দেরিতে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের রোষাণলে পড়েছেন স্পেনের রাজা, রানী ও প্রধানমন্ত্রী। তাদের গায়ে কাদা, ডিম ও অন্যান্য বস্তু ছুড়ে ক্ষোভ দেখিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রবিবার ভ্যালেন্সিয়া প্রদেশের পায়পোর্টা শহর পরিদর্শন করতে গেলে জনতা তাদের দেখে ‘খুনি’ ও ‘লজ্জা’ বলে চিৎকার করছে। তাদের দিকে কাঁদা, ডিম ও বিভিন্ন বস্তু ছুড়ে মারছে।
এসময় মুখ ও পোশাকে কাদামাটি লেগে থাকা অবস্থাতেই রাজা-রানিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলতে ও সান্ত্বনা দিতেও দেখা যায়।
গত মঙ্গলবার দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে দেশটি। পরদিন বুধবার সকালে উদ্ধার অভিযান শুরু করার আগেই দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
বন্যার পানিতে ডুবে গেছে অনেক এলাকার রাস্তা-ঘাট ও বাড়িঘর। হাজার হাজার মানুষ বাড়ির ও গাড়ির ছাদ, সেতু বা গাছে উঠেও প্রাণ বাঁচিয়েছেন। বহু মানুষ তাদের ভবনের বেজমেন্ট এবং নীচ তলায় আটকা পড়েন।
রবিবার পর্যন্ত প্রায় ২২০ জনের লাশ উদ্ধারের খবর জানা গেছে। জরুরি উদ্ধারকর্মীরা বেঁচে থাকা মানুষদের এবং মৃতদেহ উদ্ধারের আশায় ভূগর্ভস্থ গাড়ি পার্কিং এবং টানেলগুলোতে এখনো চিরুনি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিক্ষুব্ধ জনতার অভিযোগ, সতর্কবার্তায় দেরি এবং উদ্ধার কাজে ধীরগতির কারণে বেড়েছে প্রাণহানি।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, রাজা ৬ষ্ঠ ফিলিপ পায়পোর্টা শহরের একটি দিয়ে রাস্তা পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তার সামনে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এবং ভ্যালেন্সিয়ার আঞ্চলিক প্রধান কার্লোস মেজন।
এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রী ও আঞ্চলিক প্রধানকে কাদা ছুড়ে মারলে নিরাপত্তাকর্মীরা দ্রুত দুজনকে সেখান থেকে সরিয়ে নেন। তাদের উপরই জনতার ক্ষোভ ছিল বেশি।
একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় স্পেনের রাজা ষষ্ঠ ফিলিপ ও রানি লেতিজিয়াকেও। জনতার ছোড়া কাদা রাজা–রানির মুখে ও কাপড়ে লাগে। তবে মুখে এবং কাপড়ে কাদা নিয়েই ভিঁড়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন রাজা-রানি। এসময় তাদের দেহরক্ষীরা তাদের মাথার উপরে ছাতা ধরে রাখেন।
বিবিসি জানিয়েছে, বিক্ষোভের সময় রাজা ফিলিপের নিরাপত্তারক্ষী এবং পুলিশ সদস্যরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও জনতার আক্রোশের মুখে তারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠলে প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজকেও দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী সানচেজকে তাড়ানোর সময় তার গাড়িতেও পাথর নিক্ষেপ করা হয়। তিনি চলে যাওয়ার পর জনতা স্লোগান দেয়, “সানচেজ কোথায়?”
পাউ নামের এক ছেলে বিবিসিকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি মাত্র ১৬ বছর বয়সী। আমরা সাহায্য করছি, কিন্তু নেতারা কিছুই করেন না। মানুষ এখনো মরছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
একজন নারী বলেন, “তারা আমাদেরকে মরতে রেখে গেছে। আমরা সবকিছু হারিয়েছি— আমাদের ব্যবসা, আমাদের বাড়ি, আমাদের স্বপ্ন।”
রাজাকে বেশ কয়েকজনকে সান্ত্বনা দিতে দেখা যায়। এমনকি তাদেরকে আলিঙ্গনও করতে দেখা গেছে। তবে কিছুক্ষণ পরই তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেন নিরাপত্তাকর্মীরা।
এ ঘটনার পর স্পেনের রাজা-রানির বন্যাবিধ্বস্ত আরেকটি স্থান চিভা শহর পরিদর্শনের পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়। পায়পোর্টা ও চিভা শহরই এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সেখানে ২৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভ্যালেন্সিয়ার শহর চিভায় মঙ্গলবার মাত্র আট ঘণ্টার মধ্যে এক বছরের সমান বৃষ্টিপাত হয়। সেদিন সেখানে ৪৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া দপ্তর, যা শহরটির প্রায় এক বছরের বৃষ্টিপাতের সমান। মাত্র চার ঘণ্টার মধ্যে ৩২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
এমন অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট আকস্মিক পানির প্রবাহ রাস্তা ও হাইওয়েগুলোকে নদীতে রূপান্তরিত করে। সেতুগুলোও ডুবে যায়। ডুবে যায় বাড়ি-ঘরসহ সব ভবন। এতে মঙ্গলবার রাতে লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাস্তা দিয়ে সুনামির ঢেউয়ের মতো পানি প্রবাহিত হয়েছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে এক মিটারের বেশি উঁচু পানির ঢেউ তৈরি হয়। পানির স্রোত অনেক বাড়ির দেয়ালও ভেঙে দেয়। গাড়িগুলো সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
রাজা পরে রাজপরিবারের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে বলেন, তিনি বিক্ষোভকারীদের ‘ক্রোধ এবং হতাশা’ বুঝতে পেরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী সানচেজ গত শনিবার ১০ হাজার সৈন্য, পুলিশ এবং সিভিল গার্ড সদস্যকে দুর্গত এলাকায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং একে স্পেনে শান্তিকালীন সময়ে বৃহত্তম সেনা মোতায়েন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে রবিবার তিনি স্বীকার করেছেন, এই সহায়তা যথেষ্ট নয় এবং সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন