বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে দুই দফা ধর্মঘট করছে পরিবহন শ্রমিকরা। এতে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন কাজের ব্যাঘাত ঘটছে।
বন্দরের প্রধান জেটি জেনারেল কার্গো বার্থে (জিসিবি) মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকেই আবারও কন্টেইনার পরিবহনে নিয়োজিত গাড়ি প্রাইম মুভার, ট্রেইলর চালক-সহকারীরা পণ্য পরিবহন কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে বন্দরের কন্টেইনার উঠানামায় নিয়োজিত ৬টি জেটি থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে।
জিসিবিতে বন্দরের ৩৭ শতাংশ পণ্য উঠানামা হয়ে থাকে। এই ৬ জেটি পৃথকভাবে পরিচালনা করছে বেসরকারি ছয় বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠান।
তবে পাশাপাশি থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং চট্টগ্রাম কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) থেকে পণ্য উঠানামা এবং পরিবহন পুরোপুরি সচল আছে। এই দুটি টার্মিনালে বন্দরে কন্টেইনার উঠানামার ৬২ শতাংশ হয়ে থাকে। বেসরকারি টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক এই দুটি টার্মিনাল পরিচালনা করছে।
চাকরির নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র এবং সরকার ঘোষিত মজুরি প্রদানের দাবিতে ২১ অক্টোবর দুই দিনব্যাপী প্রথম দফা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রাইম মুভার ট্রেইলার, কংক্রিট মিক্সচার, ফ্ল্যাটবেড ও ডাম্প ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতায় ট্রেইলর মালিক-শ্রমিকরা আলাচোনায় বসে সমঝোতা শেষে ৩৪ ঘণ্টা পর ধর্মঘট স্থগিত করা হয়।
তখন দাবি বাস্তবায়নের জন্য ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল চালক-শ্রমিকরা। সেই সময়ের মধ্যে একাধিকবার বৈঠকে বসলেও সমঝোতা না হওয়ায় আবারও ধর্মঘট ডেকে বসে আন্দোলনকারীরা। এর ফলে মঙ্গলবার রাতের পর বুধবার সকালেও কন্টেইনারভর্তি পণ্য উঠানামা বন্ধ থাকতে দেখা যায়।
এর আগেও দেখা গেছে, যতবারই শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছে, ততবারই এনসিটি ও সিসিটি সচল ছিল। কিন্তু অচল হয়ে যায় জিসিবি। অথচ দুটিই চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়োগকৃত অপারেটর দিয়ে পরিচালিত। কিন্তু শ্রমিকদের টার্গেট থাকে সবসময় জিসিবি।
প্রশ্ন উঠেছে, এনসিটি-সিসিটিতে কন্টেইনার উঠানামা সচল থাকলেও জিসিবিতে কেন বন্ধ থাকছে? কিংবা শ্রমিকরাই বা দাবি আদায়ে জিসিবিকে কেন টার্গেট করে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্মঘটকারী চট্টগ্রাম জেলা প্রাইমমুভার ট্রেইলার, কংক্রিট মিক্সার, ফ্ল্যাটবেড ও ডাম্প ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র কিংবা মজুরি নিয়ে এনসিটি-সিসিটিতে কোনও ঝামেলা নেই।
“আর সেখানে যারা কাজ করেন, তারা বেসরকারি অপারেটরের অধীনে, সেখানে তারা বেতন ভালো পান; ট্রেইলর, প্রাইম মুভারগুলো অপারেটরের নিজস্ব। ফলে সেখানে নিরবচ্ছিন্ন কাজ চলে। যত সমস্যা তো জিসিবিতে।”
বেসরকারি টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটাকে আমি বলবে বন্দর পরিচালনার ম্যানেজমেন্ট স্কিল। প্রতি মুহূর্তেই আমরা সেই দক্ষতা বাড়াচ্ছি। অন্যরা সেটি পারেনি। আর এই দক্ষতার কারণেই গত ১৮ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-সিসিটিতে একদিনের জন্য অচলাবস্থা তৈরি হয়নি। আমাদের এই সফলতার কারণেই চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
“বন্দর পরিচালনার এই ম্যানেজমেন্টের মূলেই আছে চালক-শ্রমিকরা। আমাদের ২০০ ট্রেইলর চালক নিয়োগপত্র নিয়েই কাজ করছে। সবগুলো ট্রেইলর আমাদের নিজস্ব। আর চালক-শ্রমিকদের মজুরি, ওভারটাইম সবকিছুই স্ট্যান্ডার্ড। শ্রমিকদের চাওয়ার আগেরই আমরা সেটি পূরণ করে দিয়েছি। ফলে চালক-শ্রমিক যখন ভালো, নিয়মিত মজুরি পান, তখন সে আন্তরিকভাবেই কাজ করেন। আর এতেই আমাদের সাফল্য আসছে। যেই ম্যানেজমেন্ট অন্যরা করতে পারেনি।”
ট্রেইলর-প্রাইম মুভারের মতো বিশাল গাড়িগুলো প্রধানত কন্টেইনারভর্তি পণ্য পরিবহনের কাজেই ব্যবহৃত হয়। জাহাজ থেকে নামার আগে জেটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমদানি পণ্যভর্তি একটি কন্টেইনার। গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে সেই কন্টেইনার নামিয়ে সরাসরি রাখা হয় ট্রেইলরে। আর ট্রেইলরে করে কন্টেইনারটি নিয়ে যাওয়া হয় বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে।
একইসঙ্গে রপ্তানি পণ্যভর্তি কন্টেইনার বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো থেকে সেই ট্রেইলরে করেই আনা হয় বন্দর জেটিতে। সেখানে থাকা ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ দিয়ে রপ্তানি পণ্যভর্তি কন্টেইনারটি জাহাজে তোলা হয়। এরপর জাহাজটি নির্ধারিত গন্তব্যে রওনা দেয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার একক কন্টেইনার পণ্য রপ্তানি হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান জেটি জিসিবিতে এই কাজটি এনসিটির মতোই একইভাবে করা হয়। কিন্তু জিসিবির বার্থ অপারেটরদের নিজস্ব কোনও ট্রেইলর নেই। নেই নিজস্ব চালক-সহকারী। ফলে এই কাজটি করতে তাদের নির্ভরশীল থাকতে হয় তৃতীয় একটি পক্ষের কাছে। তৃতীয় পক্ষটি ট্রেইলর-চালক সরবরাহ দেয়। এই তৃতীয় পক্ষের মধ্যে আছে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো, আছে বেসরকারি ট্রেইলর মালিক ও চালকদের গ্রুপ। ফলে এখানে চরম সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডা মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন যে ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, তাতে অভিযোগ শুধু দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। আমরা অর্থাৎ আমাদের এছাক ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে তো সেই অভিযোগ নেই। কিন্তু আর্থিক ক্ষতি ভোগান্তিতে আমাদেরকে পড়তে হচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য সবাইকে ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে। এটা তো মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”
প্রাইম মুভারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এনসিটি, সিসিটি, বেসরকারি ডিপো- যেখানেই কাজ করুক না কেন, সবাই আমাদের সংগঠনের তালিকাভুক্ত শ্রমিক। যেখানে তারা শ্রম অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন, সেখানেই আন্দোলন চলছে।
“এনসিটি, সিসিটিতে শ্রমিক ক্ষোভ নেই। তারা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন। ফলে তাদের কাজ বন্ধ নেই। অন্য প্রতিষ্ঠান যারা দাবি মানছে না, সেখানেই কাজ বন্ধ আছে।”
তিনি বলেন, “ট্রেইলর মালিকরা নিয়োগপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেও এখন সেটি মানছেন না। এখন আমরা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মহদয়ের মধ্যস্থতায় বৈঠকে এসেছি। দেখি কী হয়।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ট্রেইলর চালক-সহকারীর ধর্মঘটের কারণে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্য নেওয়া বন্ধ আছে। এর ফলে জেটিতে থাকা জাহাজ থেকে পণ্য উঠানামায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দুটি কন্টেইনার জাহাজ নির্ধারিত পণ্য নিয়ে যথাসময়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়েছে। রপ্তানি পণ্যভর্তি কন্টেইনার ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। এখন ধর্মঘট যদি অব্যাহত থাকে তাহলে জটিলতা তৈরি হতে পারে।”