গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। দেশের বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান নানা সমস্যা, সংকট, জটিলতা এবং সেসব সংস্কার করে প্রত্যাশিত সমাধানের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম। সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য বিশিষ্ট আইন গ্রন্থকার, প্রবন্ধকার, কলামিস্ট ও সাবেক বিচারক মঈদুল ইসলামের তিন পর্বের পর্যালোচনার দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ হলো আজ। (বি.স.)
বিচার বিভাগ সংস্কারের খসড়া রূপরেখা-১
(প্রথম পর্বের পর)
আইনজীবীর দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি
আইনজীবী ছাড়া মামলা ঢোকেও না, চলেও না আদালতে। নিজের মামলা নিজে করার সুযোগ থাকলেও আইনজীবী না ধরে কেউ আদালতের পথ মাড়ায় না। অনেক আইনজীবীও নিজের মামলা করতে ধরেন আরেক আইনজীবীকে। দাম্পত্যকলহে স্ত্রী তার বাবার বাড়ি গিয়ে ফিরে না এলে কার কোন ফৌজদারি অপরাধ হয়? বিরহকাতর স্বামীকে আপসের পথ না দেখিয়ে, আদালতে কোন যুক্তিবাণে ‘সিআরপিসি’-র ১০০ ধারায় সার্চ-ওয়ারেন্টের মামলাটা বাধালেন? অচল বলে মামলা খারিজে চিরবিচ্ছেদযন্ত্রনায় স্বামী হলেন আত্মঘাতী (সংবাদভাষ্যমতে)। আপিল-আদালতের দণ্ডিতকে উচ্চ-আদালতে যেতেও বিচার-আদালতের জামিন দিতে নেই বলে তলব পড়ে শুধু জামিনদাতা বিচারকেরই। যুক্তিজালে জামিন ধরা আইনজীবীর যুক্তিটা জানারও নয়! আইনজীবী নির্দায় জীবিকাধিকারে! বিচারের এই ডানায়ও একটু তো ভর দেবার আছে।
মক্কেল এলেই মামলা বানানো কিংবা লড়তে নামা, দেওয়ানি বিরোধে ফৌজদারি লাগানো কি আইনজীবীর পেশা! মক্কেলের গল্প সত্য কিনা, কাগজপত্রের আসল-জাল পরখ করার পয়লা দায় তো আইনজীবীরই। আদালতে সে-সব প্রমাণ করতে পারবেন কিনা, বিপক্ষের জেরায় সাক্ষী টিকবে কিনা, কাগজপত্রের জালিয়াতি ধরা পড়বে কিনা, সব তো তিনিই দেখেন আগে। কোন বিরোধে কী মামলা সে তো মক্কেলের খায়েশমতো হবে না, ঠিক করেন তো আইনজীবীই। চিকিৎসকে চিকিৎসা দেয় রোগ ধরে শাস্ত্রমতে, রোগীর রুচিমতে দিলে কুচিকিৎসায় জীবননাশ।
ফাঁকা বুলি নয় এসব। সত্যিই লেখা আছে ‘Canons of Professional Conduct and Etiquette of Advocates’-এ। নিজের কারণে আদালতে সময় নিতে নয়, বলা আছে নিজে না পারলে বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখতে। হয়রানির মামলা বানাতে নিষেধ আছে। বলা আছে, আইন আর ‘ফ্যাক্টস’ বুঝে নিশ্চিত হয়েই আইনজীবী নিজ দায়িত্বে ঠিক করবেন মামলা করবেন কিনা, লড়বেন কিনা। ‘দায় ছাড়া আয়’, এমন পেশা নয় আইনজীবীর। ‘আইনজীবী’ নামে বাংলাকরণ সম্মানের হয়নি মোটে ‘অ্যাডভোকেট’ সাহেবের। জীবিকার্জনই মুখ্য দেখায় বলে অনেকেই তাদের কৌশলী ভাবেন! আইনি আচরণের খেলাপ করলে পেশাগত অসদাচরণে আইনজীবীর দায়ী হবার কথা বার কাউন্সিলে। কেউ অভিযোগ না করলেও গন্ধ পেলে, ধোঁয়া দেখলেই নিজ গরজে খোঁজ-খবর করার কথা বার কাউন্সিলের। সেই চাবিকাঠি ঘোরে না দুর্বল হাতে।
ইচ্ছেমতো আপিলের অধিকার খাটানো বিচারকারী আদালত ও ন্যায়বিচারের ওপর চড়াও হওয়ার শামিল, অতিবিলম্বের বিচারবঞ্চনার মূল বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি (১৮ ডিসেম্বর ১৮৮৯ থেকে ২৮ মার্চ ১৯১০) ডেভিড জসিয়াহ ব্রিউয়ার। সে-কথা তো মিথ্যে নয় এখনও আমাদের দেশে। আপিল-রিভিশন, মামলা-রিটের দায় পুরোটাই নিতে হবে আইনজীবীকে যিনি ‘মেরিট’ ছাড়া হয়রানির কায়দা করে দাখিল করেন, লড়তে নামেন। আদালতে জরিমানা লাগাতে হবে তার, পেশাগত অসদাচরণের ব্যবস্থা নিতে হবে বার কাউন্সিলে। এইটুকু ব্যবস্থা এখনই করতে পারে সুপ্রিম কোর্ট ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৫৪(২)(সি) ধারা ও দেওয়ানি কার্যবিধির ১২২, ১২৬ ধারার ক্ষমতায় আর হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের ‘রুলস’-এ বিধি জুড়ে। ‘মূল্য সংযোজন’ করে দোকানদার, ‘মূল্য সংযোজন কর’ (VAT) দেয় খরিদ্দার! এই অনাচার বাজারে চলে, চালানো যায় না অন্তত বিচারে। হয়রানির নাহক আপিল-রিভিশন-রিটের, অচল মামলা, ভুল মামলার খেসারত মক্কেল নয়, গুণতে হবে তার আইনজীবীকেই। ঢালাও দোষের ভাগী হতে বাঁচেন নীতিনিষ্ঠ ‘অ্যাডভোকেট’।
একপক্ষে কতজন আইনজীবী
বিশ্বাসের পাল্লায় ওজনদার হলে এক সাক্ষীতেই প্রমাণ হতে পারে, কাজ হয় না ওজনবিহীন শতেক সাক্ষীতেও। এক মামলায় একপক্ষে যোগ্য আইনজীবী দু-একজনই যথেষ্ট। অত্যধিকের হট্টগোলে আইনের যুক্তি নাকি মক্কেলের শক্তি দেখানো হয় বুঝতে গোল বাধে! সে-সব মিটিয়ে সুস্থির হয়ে বসতেই দিন কাবার। একপক্ষেরই বিজ্ঞ সবার লম্বা শুনানিতে বিচার লবেজান। বিত্তশালীর পাল্লায় পড়লে বিপক্ষের আইনজীবী মেলা ভার। এক মামলায় এক মক্কেল কতজন আইনজীবী দিতে পারে, তার পক্ষে এক তারিখে কতজনে শুনাতে পারে তারও একটা সীমা থাকা দরকার। এসব কোন দেশে আছে! পাওয়া যাবে কি সেই দেশে যেখানে আদালতে আর কারাফটকে ধর্ষক-ধর্ষিতার বিয়ে দিয়ে ধর্ষণ মামলা মিটে; যেখানে একজনের মান গেছে বলে মামলা করে অন্যেরা সব জনে জনে যত থানা যত আদালতে।
তদন্তকারীর জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা
বিচারে আসার আগেই বিলম্ব শুরু ফৌজদারিতে। ‘সিআরপিসি’-তে তদন্তের সময়সীমা বাঁধা নেই বলে কি চলবে তদন্তকারীর মর্জিতে। ১৬৭ ধারার (১) উপধারায় চব্বিশ ঘন্টায়, আর (৫) উপধারায় ১২০ দিনে শেষ করার ইশারাটা ‘কাফি’ হবে না ‘আকেলমন্দ’ দু-একজনেরও! দুদক আইনে (২০ক ধারা) ১২০ দিনে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (১৮ ধারা) অপরাধী হাতেনাতে ধরা পড়লে ১৫ দিনে, না পড়লে ৬০ দিনে তদন্তের সময়সীমার স্পষ্ট বিধান আছে। সীমা লঙ্ঘনকারীর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবার দায়িত্ব আছে কর্তৃপক্ষের। এখনকার অনেক আইনেও তাই আছে। সীমা লঙ্ঘনই অলঙ্ঘনীয় হয়ে গেছে। ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না কর্তৃপক্ষকে। দীর্ঘতর তদন্ত শেষ হলে শুরু হয় অধিকতর তদন্ত– ফাঁক-ফোঁকর রেখে দায়সারা, দোষীর বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে নির্দোষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার প্যাঁচ লাগানো কাজে। বখে যাওয়া কর্মীকে অতিশয় অপত্যস্নেহে কর্তৃপক্ষের আগলে রাখার কি আছে! লোকে দুষবে কাকে! সময়মতো শেষ করিয়ে নেওয়া, একবারেই নিখুঁত তদন্ত করিয়ে নেওয়ার কর্তৃত্বটা করতে হবে কর্তৃপক্ষকে নজরদারি, তদারকি দিয়ে। নষ্ট ‘পার্টস’ দুষ্ট গরু সরাতে হবে, সারাতে হবে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে।
সাক্ষীর হাজিরা ও নিরাপত্তা
আসে না বলে সাক্ষীর বদনামে মামলা ঝুলে ফৌজদারিতে। এলেও তো দাবড়ায় আসামি আর দু-পক্ষের আইনজীবী এবং আরও যে পারে। সাক্ষী, তাই খাড়া সর্বদা! বসবার জায়গা নেই তার আদালতের কোনখানে। গাঁটের পয়সা খরচ করে এসে ফিরতে হয় খালি হাতে। এসব দুঃখ ঘুচিয়ে স্বস্তি একটু না দিলে সাক্ষী স্বতঃপ্রবৃত্ত হবে? আদালতে তার বসবার জায়গা দিতে হবে। দিনের লোকসান, যাওয়া-আসার, থাকা-খাওয়ার হিসেব করে খরচা দিতে হবে নগদে। খাত রাখতে হবে সাক্ষী নেওয়া আদালতের হাতে। সমনটা সত্যিই পৌঁছাতে হবে সাক্ষীর কাছে। সে তদারকিটা করতে হবে থানা ও আদালতের কর্তাদের। সাক্ষীর ফিরে গিয়ে নিরাপদে থাকার আস্থাটুকুও জাগাবার আছে।
বিচার বিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ
১৮০ দিনে বিচার শেষ না হলে বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর, পুলিশ কর্মকর্তাকে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের কাছে কারণ জানাতে বলা আছে; আর খতিয়ে দেখে দায়ী ধরে যার যার কর্তৃপক্ষকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে দায়িত্ব দেওয়া আছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে [ধারা ৩১ক]। জানানোই হয় কিনা জানা যায় না ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না বলে। শুধু এই মামলায় নয়, অতিবিলম্বের কারণ জানাতে হবে, বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে ফৌজদারির সব মামলাতেই। তদন্তকারী-আইনজীবী-বিচারক, ধরে দেখাতে হবে দায় কার কতখানি। তদন্ত আর বিচারে তথ্য-প্রযুক্তি, আধুনিক যত প্রযুক্তি সব লাগাতে হবে।
তদারকি-তত্ত্বাবধানে সুপ্রিম কোর্টে পৃথক ব্যবস্থা
বিচারের অতিবিলম্বের সব পাষাণকপাটে তদারকি-তত্ত্বাবধানের চাবিকাঠি ঘোরাতে হবে সবল হাতে। বিচারব্যবস্থার ‘সুপ্রিম অথোরিটি’ হিসেবে সেই হাঁকটা দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টকে। হাইকোর্ট কিংবা আপিল বিভাগের বেঞ্চ থেকে দু-চারটার তলবে তদারকি-তত্ত্বাবধানের সবটা সারে না। বেঞ্চের প্রধান কাজ বিচারকর্ম। বিচার ব্যবস্থার সব ঘাটে দেখভাল ও বিহিত করতে অন্য কাজের ভারমুক্ত দক্ষ লোকের শক্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনে। ভারমুক্ত ‘রেডিমেড’ অভিজ্ঞ দক্ষ মানুষ পাওয়া যাবে চাকরির শেষে অবসরে। তাদেরকে এ-কাজে লাগানো যায়, অবসরভোগীর আয়েশখানা হবার অপবাদ না ওঠে সেদিকটায় নজর রেখে। এতটুকু যদি সত্যি করা যায় ভাবা যাবে আরও কী করার আছে।
বিচারভ্রষ্টতার (মিসক্যারেজ অব জাস্টিস) ও বেহুদা হাজতবাসের ক্ষতিপূরণ
বিচারভ্রষ্টতার বলিদের ক্ষতিপূরণের এমন আলাদা আইনি ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ৩২টি স্টেটে আছে। আছে আরও অনেক দেশে। বেহুদা গ্রেপ্তারেরও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে সেসবখানে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে আইনি ব্যবস্থাই শুধু নয়, আছে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বেসরকারি সংগঠনও। যারা বিচারভ্রষ্টতার বলিদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের শেষ দেখে ছাড়ে। ক্ষতিপূরণ পরিশোধের আইনি স্কিম আছে। আদেশের পর অর্থ সংস্থানের টালবাহানা নেই তাদের। আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া ইংরেজদের সাবেক উপনিবেশগুলোও এই ক্ষতিপূরণের আইনি ব্যবস্থা করেছে আলাদা করে। ভারতের আইন কমিশন সবেমাত্র ২০২১-এর জুনে এবিষয়ে আলাদা আইনের সুপারিশ দিয়েছে সরকারকে। আমাদের কমিশনের খবর আসেনি এখনও। কারও ভাবনাচিন্তায়ও আছে কিনা জানা যায় না। আমরা আছি ইংরেজের ১৮৯৮ সালে করে দিয়ে যাওয়া সেই কার্যবিধিটাই আঁকড়ে। সাক্ষীর খরচার ব্যবস্থাই হয়নি আজও, নিজ খরচায় সাক্ষ্য দিয়ে নাগরিকের দায়িত্ব পালন চলছে।
আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির এখনকার বিধানে হাজতবাসের প্রতিকার পেতে বিচারে কারাদণ্ড পেতে হবে আগে। কারাদণ্ডের মেয়াদ থেকে হাজতবাসের মেয়াদটুকু কাটা গিয়ে শোধ হবে গায়ে গায়ে। হাজতবাসই বেশি থেকে গেলে কারামুক্তি নিয়েই বাকিটুকুর নাদাবি দিতে হবে মনে মনে। মৃত্যুদণ্ড হলে লেনাদেনাই চুকল! শুধুই অর্থদণ্ড হলে, আর বেকসুর খালাস হলে বেহুদা হাজতবাসের প্রতিবিধান নেই কার্যবিধিতে। কারাবাসে রূপান্তর ভিন্ন কোনও প্রতিবিধান নেই হাজতবাসের। আরেকটা মামলার বাঁকা পথ আছে বটে। বিচারের খাঁচায় দীর্ঘদিন আটকে থাকার পরে কোনওমতে একবার ছাড়া পেলে সে-খাঁচার দর্শকও হতে রাজি হয় না কেউ আর পূর্বযাতনা ভুলে। ক্ষতি যা হয়েছে তাইই ঢের, বাকিটুকুও পূরণ হবার ভয়ে ক্ষতিপূরণ চায় না আর!
রিটে যাওয়া বা স্বতঃপ্রণোদিত পাওয়া সবার হয় না। ক্ষতিপূরণের খাতও নেই রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাবার সোজা পথ তো একটা থাকতে হবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ গণ্য হবার কথা। আইনানুযায়ী ছাড়া রাষ্ট্রের হাতে জীবন-স্বাধীনতা-দেহ-সুনাম-সম্পত্তির ক্ষতি না হবার মৌলিক অধিকার আছে সংবিধানের ৩১-৩২ অনুচ্ছেদে। চলাফেরার ম্বাধীনতা আছে ৩৬ অনুচ্ছেদে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন বানিয়ে সেসব কেড়ে আটকানো হয় হাজতে; বিচারে দোষী হলে রাখা হয় জেলে, লটকানো হয় ফাঁসিতে। নির্দোষকে দোষী বানিয়ে বলি দেওয়া কি আইনে সাজে! তাই ঘটে যদি রাষ্ট্রের ব্যবস্থার সব গদিতে বসা লোকের খেয়ালি সন্দেহে, বেহিসেবি ভুলে, মতলবি জেদে তবে, নিজের লোকের এই ভ্রষ্টাচারের সমুচিত খেসারত দেওয়া তো রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। নির্দোষেরও তা ন্যায্য পাওনাই বটে। সরল বিশ্বাসের ছেলেখেলা ছেড়ে কাজে ভালো হবে রাষ্ট্রের সেসব ছেলে।
১৯৪৮ সালের ‘ইউনিভার্সাল ডিক্ল্যারেশন অব হিউম্যান রাইটস’-সহ দুনিয়ার তাবৎ ভালো ভালো কথা লিখেছি সংবিধানে। ভালো কোনও ব্যবস্থা কি করেছি সে অনুপাতে! ‘ইউনিভার্সাল ডিক্ল্যারেশন অব হিউম্যান রাইটস’-এরই অংশ ‘ইন্টারনাশন্যাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলেটিক্যাল রাইটস’ (ড্রাফট ১৯৫৪, স্বাক্ষরিত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৬৬, বলবৎ ২৩ মার্চ ১৯৭৬) অনুসমর্থন করেছি ৬ সেপ্টেম্বর ২০০০, কার্যকর করেছি (কাগজে-কলমে) ৬ ডিসেম্বর ২০০০। এই কভেন্যান্টের ৯(৫) অনুচ্ছেদে নাগরিকের বেহুদা গ্রেপ্তার-হাজতবাসের, ১৪(৬) অনুচ্ছেদে বিচারভ্রষ্টতার বলি নির্দোষের ক্ষতিপূরণ দিতে তাগিদ দিয়েছে রাষ্ট্রকে। সেই তাগিদেই ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোসহ অন্যরা ব্যবস্থা করেছে। আমরাই পড়ে আছি তিমিরে, নামে মাত্র জাতীয় মানবাধিকার কমিশন করে।
অর্থাভাবের অজুহাত ব্রিটিশ সরকারও তুলেছিল প্রথমদিকে। বার্মিংহাম সিক্সের প্যাডি হিলের জবাব, “সিরিয়ায় বোম ফেলতে যাবার তো প্রচুর অর্থ থাকে।” প্রতি বছর আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, বাড়ছে জিডিপি। নিম্ন আয়ের থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের স্তরে উঠে এগিয়ে চলেছি, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হবো বলে। উন্নয়ন কর্মযজ্ঞও চলছে বেশ। বিচারভ্রষ্টতার নিষ্ঠুর সত্য এড়িয়ে যাবার দাপট দেখানো আর কি সাজে! নাগরিকের অধিকার স্বীকার করার উদারতা দেখাতে হবে রাষ্ট্রকে। সরাসরি ক্ষতিপূরণ পাবার আইনি ব্যবস্থা করতে হবে ঐসব দেশের মতো।
অতিরিক্ত হাজতবাসের প্রত্যেকটা দিনের খেসারত দিতে হবে নির্ধারতি সময়ে তদন্ত, বিচার শেষ করতে না পারলে। বিচারভ্রষ্টতার বলি নির্দোষকে দিতে হবে উচিত ক্ষতিপূরণ। প্রতিটি দিনের হিসেবে হার বাঁধা থাকবে। খাত ও সংস্থা থাকবে নির্ধারিত। আদালতের কাগজ পেলে সেই সংস্থা কাগজের সত্যতা যাচাই করে ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণের টাকাটা দিয়ে দেবে। ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ হতে পারে সেই সংস্থা। দুর্নীতি, মানিলন্ডারিং, ফৌজদারি সব মামলার জরিমানা-বাজেয়াপ্তি আদায় করে সেই অর্থ দিতে হবে এ-খাতে।
(বৃহষ্পতিবার তৃতীয় পর্বে সমাপ্য)
লেখক: কলামিস্ট, প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক।
ইমেইল: [email protected]