Beta
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

তাবলিগে কী নিয়ে দ্বন্দ্ব, যা আবার এল সামনে

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার আলেম-ওলেমাদের সম্মেলন থেকে তাবলিগ জামায়াতের বিশ্ব আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার আলেম-ওলেমাদের সম্মেলন থেকে তাবলিগ জামায়াতের বিশ্ব আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

এক দ্বন্দ্ব থেকে সাত বছর আগে দুই ভাগে বাংলাদেশে হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। ভাগাভাগির ইজতেমার আগে ঢাকায় দুই পক্ষে মারামারিও হয়েছিল। এরপর আলাদা ইজতেমা আয়োজনের মধ্যদিয়ে পরিস্থিতি শান্তই ছিল। কিন্তু এবার এক পক্ষের সমাবেশ করে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার নতুন করে সামনে আনল পুরনো দ্বন্দ্ব।

মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ওলামা মাশায়েখ’দের এক সমাবেশ থেকে তাবলিগ জামাতের দিল্লির মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি তোলা হয়।

কাকরাইল মসজিদ এবং টঙ্গীর ইজতেমায় সাদপন্থীদের কাজ দেওয়ার কোনও সুযো্গ না দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে তারা।

তাবলিগে মাওলানা সাদের বিরোধী পক্ষ মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারী। তারা নিজেদের ‘শুরায়ে নিজাম’ বলে পরিচয় দেন। অন্যদিকে সাদপন্থিরা নিজেদের ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’র অনুসারী বলে পরিচয় দেন।

গত শতকের ষাটের দশক থেকে টঙ্গির তুরাগ তীরে হয়ে আসছে বিশ্ব তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন, যা ইজতেমা নামে পরিচিত।

অর্ধ শতক কাল পরে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ২০১৮ সালে ইজতেমা আয়োজন নিয়ে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় দুই পক্ষ দুই বারে ইজতেমা করবে। তারপর থেকে সেভাবেই হয়ে আসছে।

আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমার প্রথম পর্ব এবং ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের সময়ও ঠিক হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৫০টির বেশি দেশে তাবলিগ জামাতের প্রায় ৮ কোটি অনুসারী আছে।

তাবলিগের শুরু যেভাবে

ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে তাবলিগ জামাতের শুরুটা হয়েছিল ১৯ শতকের শুরুর দিকে ভারতে।

উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার মাজাহির উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভির উদ্যোগে এই প্রচারের শুরু। তিনি ১৯২০ সালে তিনি দক্ষিণ দিল্লির পশ্চিম নিজামুদ্দিন এলাকার এক মসজিদে তাবলিগের মূল কার্যক্রম গড়ে তোলেন। এটি এখন নিজামুদ্দিন মারকাজ নামে পরিচিত।

সেখান তেকে ধীরে ধীরে তাবলিগ জামাতের কাজ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এই কার্যক্রম পুরোপুরি পরিচালিত করতে শায়খুল হাদিস জাকারিয়া কান্ধলভীর ‘ফাজায়েলে আমল’ ও ‘ফাজায়েলে সাদাকাত’ বই দুটিকে তাবলিগের পাঠ্যক্রম হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।

১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী মারা গেলে তার ছেলে হাদিসবিশারদ মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীকে তাবলিগের আমির হন।

ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতারে লেখা ‘তাবলীগ জামায়াত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কাজ শুরু হয় ১৯৪৮ সালে মাওলানা আবদুল আজিজের প্রচেষ্টায়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রথম আমির।

প্রতি বছর টঙ্গির তুরাগ তীরে হয় বিশ্ব ইজতেমা।

ইজতেমার শুরু যেভাবে

ইজতেমার অর্থ সমাগম। বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে তো বটেই, বৈশ্বিকভাবেও তাবলিগ অনুসারীদের সবচেয়ে বড় জমায়েত।

সারা বছর দেশব্যাপী তাবলিগের কর্মপদ্ধতি কীভাবে চলবে, তা নিয়ে ইজতেমায় আলোচনা হয়। একই সঙ্গে ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বেশিরভাগ তাবলিগ অনুসারী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধর্মপ্রচারের কাজে বের হন। ইজতেমার মধ্য দিয়েই মূলত দেশব্যাপী তাবলিগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতিসহ অন্যসব কার্যক্রম প্রণীত হয়।

১৯৪৬ সালে মাওলানা আবদুল আজিজের প্রচেষ্টায় ঢাকার কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ইজতেমা আয়োজিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন তাবলিগের বিশ্ব আমির মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি।

এদিকে ১৯৬৫ সালে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভির মৃত্যুর পর দিল্লিতে মাওলানা এনামুল হাসানকে তাবলিগের আমির করা হয়। সেসময় মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভির বই ‘হায়াতুস সাহাবা’ ও ‘মুন্তাখাবে হাদিস’ তাবলিগের পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হয়।

১৯৬০ সালের পর থেকে কয়েক বছর ঢাকার রমনা উদ্যানে ইজতেমার আয়োজন হয়েছিল। স্থান সঙ্কুলনা না হওয়ায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা সরিয়ে নেওয়া হয় গাজীপুরের টঙ্গীতে তুরাগ নদের তীরে পাগার গ্রামের খেলার মাঠে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টঙ্গীর ওই মাঠটি তাবলিগ জামাতের বাৎসরিক ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেন। এরপর থেকে ১৬০ একর বিশাল ময়দানে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

দ্বন্দ্বের আগে স্থানাভাবের কারণে ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো ২ ভাগে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে শুরু করে। তখন বাংলাদেশের জেলাগুলোকে ভাগ করে একেকটি ইজতেমায় ৩২টি জেলার সদস্যরা অংশ নিত।

২০১৮ সালে তাবলিগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয় অনেকে।

দ্বন্দ্বের শুরু কোথায়?

ভারতে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভির হাতে সৃষ্ট তাবলিগ জামাত শুরু থেকেই ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিল কওমি মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশেও সেভাবেই এর সূচনা হয়।

১৯৯৫ সালে মাওলানা ইনামুল হাসান কান্ধলভি মারা যাওয়ার আগে তাবলিগের ১০ সদস্যকে নিয়ে শূরা ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। যেন তার অনুপস্থিতিতে শূরা সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটি ২০১৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

২০১৫ সালে ইলিয়াস কান্ধলভির প্রপৌত্র মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব আমির করা হয়।

কিন্তু ২০১৭ সালে সাদ কান্ধলভির কয়েকটি বিবৃতি নিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসারীরা আপত্তি তোলে। তারা মাওলানা সাদের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

তখন তাবলিগ জামাতের ভেতরে চরম দ্বন্দ্ব শুরু হয় দিল্লির নিজামুদ্দিনে। মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে পৃথক ফতোয়া দিয়ে বৈশ্বিকভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি অনুসরণ করা হয় কওমি ও দেওবন্দি মাদ্রাসাগুলোয়।

সেই বিরোধ বিশ্বের অন্য সব দেশেও তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে।

বাংলাদেশে বিভাজন

কাকরাইল মসজিদ

দিল্লির দ্বন্দ্বের রেশ এসে পড়ে বাংলাদেশেও। দেওবন্দ মাদ্রাসার অনুসরণে বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার অনুসারীরাও মাওলানা সাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিতও্ ঘোষণা করে।

২০১৮ সালে সাদ কান্ধলভী ঢাকায় আসার দিন বিরোধী পক্ষ তাকে ঠেকাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করে। তখন অন্য পক্ষের সঙ্গে তাদের মারামারি বাধে। তার আগে

কাকরাইল মসজিদেও দুই পক্ষের হাতাহাতি হয়।

মারামারির মধ্যে মাওলানা সাদ ঢাকায় আসার পর পুলিশের পাহারায় তাকে কাকরাইল মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরাপত্তার কারণে সেবার তার ইজতেমায় যোগদানও হয়নি।

দুই পক্ষকে মানাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বৈঠকও করেন। পরে সিদ্ধান্ত হয় যে দুই পক্ষের ইজতেমা আলাদাভাবে হবে।

সাদের কোন বক্তব্য নিয়ে বিরোধ

মাওলানা সাদ কান্ধলভি

সাদ কান্ধলভি তাবলিগ জামাতে কিছু সংস্কারের কথা বলেন, যা নিয়ে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। তার মতে, ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচার অর্থের বিনিময়ে করা উচিৎ নয়।

এর মধ্যে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পড়ে যায় বলে তা নিয়ে আপত্তি ওঠে আলেমদের মধ্য থেকে।

সাদ কান্ধলভি আরও বলেন, মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিৎ, তাতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে।

তার বিরোধীরা বলছে, সাদ কান্ধলভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাসের পরিপন্থি। অন্যদিকে সাদ সমর্থকরা বলছে, সংস্কারের প্রস্তাব মানতে না পেরে তাবলিগের একটি অংশ বাংলাদেশে সংগঠনটির কর্মকাণ্ডকে ‘রাজনৈতিক চেহারা’ দিতে চায়।

২০১৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলন হয় । সেখানে সাদ কান্ধলভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সমাবেশে সাদকে নিয়ে বিষোদগার

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবারের সমাবেশটি ডাকা হয়েছিল ‘ওলামা মাখায়খ’ ব্যানারে। তবে সেখানে তাবলিগের মাওলানা জুবায়ের সমর্থকরাই ছিলেন মূল আয়োজক।

‘কওমি মাদ্রাসা, তাবলিগ ও দ্বীন রক্ষার লক্ষ্যে’ ডাকা এই সমাবেশে বক্তারা পুরোটা সময়জুড়েই মাওলানা সাদের বিষোদগার করেন।

ভারতের মাওলানা সাদকে ইঙ্গিত করে মাওলানা আবদুল হামিদ  বলেন, “সাদের ফিতনা দিন দিন বাড়তেছে। এক কাকরাইল। এক এস্তেমা।”

সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “আপনাদেরকে বলছি, তাবলিগের নামে সাদীয়ানীদের যেন কোনও কর্মকাণ্ড না থাকে।”

উম্মুল মাদানী হাটহাজারী মাদ্রাসার মাওলানা মুফতী জসিমউদ্দীন বলেন, “উনি (সাদ) সঠিক রাস্তার মধ্যে নাই, উনি বাতেল। ওনার তাবলিগও বাতেল। টঙ্গীর মাঠ আসল ও সঠিক তাবলিগ জামাতকে দেওয়ার জন্য সরকারে কাছে অনুরোধ করব। ওলামায়ে একরামের সঙ্গে বসে সেই ব্যবস্থা করেন।”

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ওলামা-মাশায়েখদের ইসলামি মহাসম্মেলন’। তাবলীগ জামাতের একাংশের এই আয়োজনে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হন আলেম-ওলামারা। ছবি : জীবন আমীর
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘ওলামা-মাশায়েখদের ইসলামি মহাসম্মেলন’। তাবলীগ জামাতের একাংশের এই আয়োজনে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হন আলেম-ওলামারা। ছবি : জীবন আমীর

জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা আবু কাহের নদভী বলেন, “সাদ এবং তার অনুসারী এরা বাতেল জামাতের অংশ। বাতেল ব্যক্তি জামাতে তাবলিগের নেতৃত্ব দেবে, এটা হতে পারে না।”

মাওলানা সাদকে তাবলিগের ‘স্বঘোষিত আমির’ দাবি করে মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী বলেন, “সাদ কোরআন-হাদিস, আলেম-উলামা, আল্লাহর অলি, নবী ও স্বয়ং আল্লাহর বিরুদ্ধে কুফরি বক্তব্য দিতে থাকে। তাই সারাবিশ্বে তাবলিগের মূলধারা তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।”

দেওবন্দ থেকে তাবলিগের সৃষ্টি দাবি করে জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার হোসেন কাসেমী বলেন, “এই তাবলিগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাইলে আলেম-ওলামারা বসে থাকবে না।”

সমাবেশে মাওলানা মাহফুজুল হক ঘোষণাপত্র তুলে ধরেন। সেখানে ৯টি দাবি জানানো হয়। তার মধ্যে রয়েছে- মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না, কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী ইজতেমা শূরায়ে নিজাম দ্বারা পরিচালিত হবে। সাদপন্থিদের কোনও কাজ চালাতে দেওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত