Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

২৬ বছরের স্বপ্ন মুহূর্তেই ধূলিসাৎ

দীপিকা চক্রবর্তী
দীপিকা চক্রবর্তী
[publishpress_authors_box]

পুরো এক বছরের কঠোর পরিশ্রম আর প্রশিক্ষণ শেষে যখন স্বপ্ন বুনছিলেন শরীরে নীল পোশাক, কাঁধে র‌্যাংক ব্যাজ লাগিয়ে দেশের জন্য কাজ করার, ঠিক তখনই আসে অব্যাহতির নোটিস। আচমকা এই খবর বিশ্বাস করতে পারেননি চট্টগ্রামের মেয়ে দীপিকা চক্রবর্তী, ভেবেছিলেন দুঃস্বপ্ন।

রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির ৪০ তম এসআই ক্যাডেট ব্যাচ থেকে অব্যাহতি পাওয়া ২৫২ জনের তালিকায় রয়েছেন দীপিকাও।   

চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষে অন্য বন্ধুরা যখন বেছে নিয়েছে নানা পথ, নানা পেশা। তখন দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে দীপিকা ভোরে উঠে পিটি-প্যারেড করেছেন, অস্ত্র চালনা শিখেছেন। কঠোর পরিশ্রম করেছেন পুলিশের এসআই পদে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে।

প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে অব্যাহতির নোটিস পেয়ে ভেঙে পড়েন তিনি। নিজের সামনে দেখছেন কেবল অন্ধকার।

নিজের ফেইসবুকে লিখেছেন, “২৬ বছরের স্বপ্নকে ২৬ সেকেন্ডে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হলো। সংবাদটা যখন পাই তখন আমি পি এল ছুটিতে, সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল সংবাদটা সত্যি তো! আমার সেন্স সঠিক কাজ করছে তো?  আমার হৃদযন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে তো? এটা কী দুঃস্বপ্ন! কিন্তু না, এটাই ছিলো সত্য এবং নিষ্ঠুর সত্য!”

গত শনিবার দেওয়া দীপিকার এই পোস্টটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে তিনি অনেকটা আত্মপক্ষই সমর্থন করেছেন। লিখেছেন কোনও দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকার কথা, জানিয়েছেন মানুষের জন্য কাজ করার তীব্র ইচ্ছা থেকে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা। কারও সুপারিশে নয়, মেধার ভিত্তিতেই উত্তীর্ণ হওয়ার কথাও লিখেছেন দীপিকা।

ফেইসবুকে ‘Estrellita Dipika’ নামের একটি আইডি ব্যবহার করেন দীপিকা চক্রবর্তী। তার পোস্টটি ছড়িয়ে পড়ার পর কথা হয় সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে।

দীপিকার বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়। বাবা দীলিপ চক্রবর্তী পেশায় সার্ভেয়ার। দুই বোনের মধ্যে বড় দীপিকা ২০১৪ সালে বাঁশখালি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও বাঁশখালি আলাওল ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। শিক্ষাজীবনে মেধাবী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। স্নাতকেও পেয়েছিলেন প্রথম শ্রেণি। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা, যুব রেড ক্রিসেন্টের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্য কাজ করা, রক্তদানসহ নানা নানা কাজে যুক্ত থাকায় সহপাঠীদের মধ্যে আলাদা পরিচিতি ছিল তার।

সকাল সন্ধ্যাকে দীপিকা বলেন, “শিক্ষাজীবনের কোনও পর্যায়েই আমি কখনও কোনও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও আমি কোনও অনৈতিক উপায় অবলম্বন করিনি। কারও সুপারিশ বা অনৈতিকভাবে অর্থ লেনদেনও করিনি। সম্পূর্ণ নিজের মেধায় চাকরি পেয়েছিলাম আমি।”

পুলিশ হিসেবে কাজ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন দীপিকা। ৩৯ তম ক্যাডেট এসআইয়ের লিখিত পরীক্ষাতেও পাস করেছিলেন, পরে মৌখিকে গিয়ে বাদ পড়েন। এরপর ৪০তম ব্যাচে গিয়ে স্বপ্ন পূরণ হয় তার।

তিনি বলেন, “আমাদের গ্রামের প্রথম লেডি সাব-ইন্সপেক্টর হতে চলেছিলাম। কিন্তু পথেই থেমে গেল আমার যুদ্ধ। নিভে গেল সব আশা।”

মঙ্গলবার যখন সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন শোনালেন পরিবারের সদস্যদের ভেঙে পড়ার কথাও।

দীপিকা বলেন, “ যেদিন প্রথম সারদায় পা দিয়েছিলাম সেদিন মনে হয়েছিল আমি যেন স্বপ্নপুরিতে এসেছি। মনে মনে বলেছি ‘আমার যে স্বপ্ন আমাকে ঘুমাতে দেয়নি, অবশেষে আমি তোমাকে পেলাম আমার স্বপ্নপুরী, আমার সারদা’।”

যে অভিযোগে দীপিকাসহ অন্যদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি প্যারেড মাঠে ১ অক্টোবর সকালের নাশতার মেনু নিয়ে হইচই ও বিশৃঙ্খলা করেছেন অব্যাহতিপ্রাপ্তরা।

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দীপিকা বলেন, , “ওই দিন সকালে যখন ব্রেক দেওয়া হয়, তখন সবাই মিলে নাস্তা করতে যাই। অনেকেই ওয়াশ রুমে যায়। আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে নাস্তা গ্রহণ করি এবং এরপর প্যারেড স্থানে যথাযথভাবে ফিরে আসি। এখন এই ঘটনার পর একাডেমি কীভাবে আমাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়ে অভিযুক্ত করল, সে বিষয়ে আমার নিজেরও জানা নেই। সেদিন কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা ধরা পড়েনি আমার চোখে।”

সেদিন নাস্তার মেনুতে ডিম, ছোলা আর শরবত ছিল জানিয়ে দীপিকা বলেন, “ওটা সকালের নাস্তাও ছিল না। ওটাকে পার্সিং প্যারেডের নাস্তা বলে। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে এই নাস্তা দেওয়া হয়।

“কেন এত বড় শাস্তি পেলাম সেটাই বুঝতে পারছি না আমি। এখন আমরা চাই আমাদের ঘটনা পুনঃতদন্ত হোক। আমরা আসলেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের সঙ্গে জড়িত ছিলাম কিনা সেটা যাচাই করা হোক। একই সঙ্গে আমরা চাই ট্রেনিংয়ের যে পর্যায় থেকে আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে আবার সেই পর্যায়েই পুনর্বহাল করা হোক।”

৪০ তম ক্যাডেট এসআই-২০২৩ ব্যাচে শুরুতে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল ৮২৩ জন। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার আমলে প্রশিক্ষণ শুরুর পর ধাপে ধাপে কয়েকজন বাদ পড়েন। সবশেষ ছিলেন ৮০৪ জন।

গত ২২ অক্টোবর তাদের মধ্যে থেকেই দীপিকাসহ ২৫২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। যদিও এরা প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ছিলেন।

দীপিকার স্বপ্নের এমন পরিণতি দেখে স্বজনরাও হতবাক। তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তারা কেউ ভাবতেও পারেনি। কারণ তারা সবাই তো আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে, জানে। এখন সবাই আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলছে ‘তুমি তো অনেক সাহসী। আজ পর্যন্ত সবকিছুতেই লড়াই করেছো। তুমি সামনে এগিয়ে যাও, জানি তুমি পারবে।”

একবছরের প্রশিক্ষণের শেষ পর্যায়ে এসে বাদ পড়ে ফেইসবুকে নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরেছেন তিনি।

সেখানে লিখেছেন, “কথা ছিলো আর মাত্র ১০ দিন পর স্বপ্নের নীল পোশাক গায়ে জড়িয়ে, শোল্ডারে র‍্যাংক ব্যাজ, লেনিয়ার আর বুকে পুলিশের নেমপ্লেট লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করব। যে স্বপ্ন আমি লালন করেছি দীর্ঘ বছর, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কণ্টকাকীর্ণ পথে হেঁটেছি গত ২৬ বছর। লাস্ট এক বছর ব্যয় করেছি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে।

“সারদার মাঠে নিজেকে শীতের সময় ঠান্ডায় বরফের ন্যায় জমিছি, বৃষ্টিতে ভিজেছি, গ্রীষ্মের ৪২/৪৫° তাপমাত্রার রোদে নিজেকে পুড়িয়েছি। গায়ে ১০৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস জ্বর নিয়েও মাঠে প্রতি বেলার দৌড় শেষ করেছি, তবুও মেডিকেল ভর্তি হইনি, মাঠ ছাড়িনি। নরম হাতের তালু শক্ত চামড়ায় পরিনত হয়েছে ট্রেনিংয়ের কঠোরতায়। আর রাইফেল কাঁধে নিতে নিতে রাইফেলকে শরীরেরই একটা অংশ বলে মনে করেছি।”

এক দিনের জন্য ছুটি কাটাননি, যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটিই সফলতার সঙ্গে করে দেখিয়েছেন উল্লেখ করে দীপিকা লিখেছেন, “ঠিক যখন নিজেকে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করে দেশের সেবায় নিয়োজিত হবো, ঠিক তখন এত দিনের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো অব্যাহতিপত্র।”

তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে এমন অভিযোগ করে তিনি পোস্টে আরও লিখেছেন, “আমরা কী এর সুবিচার পাব? রাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ কেন করছে? দেশের বর্তমান নীতি নির্ধারক যারা আছেন তারা এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবারও কী ভেবেছেন যে এতদিন পরে এসে অব্যাহতি দিলে এতগুলো পরিবারের কেমন বেহাল দশা হতে পারে?

“যদিও আনিত অভিযোগটি সত্য নয়, তারপরও কর্তৃপক্ষ চাইলে সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারত। এখানে অনেকেই আছে যাদের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়, অনেকে জব ছেড়ে গিয়েছিল স্বপ্ন পূরণের জন্য, অনেকের চাকরির বয়স শেষ। আসলে আমি কাকে দোষ দেব, সব দোষ হয়ত আমার ভাগ্যের।”

এ অবস্থায় অনেকেই দীপিকাকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সে প্রসঙ্গেও লিখেছেন দীপিকা।

তিনি বলেন, “যে চাকরিটা আমার এখন দরকার সেটা পরে পেয়ে আমার কী হবে? বাংলাদেশের এই আইনি জটিলতা ওভারকাম করার আর্থিক ও মানসিক সক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার কোনোটাই নেই।

“আমার জীবনকে এইভাবে অন্ধকারের দিকে ঠেলে না দিয়ে এর থেকে ভালো হতো যদি ৭.৬২ মিলিমিটার রাইফেল কিংবা এলএমজি বুলেট দিয়ে ব্রাশফায়ার করে বুকটা ঝাঁঝরা করে দিতেন। তাহলে হয়ত এত কষ্ট হতো না। পরিবারের মানুষের অসহায় মুখগুলি দেখতে হতো না।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত