীনে। বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় অবদান ছিল আঁখির। যদিও এবার আঁখির জায়গায় কে খেলবেন সেটা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। এই বাংলাদেশ দলের রক্ষণভাগ জমাট ছিল শুধু আঁখির কারণেই। ৫ ম্যাচে বাংলাদেশ গত আসরে প্রতিপক্ষের জালে ২৩ গোল দিলেও মাত্র ১টি গোল হজম করে গতবার। এবং সেটা শুধু নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে। এবারও স্কোরলাইনে ক্লিনশিট রাখাটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাংলাদেশের জন্য।
স্ট্রাইকারে নেই স্বপ্না
বাংলাদেশ দলের গোলরক্ষক কোচ মাসুদ আহমেদ উজ্জ্বল আক্ষেপ ভরে বলছিলেন, ‘যদি সিরাত জাহানা স্বপ্না ফুটবল না খেলে অ্যাথলেট হতেন তাহলে দেশের দ্রুততম মানবী হতে পারতেন।” এটা সত্যি যে, বাংলাদেশ দলের স্ট্রাইকার সিরাত জাহান স্বপ্নার গতির কাছে হার মেনেছিল ভারত, মালদ্বীপসহ অন্য দলের ডিফেন্ডাররা। বাংলাদেশকে সাফ জেতাতে ছিল বড় অবদান রংপুরের নারী ফুটবলারের। অথচ অনেকটা অভিমানে গত বছর ফুটবল থেকে অবসর নেন স্বপ্না। এবারের আসরে স্বপ্নার গতি, মুভমেন্ট নিশ্চয় মিস করবে বাংলাদেশ।
কৃষ্ণা রানীর চোট
পায়ের চোটে দীর্ঘদিন ভুগেছেন দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাইকার কৃষ্ণা রানী সরকার। অথচ তিনি ছিলেন গত সাফে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে কার্যকরী স্ট্রাইকার। টুর্নামেন্টে ফাইনালে করেন জোড়া গোল। সব মিলিয়ে করেছিলেন ৪ গোল। সেই কৃষ্ণা এবার একাদশে ঢুকতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েই রয়েছেন শঙ্কায়। যদিও ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন, কিন্তু ৯০ মিনিট খেলার মতো ফিট নন। এখানেও পিছিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
কন্ডিশন প্রতিকূলে
নেপালে গত সাফের আসর হয়েছিল ৬-১৯ সেপ্টেম্বর। ওই সময় কাঠমান্ডুর আবহাওয়া ছিল তুলমূলক একটু উষ্ণ। কিন্তু এবারের আসর হচ্ছে ১৭-৩১ অক্টোবর। প্রায় দেড় মাস পরে শুরু হওয়ায় কাঠমান্ডুতে স্বাভাবিকভাবেই শীতের প্রকোপ বেড়েছে। তাছাড়া সেবার দিনের বেলায় ম্যাচ হলেও এবার ফ্লাডলাইটে সন্ধ্যায় হচ্ছে ম্যাচ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের লড়াই করতে হবে কন্ডিশনের সঙ্গেও।
তবুও শিরোপায় চোখ
গত বারের চেয়ে এত অমিল, এত গড়মিল-তবুও বাংলাদেশ দল শিরোপায় চোখ রেখেই মাঠে নামবে। এই বাংলাদেশ দলে রয়েছে মোসাম্মৎ সাগরিকা, আফঈদা খন্দকার, ইয়ারজান বেগমের মতো উদীয়মান কিছু ফুটবলার। মানের দিক দিয়ে মাঝমাঠে মনিকা চাকমা এখনও দক্ষিণ এশিয়ার সেরা মিডফিল্ডার। সঙ্গী হিসেবে আছেন মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, ঋতুপর্ণা চাকমা। এছাড়া দেশের সবচেয়ে সফল নারী ফুটবলার, নারী ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের (৩৪টি) অধিকারী গোলমেশিন সাবিন খাতুন তো আছেনই। কে জানে, প্রতিটি ম্যাচে এদের কেউ না কেউ জ্বলে উঠলে সাফের শিরোপা আবারও যেতে পারে ঢাকায়।