জনমত যাচাইয়ের জন্য প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯’ এর সংশোধিত খসড়া থেকে বাদ দেয়া হয়েছে চলচ্চিত্র বিভাগকে।
অথচ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে বিদ্যমান ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভাগ’টি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
এরই মধ্যে বিষয়টি নজরে এনে গণমাধ্যমে বিবৃতিও পাঠিয়েছে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ । বিবৃতিতে চলচ্চিত্র বিভাগকে বাদ দেয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়েছে-
“বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র সংস্কৃতিচর্চার পরিসর ও পরিবেশকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য বিগত সময়গুলোতে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে দাবি করে এসেছে যেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে একটি স্বতন্ত্র ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়, কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি-প্রস্তাবিত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯ এর সংশোধিত খসড়ায় শিল্পকলা একাডেমি থেকে ‘চলচ্চিত্র’কেই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
বিবৃতিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ বাদ দেয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন সংগঠনটি।
জুলাই গণভ্যুত্থানের পর সবকিছুতেই যখন সংস্কারের দাবি উঠেছিল তখন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের অনেকের অংশগ্রহণে তৈরি করা হয়েছিল চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ নামে একটি উদ্যোগ। তাতে চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকারের কাছে বেশকিছু প্রস্তাবনাও তুলে ধরা হয়। প্রতিবাদ এসেছে সে প্লাটফর্ম থেকেও।
‘চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ’- এর পক্ষ থেকে বলা হয়, “শিল্পকলা একাডেমির ডিজি হিসেবে জনাব অধ্যাপক জামিল আহমেদ নিয়োগ পাওয়াতে অন্যসব শিল্পীদের মত আমরা চলচ্চিত্র কর্মীরাও খুশি হয়েছিলাম। একই সাথে দায়িত্ব গ্রহণের পর চলচ্চিত্র কর্মীদের সাথে শিল্পকলা একাডেমি সংস্কারে করণীয় কী- এই বিষয়ে মতামত সভার আয়োজন করেছিলেন। তখন অজস্র চলচ্চিত্র কর্মী ও অন্যান্য শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জনমতের ভিত্তিতে শিল্পকলা একাডেমির জন্য আলাদা একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছিল এবং তারা সেই প্রস্তাবনাকে সাদরে গ্রহণ করেন।”
“সেখানে মূল দাবি ছিল একাডেমির কার্যক্রমে ‘স্বতন্ত্র চলচ্চিত্র বিভাগ’ তৈরি করা। কিন্তু প্রস্তুতকৃত শিল্পকলা একাডেমির খসড়া প্রস্তাবনায় চলচ্চিত্র বিভাগের উপস্থিতি না থাকা, চলচ্চিত্র কর্মীদের হতাশ করেছে। আমরা চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ’২৪ থেকে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং আশা করি দ্রুত খসড়া সংশোধন করে চলচ্চিত্রের জন্য আলাদা বিভাগ ঘোষণা করা হবে এবং সেই বিভাগে পরীক্ষিত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিয়োগ দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প উন্নয়নে শিল্পকলা একাডেমি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন।”
শিল্পকলার মহাপরিচালক, সংস্কৃতি ও তথ্য উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলচ্চিত্র সমালোচক ফাহমিদুল হক বলেন, “চলচ্চিত্র নিয়ে আপনাদের প্ল্যানটা আসলে কী? আমাদের দাবিটা শোনেন:
হয় চলচ্চিত্রকে পুরোপরি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনুন অথবা খসড়া অধ্যাদেশে বদল এনে চলচ্চিত্র নামে পূর্ণাঙ্গ বিভাগ করুন।”
ফেডারেশান অব ফিল্ম সোসাইটিজ এর সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন বলেন, “সংস্কৃতির চর্চার জন্যই শিল্পকলায় চলচ্চিত্র থাকবে৷ অন্য শিল্প মাধ্যমগুলোর জন্য শিল্পকলা একাডেমি যা করে, চলচ্চিত্রের জন্যেও তা করবে৷ শিল্পচর্চার জন্যেই শিল্পকলা একাডেমি৷ আর গত প্রায় ৭০ বছর ধরে এই দেশে চলচ্চিত্র একাধারে সংস্কৃতি এবং শিল্প৷ একে সহজে মুছে ফেলতে পারবেন না৷ তাই এইসব অপচেষ্টা বন্ধ করুন৷”
প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালের আইনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পাঁচটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই পাঁচটি বিভাগ ছিল- চারুকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা, চলচ্চিত্র (সিনেমাটোগ্রাফি) এবং গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ। অর্থাৎ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শুরু থেকেই পৃথক ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ ছিল।
প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকার ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন রহিত করে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯’ জারি করে। ১৯৮৯ সালের এই আইনে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’- বাদ দেয়া হয়। তখনও এর বিরোধিতা করে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানায়।
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এবং দেশের চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পরিষদ ১৯৮৯ সালের আইনের ৮ নং ধারার ২ নম্বর উপধারার অধিকারবলে চলচ্চিত্রকে নাট্যকলা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত করে ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভাগ’ গঠন করে চলচ্চিত্র বিষয়ক কাজ পরিচালনা করে আসছে।
ফেডারেশান অব ফিল্ম সোসাইটিজ বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শুরু থেকেই ‘চলচ্চিত্র’ একাডেমির অংশ হয়ে আছে। যদিও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র বিভাগ সবসময় সক্রিয় অবস্থায় ছিল না। গত একদশকের কিছু বেশি সময় ধরেই আমরা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র বিষয়ক তৎপরতা আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। আর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চলচ্চিত্র বিষয়ক এই তৎপরতায় ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ এবং দেশের চলচ্চিত্র সংসদসমূহ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দেশে চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমরা চাই না, দেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতিচর্চার এই ধারাবাহিক কার্যক্রমে কোনো বাধা তৈরি হোক।”
খসড়াটি পরিহার করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে অবিলম্বে একটি পৃথক ও স্বতন্ত্র ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা করার দাবি জানিয়েছে চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ, ফেডারেশান অব ফিল্ম সোসাইটিজসহ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের অনেকেই।
গত ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত খসড়া প্রস্তাবনাটির বিষয়ে আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে সকল অংশীজনের কাছ থেকে গঠনমূলক মতামত/পরামর্শ চেয়েছে শিল্পকলা একাডেমি। অনুরোধ জানানো হয়েছে ই-মেইলে [email protected] লিখিত আকারে তা পাঠাতে।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ কি থাকছে- এমন প্রশ্নই এখন সংশ্লিষ্টদের।