ব্যাংকে জমা রাখা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে আমানতকারীদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই—এ আশ্বাস সরকারের। তবে কয়েকটি ব্যাংকের শাখা থেকে এখনও আমানতের দুই লাখ টাকাও একদিনে তুলতে দেওয়া হচ্ছে না। গত তিন মাস ধরে চলা এই সংকট আরও প্রকট হচ্ছে বলে অভিযোগ অনেকের।
গত ৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, দেশের ব্যাংকগুলোর প্রায় ৯৫ শতাংশ হিসাবে জমা অর্থের পরিমাণ দুই লাখ টাকার নিচে। প্রতিটি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত বিমার আওতায় থাকে। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই, পাশে আছে সরকার।
তবে প্রায় প্রতিদিনিই বিভিন্ন গ্রাহকরা ব্যাংকে গিয়ে চাহিদা মতো আমানত ফেরত পাচ্ছেন না বলে সংবাদপত্রের অফিসে ফোন করে অভিযোগ করছেন। তাদের প্রশ্ন, কবে নাগাদ এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? কারণ, নিজের টাকা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে না পেরে এ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া অনিয়মের খবরে বিচলিত হয়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে। এর ফলে নগদ অর্থের সংকটে পড়ে ব্যাংকগুলো।
চেক নিয়ে শাখায় গিয়ে একরকম খালি হাতে ফেরত আসতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গত তিন মাস ধরে ব্যাংকে এই সংকট চলছে। অনেক আমানতকারী বলছেন, ব্যাংক শাখা থেকে ৫ লাখ টাকা তুলতে গিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা তুলতে পারছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক জামিনদার হয়ে তারল্য সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংককে নগদ টাকা ধার পাইয়ে দিয়েছে। তবে তাতেও সমাধান হচ্ছে না।
ঢাকার মিরপুরের আব্বাস উদ্দিন (ছদ্মনাম) নামের এক আমানতকারী ২০ লাখ টাকা মেয়াদি আমানত রয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শাখায়। তিনি সেখান থেকে গত এক মাসে অন্তত ১০ দিন যোগাযোগ করে সাকুল্যে আড়াই লাখ টাকা তুলতে পেরেছেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার পেনশনসহ অন্যান্য সঞ্চয় এই ব্যাংকে আমানত রেখেছিলাম। এখন সবাই টাকা তুলে ফেলছে দেখে আতঙ্কে পড়ে আমিও টাকা তুলে নিতে চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না জেনে আরও আকঙ্কিত হয়ে পড়েছি।”
ঝিনাইদহের ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায় ৫ লাখ টাকার মতো আমানত ছিল আজাহার আলী নামের এক গ্রাহকের। সম্প্রতি ছেলের বিয়ের খরচের জন্য ২ লাখ টাকা তুলতে শাখায় গেলে জানতে পারেন এত টাকা এক দিনে তুলতে পারবেন না। অবশেষে শাখা থেকে ২ হাজার টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয় ওই গ্রাহকের হাতে।
ওই গ্রাহক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার জরুরি ভিত্তিতে টাকার দরকার ছিল। এই মুহূর্তে টাকা না পেলে পরে সেই টাকা তো আমার কাজে আসবে না।”
ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ৯-১০টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বসে আছে। তার এমন বক্তব্যের পর আমানতকারীদের মধ্যে ভয় ধরে যায়। এরপর থেকে অনেক ব্যাংকে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত আগস্ট মাসে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ২৭ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার আমানত কমে যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, “আমানত কমেছে এর অর্থ হলো- ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে ঘরে রেখে দেওয়া হয়েছে।
“ওই সময়টাতে দুর্বল ব্যাংক থেকে সাধারণ আমানতকারীরা টাকা তুলে সবল ব্যাংকে রাখে। ফলে ব্যাংক খাতের আমানত কমার কথা নয়। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় ব্যাংক খাতের আমানত কমল কেন? অর্থাৎ ওই টাকা ব্যাংকের বাইরে চলে যায়।”
আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের ব্যাংক দখল ও সেখান থেকে ঋণের নামে বড় অঙ্কের অর্থ বের করে নিয়ে যাওয়ার খবর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে গণমাধ্যম। ফলে ওই গ্রুপটির দখলে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করে আমানতকারীরা।
এসআলম গ্রুপের দখলে থাকা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে সেখানে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর।
এই ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।
এছাড়া দুর্বল অবস্থায় থাকা এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংক ও ইউসিবির পর্ষদেও পরিবর্তন এসেছে।
এস আলমের দখলে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তোলার হিড়িক পড়লে ওই ব্যাংকগুলোকে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে নগদ টাকা ধার করার সুযোগ করে দিতে গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে গত অক্টোবর মাসের শুরু থেকে এভাবে নগদ টাকা ধার করার সুযোগ দেওয়ায় গত মাস অক্টোবর থেকে আমানত ফেরত পেয়েছেন অনেক গ্রাহক। তবে সেটাও ছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এক গ্রাহক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ব্যাংকটির মিরপুর শাখায় তার প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো আমানত ছিল। শাখা থেকে টাকা না পেয়ে তিনি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে দুই লাখ টাকার মতো আমানত তুলতে সক্ষম হয়েছেন। তাও একবারে টাকাগুলো পাননি।
এদিকে কয়েকটি ব্যাংকে টাকা তোলার চাপ থাকলেও সেই আমানত আবার জমা হচ্ছে সবল ব্যাংকগুলোতে।
এর ফলে ওই সবল ব্যাংকগুলোর আমানতে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। এর মধ্যে গত আগস্টে সিটি ব্যাংকে রেকর্ড ৩ হাজার কোটি টাকার নিট আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। পরের মাস সেপ্টেম্বরে ব্র্যাক ব্যাংক ২ হাজার কোটি টাকার নিট আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাইলফলক স্পর্শ করে।
এ নিয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকা ধার নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় এই সংকট কিছুটা নিরসন হয়েছে। একসঙ্গে অনেক আমানতকারী টাকা তোলার চেষ্টা করায় এই সংকট ঘনীভূত হয়েছে। তবে আশা করা যাচ্ছে, দ্রুত এই সংকট দূর হয়ে যাবে।”
ব্যাংকগুলো অনেক গ্রাহকের পুরো আমানত ফেরত দিতে না পেরে সুদের হার ১ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করছে বলেও জানা গেছে।
তাছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের আমানত বীমা স্কিমের আওতায় গ্রাহকের ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত বীমার আওতায় আছে। ফলে ব্যাংক অবসায়ন হলেও আমানতকারীকে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পরিশোধ করবে বলেও সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
এর ফলে অনেক আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পেরে সেই আমানত কয়েকটি ভাগে করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে রাখতে চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
গ্রাহকদের অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, টাকা তোলার প্রবণতা দেখা গেছে মোটামুটি ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর গ্রাহকদের মধ্যেও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রিমিয়ার ব্যাংকের এক গ্রাহক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বসুন্ধরা শাখায় তার বড় অঙ্কের মেয়াদি আমানত রয়েছে। সম্প্রতি সেই আমানত ভাঙতে গেলে ব্যাংক থেকে টাকা নেই বলে জানানো হয়। পরে চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য অঙ্কের আমানত ফেরত দেওয়া হয় তাকে।
গত আগস্ট পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত ছিল ১৭ লাখ ৩১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মোট আমাানতকারীদের মধ্যে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা আছে এমন আমানতকারীদের হার ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ।