শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে প্রথমে ২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। এরপর একই অভিযোগ তুলে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হলো নতুন ১০ জনকে। দু্ই মিলিয়ে এখন রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত এসআইরা রয়েছে আতঙ্কে। এতটা পথ পেরিয়ে আসার পর তাদের চাকরি টিকবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় তারা।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০২৩ সালে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) পদে নিয়োগের জন্য ৮২৩ জনকে চূড়ান্ত করে তাদের পাঠানো হয় সারদার পুলিশ একাডেমিতে। ৪০তম ব্যাচের ক্যাডেট হিসাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে আগামী মাসেই তাদের চাকরিতে যোগদানের কথা ছিল।
কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসআই পদে নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে বিএনপি। আওয়ামী লীগ আমলে দলীয় বিবেচনায় এই নিয়োগ হয়েছে অভিযোগ করে তা বাতিলের দাবি জানায় দলটি।
বিএনপি এই দাবি তোলার পাঁচ দিন পর গত সোমবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ দেখিয়ে এক যোগে ২৫২ জন এসআইকে একযোগে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এক-চতুর্থাংশ চাকরি হারানোর পর অন্যরা যখন সারদায় আতঙ্কের প্রহর গুনছে, সেদিনই তা আরও বাড়িয়ে তোলে আরও ১০ জনকে দেওয়া শোকজ নোটিসে। কারণ আগে যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়, তাদেরও এমন নোটিস দেওয়া হয়েছিল।
কী অভিযোগ
যে ১০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ ক্লাসে বসা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছেন তারা।
নোটিস পাওয়া একজন এসআই নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের ১০ জনকে শোকজ লেটার দেওয়া হয়েছে সোমবার। চাকরি থেকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে।
“শোকজ লেটারে অভিযোগ করা হয়েছে, আমরা নাকি গত ১৮ অক্টোবর ক্লাসরুমে বসা নিয়ে হট্টগোল করেছি। অথচ এমন কিছুই সেদিন ঘটেনি।”
২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নাশতা না খেয়ে হইচই করে মাঠের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টিকে কারণ দেখানো হয়েছিল।
আতঙ্ক ছড়াচ্ছে অন্যদের মধ্যে
সারদায় পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত কয়েকজন এসআইর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে সকাল সন্ধ্যা। তাদের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস পাওয়া ব্যক্তি যেমন রয়েছেন, তেমনি না পাওয়া ব্যক্তিও রয়েছেন। তারা সবাই আতঙ্কে থাকার কথা জানিয়েছেন।
নোটিস পাওয়া একজন বলেন, “আমাদের ১০ জনকে অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত পার্সি প্যারেডে অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের সঙ্গে আরও ৫০ জন আছেন। তাদেরও পার্সি প্যারেড প্রশিক্ষণ থেকে আলাদা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে, তাদেরও কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে শোকজ করা হবে।
“আর এখানে শোকজ খাওয়া মানেই অব্যাহতির তালিকায় চলে যাওয়া। কারণ মঙ্গলবার অব্যাহতি পাওয়া ২৫২ জনের সঙ্গেও এমন ঘটনাই ঘটেছে। তাদেরও শোকজ করার পর অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে তাদেরও পার্সি প্যারেড প্রশিক্ষণ থেকে আলাদা করা হয়েছিল।”
কোনও নোটিস না পেয়েও আতঙ্কে থাকার কারণ তুলে ধরে আরেকজন বলেন, “আমরা গত বছরের ৪ নভেম্বর সারদায় ঢুকেছি। এর পরের দিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রশিক্ষণ। এরপর ১১ মাস ২০ দিন প্রশিক্ষণ করেছি। প্রতিটি দিন ভোর ৪টা থেকে শুরু করে রাত ৯ টা পর্যন্ত অমানুষিক পরিশ্রম করে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আগামী ৪ নভেম্বর আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
“এমন সময়ে এতগুলো সহকর্মীকে একসঙ্গে অব্যাহতি দেওয়া হলো। এখন যারা সারদায় আছেন, তাদের প্রতিটা সেকেন্ড কাটছে আতঙ্কে। শুনছি, অব্যহতি দেওয়ার তালিকা আরও বড় হবে।”
আরেক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, “শুনেছি এরই মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ৫৯ জনের তালিকা বানিয়ে একাডেমিতে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি সবাই বলাবলি করছে। এতে আতঙ্ক আরও বাড়ছে।”
অব্যাহতির সম্ভাব্য তালিকায় থাকা ৩৪ জনের পিএ (পুলিশ একাডেমি) নম্বরও দেন এই প্রশিক্ষণার্থী। পিএ নম্বর হলো একজন প্রশিক্ষণার্থীর পরিচিতিমূলক সংখ্যা।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ
প্রশিক্ষণার্থীরা পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের তালিকা পাঠানো অভিযোগ তুললেও বিষয়টিতে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পুলিশ সদর সপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, এই ধরনের কোনও তালিকা পুলিশ সদর দপ্তরে হয়নি। আর একাডেমির শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টিতে সদর দপ্তরের কোনও হাত নেই।
ইনামুল বলেন, “সারদায় থাকা যেকোনও প্রশিক্ষণার্থীকে শোকজ করার ক্ষমতা শুধু সেখানকার অধ্যক্ষের। এবিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের কোনও ভূমিকা নেই।
“আর ট্রেনিং চলাকালে প্রশিক্ষণার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়। তাই কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটাই স্বাভাবিক।”
১০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানোর বিষয়টি সারদার পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ, অতিরিক্ত আইজিপি মাসুদুর রহমান ভুঞাও নিশ্চিত করলেও তার স্পষ্ট করেননি।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রশিক্ষণার্থীর কোনও কিছু অনিয়মের মধ্যে পড়লে তার কৈফিয়ত তলব করা নিয়মিত ঘটনা। কেউ অপরাধ করলে শাস্তি পাবে সেটাই স্বাভাবিক।”
কিছু প্রশিক্ষণার্থীকে নিয়মিত পার্সিং প্যারেড প্রশিক্ষণ থেকে বিরত রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পার্সিং প্যারেডের জন্য একটি কন্টিনজেন্টে নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্রশিক্ষণার্থী থাকেন। সেজন্য সবারই কন্টিনজেন্টে জায়গা হয় ন। অতিরিক্ত যারা থাকে, তারা ক্লাস করেন। এটা নিয়মিত বিষয়।”
অন্যদের আতঙ্কের কোনও কারণ বলে আশ্বস্ত করে পুলিশ একাডেমির অধ্যক্ষ মাসুদুর বলেন, “শোকজ করার সঙ্গে অব্যাহতির কোনও সম্পর্ক নেই। শোকজ খেলেই অব্যাহতি পাবে, এমন কথা ঠিক নয়।”
কারণ দর্শানো নোটিস যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদেরও অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটা পর্যালোচনার বিষয়। পর্যালোচনা ছাড়া এই বিষয়ে আমি এখন কিছু বলতে পারব না।”